ঢাকা     সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১০ ১৪৩১

ব্রুনাই প্রবাসীদের আহাজারি

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩১, ৫ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ব্রুনাই প্রবাসীদের আহাজারি

এশিয়া মহাদেশে উন্নত দেশের তালিকায় ব্রুনাই অন্যতম। দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি কাজ করছেন। প্রতিনিয়ত বাড়ছে ওই তালিকা। বিভিন্ন সমস‌্যা সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সরকারও নানা উদ্যোগ নিচ্ছে।

সম্প্রতি প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক নেয়ার পরিকল্পনাসহ বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেছিলেন ব্রুনাইয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহমুদ হোসেন। কিন্তু হাইকমিশনের কিছু কর্মকর্তার কারণে এসব পদক্ষেপ ভেস্তে যেতে বসেছে।

ব্রুনাই হাইকমিশনের প্রথম সচিব (লেবার কাউন্সিলর) জিলাল হোসেন ও লেবার উইংয়ের কর্মকর্তা (দোভাষী) আবু নাঈমের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে উঠেছে দুর্নীতি ও শ্রমিক নির্যাতনের মতো অভিযোগ। তারা প্রবাসী শ্রমিক বা ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সুরক্ষা না করে উল্টো শোষণ করে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয় নিজেদের দুর্নীতি ও ব্যর্থতা ঢাকতে প্রবাসীদের হয়রানি করছেন। প্রবাসী মজুরি সংক্রান্ত জটিলতা কিংবা হয়রানির বিষয়ে হাইকমিশনে অভিযোগ করলে সমাধান পাওয়া যায় না- এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিবাদ করলে মিথ্যা, মানবপাচার বা চুরির মামলার আসামি হয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে অনেক শ্রমিককে।

এক হিসেবে দেখা গেছে, গত অক্টোবর ও নভেম্বরে প্রায় অর্ধশত প্রবাসী শ্রমিক ও ব্যবসায়ী দেশ ফিরতে হয়েছে মামলায় আসামি হয়ে। সম্প্রতি ভুক্তভোগী অনেক শ্রমিক লিখিতভাবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) বেশকিছু দপ্তরে অভিযোগ করেছেন বলে জানা গেছে।

এসব বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ রোববার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ব্রুনাই থেকে যাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। ব্রুনাই পররাষ্ট্র দপ্তর থেকেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ব্রুনাই হাইকমিশনের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

ভুক্তভোগীদের বক্তব্য ও নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাইকমিশনের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ করলে প্রবাসীদের পাল্টা আক্রমণ এবং নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে এমন ১৫ প্রবাসীদের পাসপোর্ট নম্বরসহ নামের তালিকা পাওয়া গেছে।  তালিকার একজন কামরুল হাসান। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাকে র্নিমম নির্যাতন শিকার হতে হয় ব্রুনাই হাইকমিশনের ভেতরেই। এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। নির্যাতনের শিকার কামরুল হাসান হাইকমিশনের দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরবর্তীতে মামলা উঠানোর জন্য হাইকমিশন থেকে ভয়ভীতি দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

২০১৮ সালের ৭ মার্চ অন্যায়ভাবে হাইকমিশন ভবনে মনির হোসেনকে নির্যাতন করা হয়। ঘুষ না দেয়া এবং অনৈতিক দাবির প্রতিবাদ করায় তাকে পিটিয়ে আহত করা হয়। এ ঘটনায় মনির হোসেন বাদী হয়ে ব্রুনাই ব্রাকাস থানায় মেডিক্যাল রিপোর্টসহ ২০১৮ সালের ৮ মার্চ মামলা করেন। মামলায় নির্যাতনের তথ্য উপাত্ত তুলে ধরা হয়। মামলা তুলে নেয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু হুমকির পরও মামলা তুলে না নেয়ায় মানবপাচারের সাজানো অভিযোগ করা হয় তা নামে। পরে তাকে জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

