বঞ্চিত শৈশবে চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়া জীবন, প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ
আরিফুর রহমান (৮)। জন্ম গাজীপুরের কালিয়াকৈরে। গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় চাকরির সুবাদে ওর বাবা-মায়ের পরিচয়, বিয়ে। আরিফ জন্মানোর ছয় বছর পর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। ছেলেটি মায়ের সঙ্গেই ছিল। পরে মায়ের অন্যত্র বিয়ের কারণে সঙ্গীহীন হয়ে পড়ে আরিফ। এরপর নানাভাবে নিয়তি তাকে নামিয়ে আনে পথের জীবনে।
নিজের সম্পর্কে বলছিল আরিফ। তবে পোড়া চোখের সেই জবানবন্দিতে না ছিল কান্না, না ছিল কোনো অনুভূতি। এমন সরল স্বীকারোক্তিই ওকে দিয়েছে রাস্তায় জীবন কাটানোর শক্তি।
আরেক পথশিশু মাসুম (৯)। বাবা-মায়ের চেহারা মনে নেই। দাদির সঙ্গে ছিল মাদারীপুর। একদিন ট্রাকে চেপে চলে আসে ঢাকা। পরে জুটে যায় অনেক বন্ধুবান্ধব। সবার সঙ্গে দিনে প্লাস্টিক কুড়ায় ফকিরাপুল এলাকায়। রাতে ঘুমায় কমলাপুর। মাসুম বলে, অনেকেই থাকি একসঙ্গে। সবাই মিলে খাই, একসঙ্গে ঘুমাই। সবাই সবাইরে ভালো পায় (ভালোবাসে)। তাই, আমাগো কেউরেই (আপনজন) লাগে না।
এমন লাখো গল্প ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজধানীর রাজপথে। জরাজীর্ণ হয়ে পড়া সেসব জীবনের গল্পগুলো হৃদয়বিদারক। লাখো পথশিশু প্রত্যেকেই যেন একেকটি প্রামাণ্য বাস্তবতা। ওদের জীবন যেন রংহীন রংধনু। জীবনের সেই গল্পগুলোর নাম নেই, তালিকা নেই, হিসেব নেই। হয়তো বঞ্চিত শৈশবেই অন্ধকার চোরাবালিতে একদিন তলিয়ে যাবে সেই গল্পগুলো।
বাংলাদেশে পথশিশুদের প্রকৃত সংখ্যা বর্তমানে কতো, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক রয়েছে। যেসব পরিসংখ্যান প্রকাশ হয়েছে, তা নিয়েও মতভেদ রয়েছে। বাংলাদেশের জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এ ভাসমান শিশুদের কোনো সংখ্যা উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক কোনো পরিসংখ্যানও নেই। তাই, পথশিশুদের সঠিক সংখ্যা আজও নিরূপণ করা যায়নি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) (২০১৫) এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে পথশিশুদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ। আর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ঢাকাতেই ছয় লাখ পথশিশু রয়েছে। দেশের জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর রাস্তায়ও বেড়েছে পথশিশুর সংখ্যা। এছাড়া ইউনিসেফের এক গবেষণার বরাতে দেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সাম্প্রতিক খবর বলছে, বাংলাদেশে ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ জন পথশিশু রয়েছে। কেবল ঢাকা শহরে রয়েছে সাত লাখ পথশিশু।
শহরের ভাসমান শিশুদের নিয়ে করা বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, পথে জীবন কাটানো শিশুদের গড় বয়স ৪-১২ বছর। এরপর অর্থাৎ ১৩-১৪ বছর বয়স পেরুলেই পথশিশুরা কুলি, হকার, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, মাদকবাহকে পরিণত হয়। পথে থাকাকালে এসব শিশুরা খুব অল্প বয়সে শিশুসুলভ মনোভাব হারায়। বিভিন্ন নেশাদ্রব্যে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। বিকৃত আচরণ করতে শেখে। কর্কশ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়। মারমুখী আচরণ করে। স্বাভাবিক জীবনযাপনে মেলামেশার অধিকার নেই বলে এরা অপরাধ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
সরেজমিন অনুসন্ধান ও পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি-সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পথশিশুদের মূল সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে খাদ্য চাহিদা পূরণ না হওয়া, অস্বাস্থ্যকর বসবাস ও পয়ঃনিষ্কাশন শূন্যতা, চিকিৎসাহীন জীবনব্যবস্থা, অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণ, নেশাদ্রব্যে আকৃষ্ট হওয়াসহ আরো অনেক কিছু। এমনকি পথশিশুদের কোনো জন্ম নিবন্ধনও নেই। শিশু অধিকার তো পরের কথা, মৌলিক প্রয়োজন থেকেই বঞ্চিত ওরা।
