ঢাকা     রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৮ ১৪৩১

সুখেনের ‘দুঃখ’ নৌকাজীবন

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩৫, ২৫ জুলাই ২০২৩   আপডেট: ১৫:৩৭, ২৫ জুলাই ২০২৩
সুখেনের ‘দুঃখ’ নৌকাজীবন

সুখেন বিশ্বাসের নৌকাজীবন। ছবি: রফিকুল ইসলাম মন্টু  

কপোতাক্ষ নদের ভরা জোয়ারের ঢেউয়ে নৌকাখানি দুলছে। জোয়ারের পানি তীর ছাপিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ভর দুপুরে তপ্ত রোদে শিশুরা মেতেছে ডুব-সাঁতারে, বড়রা ব্যস্ত কাজে। নৌকা বানানোর কারিগরেরা নদের ধারে রঙিন তাঁবুর নিচে হাতুরি পেটাচ্ছে ক্রমাগত। শব্দগুলো বোয়ালিয়া সেতুতে প্রতিধ্বনি করছে। নদের ধারের ঘিঞ্জি বাড়িগুলোর কোনো কোনোটির রান্নাঘর থেকে ওঠা ধোঁয়া দুপুরের খাবারের আয়োজন প্রস্তুতির কথা বলে দেয়। কিন্তু এত কিছুর মাঝেও সুখেন বিশ্বাসের ব্যস্ততা নেই। তার নৌকার ঘরের উনুনে তখনো হাঁড়ি ওঠেনি। স্ত্রী নমিতা রানী বিশ্বাস মন্দিরে ব্যস্ত প্রাত্যহিক পূজায়। সেদিন বেশ কয়েক দিনের জন্য নদীতে যাচ্ছিলেন এই দম্পতি।  

কপোতাক্ষ নদের তীরে বোয়ালিয়া ব্রিজের ধারে গদাইপুর ইউনিয়নের গ্রামটির নাম ‘মালোপাড়া’। খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলা সদর থেকে এই এলাকার দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। কপোতাক্ষ নদে ব্রিজ হওয়ায় এপারের সাথে ওপারের যোগাযোগ সহজ হয়েছে। নদের ওপারেও গদাইপুর ইউনিয়নের অংশ। তবে বোয়ালিয়া ব্রিজ পার হয়ে এখান থেকে খুব সহজে সাতক্ষীরা সদরে যাওয়া যায়। রাস্তা উন্নত হওয়ায় বোয়ালিয়া মালোপাড়ার মানুষের জীবনযাত্রার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু কপোতাক্ষ নদের ভাঙনের কারণে তীরের অনেকগুলো পরিবার চরম সংকটের মুখে রয়েছে। সুখেন বিশ্বাস তাদেরই একজন। ভাঙনের কারণে বেশ কিছু পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। সুখেনের সে সুযোগ হয়নি। তাই তার ভরসা এই নৌকা। স্ত্রী নমিতা রানী বিশ্বাসকে নিয়ে এই নৌকায় তারা মাছ ধরেন এবং নৌকায়ই বাস করেন। কপোতাক্ষ নদ থেকে নৌকা যায় শিবসা নদীতে।

ভর দুপুরে তপ্ত রোদের তীব্র তাপ। সুখেন কয়েক দিনের অল্প কিছু চাল যোগাড় করেছিলেন। তাই নিয়ে নৌকার দিকে যাচ্ছিলেন। মালোপাড়া ঘাটে বাঁধা প্রায় বিধ্বস্ত নৌকাখানি। নৌকার ছইয়ে পলিথিনের শতেক তালি। গলুইয়ে ছড়িয়ে আছে কতগুলো জাল, লগি-বৈঠা, হাঁড়ি-পাতিল, উনুন ইত্যাদি। ছইয়ের নিচে ছোট্ট এক টুকরো জায়গায় জীবন কাটে তাদের। কখনো উচ্চ জোয়ারের চাপ, কখনো ঝড়-ঝাপটা, কখনো নিম্নচাপ, কখনো ঘূর্ণিঝড়ের থাবা— সব সামলাতে হয় সুখেন-নমিতাকে। শত প্রতিকূলতার মুখেও শেষ বয়সে তাদের জীবন নৌকাখানি চলছে এঘাট থেকে ওঘাটে।

ওপাড়ে দেখা যাচ্ছে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর

কথা বলতে বলতে সুখেনের দীর্ঘশ্বাস— ‘এক সময় বসবাসের জন্য এক টুকরো জমি ছিল এই কপোতাক্ষ নদের তীরে। বাড়ি থেকেই মাছ ধরে সংসার চালাতাম। কিন্তু কপোতাক্ষের ভাঙনে আমার জমি হারিয়ে গেছে। সেই সাথে হারিয়েছি বসতি। বাধ্য হয়ে আমাকে নৌকায় বসবাস করতে হচ্ছে। ভূমিতে এখন আর আমার ঠাঁই নাই।’ — কথাগুলো বলতে বলতে সুখেন যেন ফিরে যান সেই পুরনো দিনে। হয়ত কখনোই এমনটা ভাবেননি। 

