ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ভয় বাড়াচ্ছে কৌতূহলী মন

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫০, ৩১ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভয় বাড়াচ্ছে কৌতূহলী মন

আড্ডা প্রিয় আর চায়ের কাপে ঝড় তোলা বাঙালিকে ঘরে আটকে রাখার এক ‘বিরক্তিকর’ সমীকরণে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়ানো নভেল করোনাভাইরাস।

সচেতন মানুষ এই ভাইরাসের সংক্রমণের ব্যাপকতা আন্দাজ করে ঘরে থাকলেও অপেক্ষাকৃত কম সচেতন আর অতিউৎসাহী মানুষঘরে থাকার বিধানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নানা অজুহাতে অপ্রয়োজনে রাস্তায় আসছে। শহরের অলিগলিতে এই চিত্র দেখা গেলেও গ্রামে তা আরো ব্যাপক। মফস্বল এলাকায় দিব্বি হাটবাজারে আড্ডা দিচ্ছে সেখানকার অনেকেই ।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে এসে মাইকিং করে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাঠিপেটা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইলেও তাদের অনুপস্থিতিতে আবারো পুরোনো চেহারায় ফিরছে মানুষ।

জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মধ্যে দুই শ্রেণির মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছেন। এর মধ্যে এক শ্রেণির কোনো কাজই নেই। এলাকার পরিস্থিতি দেখতে কৌতূহলী মন তাদের ঘরের বাইরে টেনে আনছে। আর একটি শ্রেণি নিম্ন আয়ের মানুষ, যারা দিন আনে দিন খায়। দেশ সবকিছু বন্ধ থাকায় অসহায় মানুষ এখন খাবার সংকটে রয়েছেন। অনেক এলাকায় এখনও ত্রাণ পৌঁছেনি। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে রাস্তায় নামছে কর্মের সন্ধানে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশ ফেরতদের হোম কোয়ারেন্টাইনে না থাকা। অনেক এলাকায় প্রবাসীরা সরকারি নির্দেশ না মেনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যা ঝুঁকিপূর্ণ।

রাজধানীর রামপুরা এলাকার একটি গলি উলন বাজার রোড। করোনা সংক্রমণে ভয় থাকায় এখানে আর আগের মতো জটলা থাকে না। তবে ছোট ছোট আড্ডা দেখা গেছে। সোমবার সেখানে দেখা গেছে, অপ্রয়োজনে কেউ কেউ এক জায়গায় হয়ে গল্প করছে। তাদের দু—একজনের মুখে মাস্ক থাকলেও বেশিরভাগেরই নেই। করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকারের ঘরে থাকা কর্মসূচি স্মরণ করিয়ে দিলে তারা জানান, বাসায় থাকতে থাকতে তারা হাঁপিয়ে ওঠেছেন। এজন্য পরিচিতরা মিলে একটু আড্ডা দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের উপস্থিতি টের পেলে কিছুক্ষণের জন্য তারা চলে যান।

রাজধানীর মতো মফস্বল এলাকায় এতো লুকোচুরি নেই। তবে গ্রামের মানুষ এখন পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত কম সচেতন। করোনা এখনও তাদের মনে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। এজন্য সংকোচ ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছেন এখানে সেখানে।

খুলনা থেকে প্রতিনিধি জানিয়েছেন, খুলনা নগরীতে বেশির ভাগই শ্রমজীবী ও দিনমজুরের রুটি রুজির জন্য ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন। আর এক শ্রেণির উঠতি বয়সী তরুণ ও যুবকরা শুধুমাত্র আড্ডা দিতেই শহরের বিভিন্ন মোড়ে বের হচ্ছে। তবে, সামরিক বাহিনী, জেলা-উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট জনগণকে ঘরে থাকতে সব ধরনের সচেতনতামুলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের সিলেট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় হোম কোয়ারেন্টাইন না মেনে বিয়ের আয়োজন করেন এক প্রবাসী। এজন্য জরিমানাও হয়েছে। এ ঘটনা ছাড়াও প্রবাসীদের মাঝে হোম কোয়ারেন্টাইন অমান্য করার প্রবণতা বেশিই। এ কারণ হিসেবে তাদের খামখেয়ালিপনাকেই দায়ী করছেন স্থানীয়রা। প্রবাসীরা মূলত নিজে ‘পূর্ণ সুস্থ’ এমন আত্মবিশ্বাস থেকেই ঘরে না থেকে বাইরে ঘোরাফেরা করছেন। তাদের কোনভাবেই হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা যাচ্ছে না।

