মৃতের সংখ্যা জানতে চাইলে বলা হয়েছিল ‘এখনো গোনা শেষ হয়নি’
রাজন ভট্টাচার্য || রাইজিংবিডি.কম
আবুল ফারুক
নায়েক আবুল ফারুক তখন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালরাত্রির অনেক স্মৃতি এখনও মনে আছে তাঁর। যদিও বার্ধক্যজনিত কারণে কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল। সেদিন রাতে রাজারবাগে হামলা হলে তিনি প্রতিরোধ করেছিলেন। প্রতিপক্ষের দিকে চোখ বন্ধ করে গুলি চালিয়েছেন। প্রতিজ্ঞা ছিল- পাঞ্জাবীদের একচুলও ছাড় নয়!
মুক্তিযুদ্ধের সময় আবুল ফারুকের বয়স ৩২। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় প্রথম আক্রমণ করে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে। সেই রাতে ব্যারাকে ঘুমাচ্ছিলেন তিনিসহ অনেকেই। পাকসেনাদের হামলার সময় মানুষের চিৎকার ও পাগলা ঘণ্টার শব্দে ঘুম ভাঙে তাদের। সবাই প্রতিরোধের জন্য তৈরি হন দ্রুত পদক্ষেপে। দৌড়ে অস্ত্রাগার থেকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে তিনিসহ সহকর্মী ছালাম, জাহাঙ্গীরসহ কয়েকজন পুলিশ লাইনের রেশন গেট এলাকায় অবস্থান নেন।
তখন পুরো এলাকা কাঁপছিল পাকসেনাদের অস্ত্রের দাপটে। আবুল ফারুক বলেন, ‘দূর থেকে দেখলাম আর্মিরা গুলি করতে করতে সামনের দিকে আসছে। ওরা গেটের কাছে আসার পর আমরা আক্রমণ শুরু করি। চোখ বন্ধ করে গুলি চালিয়েছিলাম। ১০টি গুলির বেশি থ্রি নট থ্রি রাইফেলে ভরা যেত না। অল্প সময়ের মধ্যে গুলি শেষ হয়ে যেত। আবারও ভরতাম।’
‘এক পর্যায়ে রাজারবাগের টিনশেড ভবনে ওরা গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে আমরা ভয় পাই। সবাই জীবন বাঁচাতে ছুটতে থাকি। দীর্ঘ সময় চলে যুদ্ধ। আগুন দেয়ার পর মসজিদের দিকে যাই। সেখানেও আগুন দেখে ফ্যামেলি কোয়ার্টারের দিকে ছুটতে থাকি। সেখানেও অস্ত্রাগারের সামনে শক্তিশালী বোমা ছোড়ে পাকসেনারা। সবাই আতঙ্কিত তখন।’
বিভীষিকার সেই কালরাত্রির স্মৃতিচারণের সময় আবুল ফারুকের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ দেখতে পাই পুলিশ ব্যারাকের সামনের মাঠে নিহত পুলিশ সদস্য, সাধারণ মানুষ ও বাবুর্চিদের লাশ এনে জড়ো করছে পাঞ্জাবীরা। এমন পরিস্থিতিতে ভোরের আগে আগে দেয়ালের ওপর তারকাটার বেড়া ডিঙ্গিয়ে কোনো রকমে পালাই। সেখান থেকে চামেলীবাগ পুলিশের রিজার্ভ অফিসে গিয়ে দেখি লোক নেই। পোশাক খুলে স্থানীয় একজনের দেওয়া ছেঁড়া জামা ও লুঙ্গি পরি। অস্ত্র ফেলে সেগুনবাগিচা হয়ে আলাউদ্দিন রোড দিয়ে হাজারো মানুষের ভিড়ে মিশে যাই। তাদের সঙ্গে লাইনে হাঁটতে থাকি। অনিশ্চিত গন্তব্য। হাতে টাকা নেই। রাস্তায় রাস্তায় মানুষের দেয়া খাবার খেতাম। তখন বড়লোকরা খুব একটা এগিয়ে আসেনি। সাধারণ ও গরিব মানুষই বেশি সহযোগিতা করেছে। হেঁটে আটদিন পর মুন্সীগঞ্জ পৌঁছে যাই।’
‘হেলালসহ আরও দুই সিপাহী আমার সঙ্গে ছিলেন। নদীর মাঝিকে গিয়ে বললাম- আমরা তিনজন বিপদে পড়েছি। তিন আনাও হাতে নেই। আমাদের পার করে দাও। মন গলল মাঝির। বললো সব মাপ। টাকা লাগবে না। তিনি আমাদের নদী পার করে বেলতলী উঠিয়ে দিলেন।’
সেই মাঝির কথা এখনও ভুলতে পারেননি ফারুক। হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি। সময় নেন নিজেকে সামলে নিতে। বলেন, ‘মাঝির দেনা শোধ করা হলো না। পরে আর দেখাও হলো না তাঁর সঙ্গে। কানে বারবার ধ্বনিত হয় ‘মাপ’ শব্দটি। তারপর আবারও হাঁটাপথ। পায়ে হেঁটেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার জমশেদপুরে গ্রামের বাড়িতে চলে আসি।’
