‘ওরা বাবাকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়’
আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম
‘১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ, ভোর সাড়ে ৬টা। একদল পাকসেনা আসে আমাদের দোতলার বাড়িতে। উর্দুতে বাবাকে ডাক দেয়। বাবা দরজা খুলে দাঁড়ান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা বাবার হাত বেঁধে ফেলে। শুরু হয় ধ্বংসলীলা। মুহূর্তে ঘরের সবকিছু তছনছ করে ফেলে। এরপর শুরু করে নির্মম হত্যাযজ্ঞ।’
বলছিলেন সর্বজন পরিচিত মধুসুদন দে’র (মধুদা) ছেলে, বর্তমান মধুর ক্যান্টিনের কর্ণধার অরুণ কুমার দে। রাইজিংবিডির পক্ষ থেকে জানতে চাই সেদিনের নৃশংসতার করুণ কাহিনী।
অরুণ বলেন, ‘২৫ মার্চ রাত ১১টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় হানাদারবাহিনী জড়ো হতে থাকে। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। এক গ্রুপ যায় জগন্নাথ হলে, এক গ্রুপ যায় জহুরুল হক হলে, এক গ্রুপ এস এম হলে, আরেক গ্রুপ রোকেয়া, শামসুন্নাহার হলের দিকে চলে যায়। ১২টার দিকে তারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। আমরা তখন ঘুমাচ্ছিলাম। প্রথম দিকে কম গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। পরে ধীরে ধীরে সেই বিভীষিকাময় শব্দ বাড়তে থাকে। আশপাশে শোনা যাচ্ছিল আর্তনাদ। ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’ চিৎকার ভেসে আসছিল রাতের স্তব্ধতা ভেদ করে। কর্মচারীদের ঘরগুলো আগুনে জ্বলছিল।’
খুবই কষ্টের বিষয়, সেদিন রাতে আপনাদের বাসায় হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এমন একটি মর্মন্তুদ ঘটনার সাক্ষী আপনি। অরুণ কুমার দে’র কাছে জানতে চাই সেদিনের বিস্তারিত। তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের দিকে যেতে জগন্নাথ হলের বিপরীত পাশে হাতের বামে ৪ তলা ভবনের দোতলায় থাকতাম আমরা। আমার বাবা-মা, বড় ভাই, বউদিসহ ১১ জন বাসায় ছিলাম। জগন্নাথ হলের বর্তমান যে সীমানা দেয়াল তখন ছিল না। আমরা গুলির শব্দ শুনছিলাম। ২৬ মার্চ ভোরে আমাদের ভবনের সামনে মেইন রোডে পাকসেনাদের আট-দশটা গাড়ি এসে থামে। সেনাদের একটা গ্রুপ গোবিন্দচন্দ্র দেবের (জিসি দেব) বাংলোর দিকে চলে যায়। আরেকটা গ্রুপ আসে আমাদের বাসায়। আরেকটা গ্রুপ চলে যায় শিব মন্দিরের দিকে।’
‘তারপর…’
‘আমাদের বাসার নিচে এসে ওরা বাবার কথা জানতে চাইছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ তোতা মিয়া। সে ড্রাইভারের চাকরি করতো। সে তখন বাসা দেখিয়ে দিয়েছিল। এরপর তারা দোতলায় এসে দরজায় আঘাত করতে থাকে। দরজা খুলে দিলে জানতে চায় বাবা কোথায়?’