পথশিশুদের জন্ম নিবন্ধন না থাকাটা একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। জন্ম নিবন্ধন না থাকাতে তারা এ দেশের নাগরিক হিসেবে প্রমাণিত হয় না। একটি শিশু কোনো অপরাধ করলেও তাকে ধরা যায় না। সমাজকর্মী বা স্বেচ্ছাসেবীরা কোনো শিশুকে স্কুলে ভর্তি করতে চাইলেও পারে না জন্ম নিবন্ধন না থাকায়। নানা জটিলতায় পথশিশুদের জন্ম নিবন্ধন করা যায় না। এসব শিশুরা বাবা-মায়ের নাম বলতে পারে না। স্থায়ী ঠিকানা দিতে পারে না। জন্মের পরে হাসপাতাল থেকে দেওয়া কোনো টিকা কার্ড থাকে না। তার ওপর পথশিশুরা এ বিষয়ে আগ্রহীও না।
ওদের নিয়ে ভাবছে সমাজ, সরকার, বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও এনজিও। দেশে শিশুবান্ধব নানা কর্মসূচিও আছে। তবুও ছিন্নমূল শিশুর সংখ্যা বেড়েই চলছে উদ্বেগজনক হারে। সরকারের উদ্যোগ, এনজিওর কার্যক্রম সবই দিনশেষে বৃথা মনে হবে, বাস্তব চিত্র দেখলে। কিন্তু কেন ব্যাহত হয় সেসব উদ্যোগ? জানতে চাইলে লোকাল এডুকেশন এন্ড ইকোনোমিক ডেভলভমেন্ট অরগানাইজেশনের (লিডো) তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম বলেন, পথশিশুদের নিয়ে নানা কার্যক্রম চালু থাকার পরেও এ অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ- কাজ করা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা এবং সঠিক রূপরেখা না থাকা। দেখা যায়, যেসব প্রতিষ্ঠান মাঠে আছে, তারা অধিকাংশই পথের শিশুটিকে নিয়েই কাজ করছে। শিশুদের সাপোর্ট দিচ্ছে, খাবার দিচ্ছে, থাকার জায়গা দিচ্ছে, পড়াচ্ছে। কিন্তু, শিশুটি পথে নামার কারণ অনুসন্ধান হচ্ছে খুব কম।
সমস্যা উত্তরণের স্থায়ী সমাধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসলে যতদিন শিশুদের পথে আসার কারণ থাকবে, সুযোগ থাকবে, ততদিন এ সমস্যার সমাধান হবে না। শিশুরা যেন পথে না আসে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। পথে নামার কারণ হিসেবে দায়ী সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। এমন সমস্যা সৃষ্টির উৎস থেকে বন্ধ করতে হবে। শিশুদের পরিবারকে শনাক্ত করে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করতে হবে। হয়তো কিছু সঠিক সিদ্ধান্তই পারবে, শিশুদের এমন অমানবিক জীবনের অবসান ঘটাতে।
স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ বছরেরও বেশি। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থার মেরুকরণ ঘটেছে। দেশ উন্নয়নশীল হয়েছে। উন্নত হয়েছে অবকাঠামো আর রাষ্ট্রব্যবস্থা। এত অগ্রযাত্রার ভিড়ে আজও পথে অমানবিক জীবন কাটাচ্ছে শিশুরা। এমন পরিস্থিতির মূল কারণ কী? প্রশ্ন ছিল পথশিুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘পথের ইসকুল’ এর প্রতিষ্ঠাতা শাকিল ইব্রাহীম মাটির কাছে।
শাকিল ইব্রাহীম মনে করেন, দেশের শিক্ষাহীন শ্রেণির অজ্ঞতা, জন্ম নিয়ন্ত্রণে অসচেতনতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল সম্পর্কে না জানা, অবৈধ যৌনাচার, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, পারিবারিক খাদ্যাভাবসহ নানা কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে উদ্বাস্তু শিশু। পাশাপাশি ইদানীং দেখা যাচ্ছে আবাসিক মাদরাসা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত চাপের কারণেও শিশুরা পালিয়ে পথে চলে আসে স্বাধীনতার ইচ্ছায়।
এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে করণীয় কী? জানতে চাইলে শাকিল মাটি বলেন, প্রথমে সব শ্রেণির মানুষকে সচেতন করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে, নতুন করে আর একটি শিশুরও স্থান যেন পথে না হয়। আর যেসব শিশুরা এরই মধ্যে পথকে আপন করে নিয়েছে, তাদেরকে পরিকল্পনামাফিক সঠিক অবস্থানে ফেরাতে হবে। এসব শিশুদের বাবা-মা কিংবা আত্মীয়-স্বজনের আশ্রয়ে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি যে কটি শিশু সেবা কেন্দ্র আছে তা শিশুবান্ধব করতে হবে। শিশু সাপোর্ট সেন্টারে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে এসব শিশুদের মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করাও জরুরি।