শুধু কামরুল আর মনিরই নয়। প্রতিনিয়নত এমনই নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে বলে ব্রুনাই ফেরত বাংলাদেশিরা জানিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে জিলাল হোসেন ও লেবার উইংয়ের কর্মকর্তা আবু নাঈম সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও অনেক প্রবাসী নিরব থাকলেও মামলা করছে না দেশে ফেরত পাঠানোর ভয়ে।

নির্যাতনের শিকার প্রবাসী ব্যবসায়ী সবুজ মির্জা এ বিষয়ে রাইজিংবিডিকে বলেন, আমাকে ৩০ অক্টোবর দেশে পাঠানো হয়েছে। ব্রুনাইতে প্রায় ১৫ বছর ধরে ব্যবসা করছি। সেখানে আমার পুরো পরিবার থাকে। আমার ৫টি দোকান ছিল। গত ২৭ অক্টোবর হঠাৎ ব্রুনাই পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, আমার বিরুদ্ধে অবৈধ মানবপাচার ব্যবসা ও ভিসা জালিয়াতির অভিযোগ করেছে বাংলাদেশি হাইকমিশন। তোমাকে দেশ ছাড়তে হবে। আমাকে দোকান থেকে তুলে নিয়ে ২৮ ও ২৯ অক্টোবর জেলে রেখে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমার লাখ লাখ ডলার লোকসান হয়েছে।

তিনি বলেন, ব্রুনাই বাংলাদেশি হাইকমিশনে লেবার কাউন্সিলার জিলাল ও তার বিশ্বস্ত সহযোগী আবু নাইমসহ কয়েকজন কর্মকর্তা এসব কাজ করছেন। আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথেও জড়িত।

মানবপাচারসহ বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে দেশে ফেরত এসেছেন এমন কয়েকজনের মধ্যে রয়েছেন আসিফ (পাসপোর্ট নম্বর: BF0789466), শাহেদ মজুমদার মুন্না (পাসপোর্ট নম্বর: BN0490212), জাকির হোসেন (পাসপোর্ট নম্বর: BM0421821), জসিম সরকার (পাসপোর্ট নম্বর: BR0773460), সোহরাব খান (পাসপোর্ট নম্বর: BJ0737818), মো. মেহেদী হাসান (পাসপোর্ট নম্বর: BR0671958), মো. মনির হোসেন, আব্দুর রহিম (পাসপোর্ট নম্বর: BR0191506), মো. ইসমাইল সরদার (পাসপোর্ট নম্বর: BM0193277), জাজ মিয়া, সবুজ মির্জা, কামরুল হাসান (পাসপোর্ট নম্বর: BP0121477) এবং মো. আনোয়ার হোসেন (পাসপোর্ট নম্বর: BF0582969)।

গত নভেম্বরে ফেরত এসেছে ময়মনসিংহের জাজ মিয়া। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, গত নভেম্বর আমাকে চুরির মামলা দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ করে ব্রুনাই গিয়েছিলাম। নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতাম। হঠাৎ একদিন এজেন্ট খোরশেদ লোক পাঠিয়ে বলে তোমার নামে চুরির মামলা আছে। তোমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে। আমি আগে ও পরে কিছু জানি না। অথচ মিথ্যা মামলা দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিল খোরশেদ। এই খোরশেদ হাইকমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তার বিশ্বস্ত এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। তার নামে ৪ থেকে পাঁচটি লাইসেন্স রয়েছে।

তিনি বলেন, আমি শুনেছি গত বেশ কিছুদিন ধরে ব্রুনাই থেকে মানবপাচার ও চুরির মামলা দিয়ে হয়রানি করে দেশে ফিরে এসেছে অনেক বাংলাদেশি। আমাদের সাথে যে অন্যায় হয়েছে। আমি বিচার চাই।