‘বাবা তখন চার তলায় ছিলেন। বলার সঙ্গে সঙ্গে তারা সেখানে চলে যায়। উর্দুতে তারা কথা বলছিল। বাবা দরজা খুলে দিলে তারা বাবাকে ঘিরে ধরে। বাবার হাত বেঁধে পাশের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। সেখানে চারদিক থেকে বাবাকে ঘিরে দাঁড়ায় ওরা। বাবা হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর আমাদের ঘরে আসে একজন হানাদার। সে বাসা তছনছ করে ফেলে। বাকিরা তখন গেটের সামনে অপেক্ষা করছিল।’
অরুণ কুমার দে
‘আমার বড়দা রণজিৎ কুমার দে নতুন বিয়ে করেছেন। বউদি রীনা রানী দে পাশের রুমে ছিলেন। ওই সৈন্যটি বউদিকে ধরতে যায়। বউদি ছুটোছুটি শুরু করেন। আমার বোন তখন গিয়ে বড়দাকে ডাক দেয়। বড়দা এসেই যখন ‘হাত তোলো, হাত তোলো’ বলতে বলতে সৈন্যটির দিকে এগিয়ে যেতে তাকে তখন সৈন্যটি বড়দার বুক লক্ষ্য করে গুলি করে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। আর্তনাদ করে বউদি লুটিয়ে পড়লে সৈন্যটি ওই অবস্থায় বৌদিকেও গুলি করে। বড়দা-বৌদি ঘটনাস্থলেই মারা যান।’
আপনার বাবা তখনও কি বেঁচে ছিলেন? বিমর্ষ কণ্ঠে প্রশ্ন করতেই অরুণ বলেন, ‘হ্যাঁ। ওই সৈন্যটিই পরে বাবাকে মারতে উদ্যত হয়। তখন মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘আমার তো সবই শেষ করে দিলে। আমার স্বামীকে মেরো না।’ তখন ওই অবস্থায় মায়ের সমস্ত শরীর গুলি করে ঝাজরা করে দেয় হানাদারের দল। ওরা খুবই নৃশংসভাবে মাকে হত্যা করে। এ সময় দুটো গুলি বাবার পায়ে লাগে। পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বাবাকে রেখে ওরা সবাই চলে যায়।’
‘তারও এক ঘণ্টা পর দুজন বাঙালিকে নিয়ে ওরা ফিরে আসে। লাশগুলো সরিয়ে নিয়ে আহত অবস্থায় বাবাকে নিয়ে যায়। আমি ওদের পায়ে ধরে অনেক কাকুতি-মিনতি করেও বাবাকে বাঁচাতে পারিনি।’
বাঙালি ওই দুজনকে আপনি চিনতেন? প্রশ্ন রাখি এই শহিদ সন্তানের কাছে। অরুণ কুমার দে মাথা নেড়ে সায় দেন। ‘তারা ভিসির বাসার মালি ছিল। তাদের দিয়েই হানাদার বাহিনী সারারাত কাজ করিয়েছে। মানে লাশগুলো জড়ো করিয়েছে। তারা বাধ্য হয়ে হুকুম তামিল করেছে। পরে তাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। যদিও এখন কেউই বেঁচে নেই।’
‘ওরা আপনার বাবাকে কোথায় নিয়ে যায়?’
‘ওরা বাবাকে জগন্নাথ হলের মাঠে নিয়ে যায়। ওদিকে জগন্নাথ হল বাংলো থেকে নিয়ে আসে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র (জিসি) দেবকে। তিনিও গুলিবিদ্ধ ছিলেন। বাবা ও জিসি দেবসহ ছাত্র-শিক্ষকদের এক লাইনে দাঁড় করায় ওরা। তারপর সবাইকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে ওখানেই মাটি খুঁড়ে চাপা দেয়।’
‘এই হত্যাকাণ্ডের পর বাসায় দুদিন ছিলাম। পরে আমরা চলে যাই দেশের বাড়ি বিক্রমপুরে। ওখানে আমার বড় বোন আর জামাইবাবু ছিল। সেখানে গিয়েও রাজাকারদের জ্বালায় শান্তিতে থাকতে পারিনি। পরে রাতের অন্ধকারে ভারত চলে যাই। সেখানে ত্রিপুরায় উঠি। ক্যাম্পে ছিলাম কিছু দিন। তারপর আত্মীয়দের বাড়িতে। এভাবে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত ছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে আসি। নতুন করে দায়িত্ব নেই মধুর ক্যান্টিনের।’
প্রসঙ্গত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন ১৯২১ সাল থেকেই মধুর ক্যান্টিনের যাত্রা শুরু। সে সময় আদিত্য চন্দ্র দে (মধুদার পিতা) এ ক্যান্টিন চালু করেন। তার মৃত্যুর পর ক্যান্টিনের দায়িত্ব নেন মধুদা। বর্তমানে এর দায়িত্বে আছেন অরুণ কুমার দে।
/তারা/