তিনি বলেন, পথশিশুদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ না নিলে এ সমস্যা দূর হবে না। এছাড়াও, বিভিন্ন সামাজিক- সাংস্কৃতিক সংগঠনও এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারে। পথশিশু নিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এবং নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কিছু কার্যক্রম আছে, যা খুবই সীমিত। এই কার্যক্রম আরো বাড়ানো উচিত।
পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘তরী’ এর উপদেষ্টা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তারিকুল ইসলাম বলেন, মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝড়ে যাওয়া, পারিবারিক অভাব-অনটনের মতো বেশকিছু কারণে শিশুদেরকে নানাধরনের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। দেশে পথশিশু ও শিশুশ্রমের বিষয়ে বিধান আছে, যেটিকে নানাভাবে অবজ্ঞা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সমন্বিত একটি শিশু পুনর্বাসন প্ল্যাটফর্ম গঠন করা এখন সময়ের দাবি। পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত এবং অসহায় শিশুদের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে। শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে শিশুবান্ধব শিক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের দরিদ্র পরিবারগুলোকে অভাবমুক্ত করা গেলে তারা উন্নত জীবনের দিকে ধাবিত হবে। ফলে রাস্তায় কমে যাবে ভাসমান শিশুর সংখ্যা।
অধ্যাপক ড. তারিকুল ইসলাম আরো বলেন, সরকার দেশের সব বিভাগকে যেভাবে এগিয়ে নিচ্ছে, এদিকেও সরকারকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়ন বা তাদেরকে অগ্রসর করতে দীর্ঘমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের প্রণোদনা আছে, নীতিমালা আছে। এখন শুধু দরকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নিয়ে একটি সমন্বিত কার্যক্রম। এতে করে পথশিশুরাও উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সামিল হতে পারবে। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি সংগঠনের সুপারিশমালা থেকে বেশ কিছু কমন দাবি পাওয়া যায়। এক. শিশু বিষয়ক আলাদা একটি মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে। দুই. যারা বর্তমানে অধিকারহারা শিশুদের নিয়ে কাজ করে বা করতে আগ্রহী এমনসব এনজিও- আইএনজিও, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে সরকারি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরকে একই ছাতার নিচে আসতে হবে। সমন্বিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে এসব ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে হবে। তিন. পথশিশু বিষয়ক সমস্যা যেহেতু পুরনো, তাই দীর্ঘমেয়াদি বা মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে সমস্যার সমাধান করতে হবে। চার. দরিদ্র ও উদ্বাস্তু পরিবারগুলোকে খুঁজে খুঁজে সোশ্যাল সেফটিনেশনের আওতায় এনে শিশুদের সুরক্ষা দিতে হবে। পাঁচ. দেশে পথশিশুদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা জরুরি, তাই নির্ভরযোগ্য একটি হালনাগাদ শুমারি দরকার। ছয়. শিশুদের ঢাকা আসার পথ বন্ধ করাটা জরুরি। পরিবহনে চড়ে বসলেই যেন ঢাকা আসতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএ বা রেল কর্তৃপক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে। সাত. পথের শিশুটিকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার পরেও বিষয়টি ফলোআপে রাখতে হবে। আট. মাদকের বাহক হিসেবে যারা পথশিশুদের ব্যবহার করছে, তাদের আইনের আওতায় এনে কঠিন বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। নয়. রাষ্ট্রীয় তত্বাবধানে পথশিশুদের জন্মনিবন্ধন একটি উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
(ব্যক্তিগত মর্যাদা ও নিরাপত্তার স্বার্থে শিশুদের প্রকৃত নাম-পরিচয় ব্যবহার করা হয়নি)
পড়ুন চতুর্থ পর্ব : শিশু বয়সেই পথের কন্যাশিশু হয়ে ওঠে ‘নারী’
/তারা/