একই অভিযোগ পাওয়া গেছে অন্যান্য প্রবাসীদের কাছ থেকে। নির্যাতিত শ্রমিকদের আরো অভিযোগ, ব্রুনাই প্রবাসী শ্রমিকরা বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করলেও কোন কারণে বেতন ভাতাসহ বিভিন্ন বকেয়া না পেয়ে অভিযোগ করে হাইকমিশনের কাউন্সিলরের (শ্রম) কাছে। ওই সময় সুযোগ বুঝে কাউন্সিলরের সিন্ডিকেটের আবু নাঈম কৌশলে অভিযুক্ত কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং বিভিন্ন মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করে নেয়। কিন্তু ভুক্তভোগী অধিকাংশ শ্রমিকরা কোম্পানি থেকে পাওনা টাকা তারা হাতে বুঝে পায় না। সেই টাকা ভাগ করে নেন জিলাল হোসেন ও আবু নাঈম সিন্ডিকেট।

অভিযোগ রয়েছে, হাইকমিশনের ওই সিন্ডিকেট সরকার নির্ধারিত ভিসা সত্যায়িত ফি ১৫ ডলার পরিবর্তে ৫০০ ডলার থেকে ৬০০ ডলার করে নেয়। এ বিষয়ে শ্রমিক ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার জন্য ব্রুনাই হাইকমিশনের কর্মীদের ভিসা ছাড়পত্রের আবেদন করার পর থেকেই চলে ঘুষের জন্য চাপ সৃষ্টি। কর্মী প্রতি ছাড়পত্রের জন্য ব্রুনাই ১৫ ডলার দেয়ার নিয়ম থাকলেও ওই সিন্ডিকেট কর্মী প্রতি ছাড়পত্রে ৫০০ থেকে ৬০০ ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে। কেউ ছাড়পত্রের জন্য টাকা কম দিতে চাইলে কিংবা বেশি টাকা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলে লেবার কাউন্সিলর ছাড়পত্র দেয় না, কিংবা তার ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করে দেয়া হয়। ছাড়পত্রের জন্য টাকা না দিয়ে প্রতিবাদ করায় কোম্পানিকে ব্ল্যাকলিষ্ট করাসহ নানাভাবে বিতর্কিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় জিলাল ও আবু নাঈম সিন্ডিকেট কয়েক বছরের ব্যবধানে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ বলা হয়েছে।

এছাড়া হাইকমিশনের ওই সিন্ডিকেট দিয়ে জনশক্তির ব্যবসাও করা হচ্ছে। নির্ধারিত এজেন্ট মোরশেদ আলম শাহীন, শাহজালাল মাসুদ, মো. রতন, মো. আব্দুল্লাহ, ফারুক সরকারসহ একটি সিন্ডিকেটকে হাতে নিয়ে নিজেরাই জনশক্তি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন জিলাল। সরকারিভাবে কর্মী পাঠাতে পারে সরকারি প্রতিষ্ঠান বোয়েসেল কিংবা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিক্রুটিং এজেন্সির লোকজন। কিন্তু জিলাল হোসেন বাংলাদেশ থেকে নিজেই কর্মী পাঠানোর ব্যবসা করছেন। জনপ্রতি হাতিয়ে নিচ্ছেন ৩ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। বিশেষ করে লেবার উইংয়ের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক (Labour Wing Brunei) ব্যবহার করে কর্মী পাঠানোর বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছেন কাউন্সিলর নিজেই।

হয়রানি থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করতে উৎসাহি ব্রুনাই নাগরিকও। তাদের ভিসার জন্য ঘুষ দিতে হয়। কেউ কেউ ভিসার আবেদন করে পাসপোর্টে ভিসার স্টিকার দেয়া হলেও ঘুষ না দেয়ায় ভিসা তাৎক্ষণিক বাতিল করার ঘটনাও ঘটছে।

ব্রুনাই ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য মতে, মাত্র ২২৮ জন কর্মী পাঠানোর মধ্য দিয়ে ১৯৯২ সালে ব্রুনাই বাংলাদেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হয়। ব্রুনাইস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্য মতে, দেশটিতে বর্তমানে ৩০ হাজারের মতো বাংলাদেশি রয়েছে। যাদের বেশির ভাগই নির্মাণ খাতে কর্মরত।


ঢাকা/এম এ রহমান/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়