সাভার প্রতিনিধি জানান, নিজেকে সুস্থ দাবি করে হোম কোয়ারান্টাইনে থাকছেন না সেখানকার বিদেশফেরত প্রবাসীরা। প্রশাসনের খুব বেশি তৎপরতা নেই। স্থানীয় পর্যায়েও প্রশাসনের শক্ত তৎপরতার অভাবে গণজমায়েত এড়ানো যাচ্ছে না। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এ পরিস্থিতি দেখা গেছে। বিদেশফেরতরা নিয়মিত চায়ের দোকান, বাজার, মসজিদে যাতায়াত করছে। এলাকার মানুষের মধ্যে কিছুটা ভীতি থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় গণজমায়েত তা ম্লান করে দিচ্ছে।

নড়াইল প্রতিনিধি জানান, মফস্বল শহরে সরকারি নির্দেশ মেনে চলার প্রবনতা দেখা গেলেও গ্রামে সেই সচেতনার অভাব রয়েছে। নড়াইলের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন মাইকিং করে জনগণকে ঘরে থাকতে উদ্বুদ্ধ করলেও তা মানছে না। পুলিশ মাঝে মাঝে ঝটিকা সপরে এসে লোকজনতে ঘরে তুলে দিচ্ছেন।

টাঙ্গাইল থেকে নিজস্ব প্র‌তি‌বেদক জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে প্রশাসনের কঠোর নির্দেশ থাকার পরও জেলার কাঁচাবাজারগুলোতে মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্বের নিয়ম। জেলার বিভিন্ন উপজেলার সাপ্তাহিক হাটগুলো বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হলেও সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সমাগম হচ্ছে। পাশাপাশি জেলার প্রধান সড়কগুলোতে সাধারণ জনগণের অপ্রয়জনীয় চলেফেলা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা  বাহিনীরপদক্ষেপ দেখা গেলেও, মহল্লাগুলোতে জন সমাগম রয়েছে। বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হলেও অলি-গলির চা স্টলগুলো খুলা হচ্ছে।

এদিকে হোম কোয়ারেন্টাইনে আসা প্রবাসফেরত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন নিয়ম মানতে বলা হলেও তাদের বেশিরভাগই মানছেন না সেই নিষেধাজ্ঞা। তবে ঢাকাসহ দেশব্যাপী হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা কাজ করছে। নির্দেশ অমান্যকারীকের বুঝিয়ে করোনা সম্পর্কে সচেতন করে ঘরে পাঠাচ্ছেন।

অবাধ্য নাগরিকদের ঘরে থাকতে বাধ্য করতে কী ধরনের কৌশল নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হোসেন রাইজিংবিডিকে জানান, এ ক্ষেত্রে আমরা মোটিভিশনকে গুরুত্ব দিচ্ছি। যারা হোম কোয়ারেন্টাইন মানছেন না, তাদের আমরা করোনা সংক্রমণ  সম্পর্কে অবহিত করছি। কারণ বাসায় থাকাই এখন এই ভাইরাস প্রতিরোধের একমাত্র উপায়।    

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের অপ্রতিরোধ্য সংক্রমণের পরও মানুষ কেন বাইরে বের হয়— এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহফুজা খানম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এটি মূলত সচেতনতার অভাব। করোনাভাইরাস সম্পূর্ণ একটি নতুন কনসেপ্ট। এ ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষ এখনও ধারণাই করতে পারছে না।কারণ আমাদের দেশে ভাইরাসটি এখন সেই অর্থে সংক্রমণ ঘটাতে পারেনি। সেজন্য মানুষ মনে করছে এ আর এমন কি। আমরা তো ভালো আছি। কিন্তু এই অজ্ঞতা আমাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।’

গ্রামের মানুষ করোনা নিয়ে একেবারেই অবেহলা করছে উল্লেখ করে সেখানে আরো বেশি প্রচার এবং ভাইরাসটির ভয়াবহতা তুলে ধরা দরকার বলে মনে করেন এই মনোবিজ্ঞানী।

‘মানুষ আসলে বুঝতে পারছে না। সেজন্য প্রচারটা সেভাবে নিতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে আমরা যেটা করছি সেটা প্রতিরোধ প্রতিকার নয়। এর কোনো ওষুধ এখনো আবিস্কৃত হয়নি। অসুখটা যাতে না ছড়ায় সেজন্য সচেতন হতে হবে।  প্রয়োজনে কড়াকড়িভাবে হলেও বাধ্যতামূলক করার পদক্ষেপ নিতে হবে’, বলেন অধ্যাপক মাহফুজা খানম।

নোট: প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ফরহাদ খান (নড়াইল প্রতিনিধি),  মুহাম্মদ নুরুজ্জামান (নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা), আবদুল্লাহ আল নোমান (নিজস্ব প্রতিবেদক,সিলেট), আরিফুল ইসলাম সাব্বির (সাভার প্রতিনিধি), শাহরিয়ার সিফাত (টাঙ্গাইল প্রতিনিধি)।

 

পারভেজ/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়