বেসরকারি মেডিক্যালে ফি বৃদ্ধি: মধ্যবিত্তের চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ফিকে
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা মহানগর কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন সামিয়া সুরমি ছোয়া। এসএসসিতেও জিপিএ-৫ পেয়েছেন তিনি। বাবাকে হারিয়েছেন ৬ বছর বয়সে। মা ও সামিয়ার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিলো চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা এই মেধাবী ছাত্রীর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন এখন ফিকে হতে চলেছে।
এ বিষয়ে শনিবার (৪ মার্চ) সামিয়া এ প্রতিবেদককে বলেন, তিন বোনের মধ্যে আমি বড়। মা দর্জির কাজ করে সংসার চালান। আমি যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি তখন আমার বাবা মারা যান। মায়ের স্বপ্ন আমি বড় হয়ে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবো। মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে চাই। সেই স্বপ্নপূরণে ফুফা আমাকে সাপোর্ট দিয়ে আসছেন। স্বপ্নপূরণে তারা আমাকে মেডিক্যাল কোচিংয়ে ভর্তি করেছেন। আমি চেষ্টা করছি, জানি না কতটা পারবো।
তিনি বলেন, ফুফা বলেছেন সরকারি মেডিক্যালে চান্স পেলে ভালো। তা না হলে কষ্ট করে হলেও প্রাইভেট মেডিক্যালে পড়াবেন। তবে খবরে দেখলাম প্রাইভেট মেডিক্যালে ভর্তির ফি কয়েকগুণ বাড়ানো হয়েছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে আমার মনে হয়, প্রাইভেট মেডিক্যালে পড়া আমিসহ অন্যদের জন্য নয়। সম্প্রতি প্রাইভেট মেডিক্যালে ভর্তির ফি কয়েকগুণ বাড়ানোর পর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখাটা বন্ধ করে দিয়েছি।
শুধু সামিয়া একা নন তার মতো গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের কাছে প্রাইভেট মেডিক্যালে ভর্তি এখন শুধুই স্বপ্ন।
পুরান ঢাকার লালবাগের বাসিন্দা সামিয়ার মা আলেয়া খাতুন বলেন, সামিয়া ছোটবেলায় বলতো বড় হয়ে ডাক্তার হবে। আমরা প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়েছি। আর্থিক সংকটের কারণে সামিয়া তার ফুফার বাসায় থেকে পড়াশুনা করছে। আমরা উৎসাহ দিয়ে গেছি। সরকারি মেডিক্যালে চান্স না পেলে বেসরকারি মেডিক্যালে পড়াশোনা করা কঠিন। আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
সরকারের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে আসন সংখ্যা ৪৩৫০টি এবং বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে আসন সংখ্যা ৬১১০টি। সরকারি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে মোট আসন সংখ্যা ১০৪৬০টি। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী সন্তান সরকারি মেডিক্যালে ভর্তি সুযোগ না পেয়ে এমবিবিএস ও বিডিএসে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে। খরচ জোগাতে অভিভাবকরা হিমশিম খাচ্ছেন।
আসন্ন ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে যারা ভর্তি হবেন তাদের খরচ অনেক বেড়েছে।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের চিকিৎসা শিক্ষা-২ শাখার উপসচিব মাহবুবা বিলকিস স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তির ফি ২০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা করা হয়েছে। একইসঙ্গে, এমবিবিএস এবং বিডিএস শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিক টিউশন ফি ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার এবং টিউশন ফি ১০ হাজার টাকা করে ৪ বছরে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা আগের শিক্ষাবর্ষের মতো রাখা হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে বেসরকারি মেডিক্যাল ভর্তি ফি ছিলো ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা।
ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন মুহাম্মদ আতইয়াব। রাজধানীর ফামর্গেটে একটি কোচিং সেন্টারে ক্লাস করছেন। তিনি বলেন, হঠাৎ এমন ফি বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই। সরকারি মেডিক্যালে চান্স না পেলে বেসরকারিতে পড়তে হবে। তবে ফি বৃদ্ধিতে আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের পড়া হবে কষ্টসাধ্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভর্তি ফি বাড়ায় মেডিক্যাল শিক্ষা সংকুচিত হবে। চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ থেকে মেধাবীরা বঞ্চিত হবেন। শিক্ষার মানোন্নয়ন নয়, ব্যবসায়িক স্বার্থে বাড়ানো হয়েছে মেডিক্যালে ভর্তি ফি। অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এই ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ সংকুচিত হবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করে সহনশীল পর্যায়ে রেখে বাড়ানো হয়েছে মেডিক্যালে ভর্তি ফি।
পপুলার মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তে বেসরকারি মেডিক্যালে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা কমবে কিনা এখনই বলা যাবে না। এবার শিক্ষার্থীদের ভর্তির হার দেখে তা বোঝা যাবে। দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বেসরাকরি মেডিক্যাল কলেজগুলোতেও কোটা আছে। বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। যারা দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী তাদের বিষয়টি প্রতিষ্ঠান অবশ্যই বিবেচনা করবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. টিটো মিয়া বলেন, বেসরকারি মেডিক্যালে ভর্তি ফি সহনশীল পর্যায়েই রাখা হয়েছে। তবে এ সেশনের শিক্ষার্থী ভর্তি শেষ হলে প্রভাব কেমন পড়বে তা বোঝা যাবে।
বাংলাদেশ বেসরকারি মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুবিন খান বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম অর্থে মেডিক্যালে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আর এ কারণেই বিদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে মেডিক্যালে পড়তে আসেন। নেপালে বেসরকারি মেডিক্যালে পড়ার জন্য গুণতে হয় ৫০ লাখ, ভুটানে ৫৫ লাখ, মালয়েশিয়ায় ৮০ লাখ টাকা। আর ভারতে এ ফি দেড় কোটি টাকা।
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিক্যাল এডুকেশনের সাবেক সিনিয়র উপদেষ্টা ডা. মোজাহারুল হক বলেন, মেডিক্যালে ফি বৃদ্ধি নীতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সব শিক্ষার্থী সরকারি মেডিক্যালে পড়ার সুযোগ পাবে না। মেডিক্যালে ভর্তি ফি বৃদ্ধির একটি নীতিমালা তৈরি করা উচিৎ ছিলো। বেসরকারি মেডিক্যালে বিদেশি শিক্ষার্থীর পাশাপাশি ধনীদের সন্তানরা লেখাপড়া করে। বেসরকারি মেডিক্যাল মালিকদের বেশি বেশি সুযোগ দিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারি মেডিক্যালে শিক্ষার খরচ সহনীয় হলেও বেসরকারিতে খরচ আকাশচুম্বী। বেসরকারি মেডিক্যাল যতটা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারচেয়ে বেশি ব্যবসায়িক মনোভাব রয়েছে। ফলে চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবার মান অন্য সব দেশের চেয়ে নিচে। চিকিৎসা নিতে অসংখ্য মানুষ দেশের বাইরে যাচ্ছে। দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। ভর্তি ফি বাড়ানোয় চিকিৎসা শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত হবে।
উল্লেখ্য, সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির প্রবেশপত্র বিতরণ হবে ৬ মার্চ ও ৭ মার্চ। আগামী ১০ মার্চ ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
/আসাদ/সাইফ/