মাদকাসক্ত ভাইকে হত্যা: সাজা চায় না পরিবার
মাদকের থাবায় সৈয়দ আব্দুস সালামের পরিবারে নেমে আসে কালো ছায়া। ৬ ছেলের মধ্যে এক ছেলে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। আর তাতেই ঘটে পরিবারে নানা ঘটনা।
নেশাগ্রস্ত ছেলে টাকার জন্য বাবার শরীরে হাত তুলতে দ্বিধা করতো না। ৯৫ বছরের বৃদ্ধ বাবার ওপর এমন নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে পারতো না অন্য ছেলেরা। ঘটনাচক্রে বাবাকে রক্ষা করতে গিয়ে অন্য দুই ছেলের হাতে খুন হন মাদকাসক্ত সৈয়দ আবদুল আলা।
ভাই হত্যার অভিযোগে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় সৈয়দ মোহাম্মদ আলী মিঠু এবং সৈয়দ মুসা মনিকে। কিন্তু তাদের পরিবারের দাবি, এটা ইচ্ছাকৃত খুন নয়, অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা। তাই অভিযুক্তদের সাজা চান না পরিবারের সদস্যরা।
মাদকাসক্ত বড় ছেলে আবদুল আলাকে হত্যার অভিযোগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বাবা সৈয়দ আব্দুস সালাম (৮৯) বাড্ডা থানায় মামলা করেন। ঘটনার ৩ মাস ৬দিন পর গত ১ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাড্ডা থানার এসআই আব্দুল মান্নাফ ছোট দুই ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ আলী মিঠু এবং সৈয়দ মুসা মনিকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন। আগামী ১৯ জুলাই মামলার তারিখ ধার্য রয়েছে।
মামলা সম্পর্কে বড় ভাই সৈয়দ আবুল কালাম বলেন, এই ঘটনা একটা দুর্ঘটনা। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটনাটি ঘটাতে চাইনি। আমরা কেউ তাদের সাজা চাই না। বাবাকে এভাবে মারলে কোনো সন্তান চুপ থাকতে পারে। তারা না থাকলে তো বাবাকে হারাতে হতো। আল্লাহ বাঁচালে তারা বেঁচে যাবে। আল্লাহর ভরসায় আছি। না হলে জেল হলে হবে। তবে আমরা কেউ তাদের সাজা চাই না।’
এদিকে, আবদুস সালামের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়, ৬ ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে আবদুল আলা, মোহাম্মদ আলী মিঠু এবং মুসা মনিকে নিয়ে দক্ষিণ বাড্ডায় বাস করেন। অন্য ছেলে-মেয়েরা অন্যত্র বাস করেন। বৃদ্ধ হওয়ায় তার কোনো আয়ের উৎস নেই। তার ওই তিন ছেলেও কোনো কাজকর্ম করে না। অন্য ছেলে-মেয়ের টাকায় সংসার চলে তাদের। আব্দুল আলা অনেক আগে থেকেই মাদক সেবন করে। নেশার পথ থেকে ফেরানোর অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় পরিবার। নেশার টাকার জন্য মাঝে মধ্যে পরিবারের সদস্যদের ওপর নির্যাতন করতো। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে আবদুল আলা তার কাছে চায়।
তিনি বলেন, তার কাছে টাকা নাই, কোনো টাকা তাকে দিতে পারবেন না। তখন সে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে মারপিট করে। তখন তার অন্য দুই ছেলে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। তখন সে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং দা দিয়ে তাদের মারতে চেষ্টা হয়। তখন তার দুই ছেলে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। এতে আলা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। তখন বাবাকে বাঁচাতে মিঠু তার হাতে থাকা গামছা দিয়ে আলার গলা পেঁচিয়ে ধরে এবং মনি একটি কাঠের লাঠি দিয়ে আলার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলা নিস্তেজ হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। পরে তার মৃত্যু হয়।
মামলার পরই তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২৫ ফেব্রুয়ারি দুই ভাই হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেয়।
জবানবন্দিতে মুসা মনির বলেন, ‘বড় ভাই আলা সব সময় নেশাগ্রস্ত থাকতো। ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ১০টায় বাবার কাছে নেশার জন্য টাকা চাই। বাবাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর দা দিয়ে বাবাকে জবাই করার জন্য ধরে। তখন তারা দুই ভাই লাঠি দিয়ে আঘাত করে এবং গলায় গামছা পেঁচিয়ে তাকে হত্যা করে।’
মিঠু জানায়, ‘আলা প্রচুর নেশা করতো। বাবা, বোনকে মারধর করতো। ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৯টায় বোনের কাছে এক লাখ টাকা দাবি করে। বোন এর প্রতিবাদ করে। চেঁচামেচি শুনে তার বাবা দৌড়ে আসে। আলা বাবাকে ধাক্কা মারে। দা দিয়ে তাকে কোপ মারতে আসে। তাকে ফেলে দেয়। এ সময় তার গলায় গামছা ছিল। তা টান দিয়ে ধরে। আরেক ভাই গামছার অপর পাশ টান দেয়। তখন আলা নিস্তেজ হয়ে যায়। এরপর তারা পালিয়ে যান।’
মামলা সম্পর্কে আসামিপক্ষের আইনজীবী একেএম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘পিতাকে মারধর করা সহ্য করতে পারে না কোনো ছেলেই। পিতাকে রক্ষা করতে গিয়ে এবং নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য সেদিন ঘটনাটা ঘটে যায়। মাদকাসক্ত আলা নেশার টাকার জন্য সবাইকে মারধর, হুমকি-ধামকি দিতো। তাছাড়া ঘটনাটি ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটায়নি। আশা করছি, আদালত বিষয়টি মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে বিচার করবেন। আর বিচারে আসামিরা খালাস পাবেন।‘
এদিক, মামলায় দুই ভাইকে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশ ২০ হাজার টাকা মুচলেকায় চার্জশিট দাখিল পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করেন। জামিন শুনানির দিন মামলার বাদী আবদুস সালাম আদালতে হাজির হন। তিনি সেদিন আদালতকে বলেন, তার দুই ছেলে নির্দোষ। নিহত আলা তার কাছে নেশার জন্য টাকা চাইতো। না দিলে মারধর করতো। শুধু তাকে না সবাইকে মারধর করতো আলা। সেদিনও টাকা না দেওয়ায় তাকে মারধর করেন। তাকে বাঁচাতে দুই ছেলে এগিয়ে আসে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ঘটনাটি ঘটে যায়। তার দুই ছেলে ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটনা ঘটায়নি। তাই তাদের মুক্তি চান আবদুস সালাম। পরে আদালতে তাদের জামিনের আদেশ দেন।
/মামুন/এসবি/