এবার ভিন্ন রকম বিপদ আবুল ফারুকসহ গ্রামবাসীর। স্থানীয় রাজাকাররা প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুললো। আক্রমণ করলো তারা। অনেকেই ভয় পেলেন। সাহসী মানুষদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন আবুল ফারুক। তিনি বলেন, ‘একদিন গণপিটুনিতে ছয়জন রাজাকারকে হত্যা করেছিলাম। এরপর কিছুদিন বাড়িতে থাকার পর ভারতের কৃষ্ণনগরে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে চলে যাই। সেখানের পুলিশ কর্মকর্তা এম আই তালুকদার আমাদের জিজ্ঞেস করলেন- যুদ্ধে যাব কিনা? সবাই রাজি। আমরা এক প্লাটুন লোক ট্রেনিং শেষে এক নম্বর সেক্টরে যোগ দেই। জুন-জুলাই মাসে নোয়াখালীর বেলুনিয়াসহ আশপাশের এলাকায় যুদ্ধ করি। নভেম্বর মাসে ফেনী নদীর ওপর ঝুলন্ত ব্রিজ রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমাদের এলাকায় পাকবাহিনীকে খুব একটা প্রবেশ করতে দেইনি। এই এলাকা কার্যত মুক্ত ছিল।’
যুদ্ধ শেষে আবুল ফারুক চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে অস্ত্র জমা দেন ১৯৭২ সালেল জানুয়ারি মাসে। ২১ জানুয়ারি ঘোষণা আসে ১০ দিন ছুটি শেষে পুলিশে যোগ দেওয়ার। ফেব্রুয়ারিতে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে ইন্সপেক্টর পদে অবসরে যান এই বীরসেনা।
যুদ্ধের সময় বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন আবুল ফারুক। বিশেষ ঘটনা হিসেবে তিনি বলেন, ‘ছাগলনাইয়া এলাকার ফরিমাটিলা এলাকায় একবার সাধারণ মানুষের ওপর পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচার চলছিল। মানুষের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে উঠছিল আকাশ বাতাস। বাঁচার আকুতি করছিলেন অনেকে। তখন পাষণ্ডরা হাসছিল। এসব দেখে সহ্য করতে পারিনি। গোয়েন্দাগিরির সময় এ চিত্র চোখে পড়ে। একা চললেও শরীরে অস্ত্র লুকিয়ে রাখতাম। এক পর্যায়ে পাকিস্তানিদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করি। বুলেট দিয়ে ওদের ঝাঁজরা করে দেই। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলাম সেদিন।’
‘শহীদ পুলিশের রক্তের ঋণ’ বইয়ে উল্লেখ আছে: ‘সেদিন আটশ পাকসেনা পুলিশ লাইনস আক্রমণ করে। রাজারবাগে পুলিশেরা প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে থ্রি নট থ্রি দিয়ে। এ সময় পাকবাহিনী একটু থমকে গেলেও ট্যাংক, মর্টার ও হেভি মেশিনগান নিয়ে গুলিবর্ষণ করে পুলিশ সদস্যদের হত্যা করতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের গুলি শেষ হয়ে গেলে জীবিত পুলিশ সদস্যরা যে যেভাবে পারে পালিয়ে যায়।’
অভিযান শেষে পরদিন ভোরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণকক্ষ যখন ওয়্যারলেস বার্তায় রাজারবাগে পুলিশের মৃতের সংখ্যা জানতে চাইছিল, তখন বলা হয়, এখনো গোনা শেষ হয়নি। তবে সংখ্যা অনেক।
প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায় ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ৩৩ হাজার ৯৯৫ জন পুলিশের মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার সদস্য কর্মস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ১১শ জনেরও বেশি পুলিশ সদস্য।
/তারা/