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ডিঙ্গি নৌকায় ভাসমান জীবন কাটাচ্ছেন সুখেন। ভাগ্য বিড়ম্বনায় বৃদ্ধ সুখেন  সমতলের জীবন থেকে ছিটকে পড়েছেন। বোয়ালিয়া মালোপাড়ার পশ্চিম পাশে কপোতাক্ষ নদের তীরে নির্মাণ করা হয়েছে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্প। মালোপাড়ার বাড়িঘর ভেঙ্গে কপোতাক্ষের ওপারে জেগেছে খাসজমি। সেই জমিতেই নির্মাণ করা হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর। কিন্তু ওই প্রকল্পে ঘর চেয়েও সুখেনের মত আরো অনেকে পাননি। ফলে সুখেনের আর ডাঙ্গায় ফেরা হয়নি। ফলে বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে নিয়ে ডিঙ্গি নৌকায় ভাসমান জীবন যাপন করছেন ৬৮ বছর বয়সী এই প্রবীণ। পানিতে ভাসতে ভাসতে খেয়ে না খেয়ে কোনো রকম দিন কাটছে এই দম্পতির। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে কপোতাক্ষ নদে, কখনও শিবসা নদীর জলে নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন তারা। তবুও জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার স্বপ্ন হারাননি। এখনও আশা— যদি আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটা ঘর মেলে। আবারো ভূমির জীবনে ফিরে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর থেকে জাল নিয়ে নদীতে দিনমান অক্লান্ত খাটছেন সুখেন।  

কাঠের তৈরি ছোট্ট নৌকায় ভেসে ভেসে এক যুগের বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছেন এই প্রবীণ দম্পতি; যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। নৌকাই তাদের ঘর-বাড়ি-সংসার। যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় দুর্ঘটনা। ‘যাযাবর’ বা ‘বেদে’ জাতির মানুষ বংশপরম্পরায় নৌকায় বসবাসে অভ্যস্ত। কিন্তু ওই জাতির অন্তর্ভূক্ত না হয়েও সুখেনের বিধিলিপিতে এই নৌকাজীবন। সকাল, দুপুর, পড়ন্ত বিকেল কিংবা গোধূলি শেষে সন্ধ্যায় সূর্যবাতির আলোতে আলোকিত হয় সুখেনের ছোট্ট নৌকাখানি। বিকালে নৌকার উনুন জ্বলে রাতের খাবারের জন্য। দুপুরের রান্না অধিকাংশ সময় হয় না। শুকনো খাবার দিয়ে চালিয়ে নেন। 

মালো সম্প্রদায়ের মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বোয়ালিয়া মালোপাড়ার অধিকাংশ পরিবার বংশ পরম্পরায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। বড় নৌকা নিয়ে অনেক পরিবার শীত মৌসুমে সুন্দরবনের দুবলার চরে মাছ ধরতে যান। মাছ ধরে অনেকের অবস্থা বদলেছে। টিনের ঘরের স্থানে উঠেছে পাকা বাড়ি। কিন্তু কিছু পরিবার অবস্থা বদলাতে পারেনি। প্রাকৃতিক বিপদের সাথে পাল্লা দিয়ে এগোতে পারেননি তারা। সুখেন তাদেরই একজন।  

নৌকায় সুখেনের স্ত্রী নমিতা রানী বিশ্বাস

উদোম শরীরে ধূতি পরা সুখেন এগিয়ে আসছিলেন নৌকার দিকে। শরীরের হাঁড়গুলো স্পষ্ট দেখা যায়। কয়েকদিনের জন্য মাছ ধরতে যাবেন, তাই কিছু প্রস্তুতি নিয়ে সেদিন ব্যস্ত ছিলেন সুখেন। জীবন যুদ্ধে পরাজিত সুখেনের চার মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে বিদ্যুৎ বিশ্বাস ভারসাম্যহীন। তার এক মেয়ে কপোতাক্ষ নদের চরে সরকারি জমিতে দোচালা টিনের ঘর তৈরি করে বসবাস করছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যুৎ বিশ্বাস বোনের তৈরি করা ঘরের এক রুমে বাস করে। সুখেনও তার মেয়ের ঘরে থাকতে পারতেন; কিন্তু সুখেনের বিধিলিপিতে লেখা নেই তা। তার থাকার জায়গা হয়নি মেয়ের ঘরে। 

ভাসমান জীবন-যাপন প্রসঙ্গে সুখেনের বক্তব্য ‘আমি গরিব মানুষ। জমি কেনার টাকা নেই। তাই নিরুপায় হয়ে নৌকায় বসবাস করছি।’

প্রাকৃতিক বিপদগুলো সুখেনের সব কেড়ে নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে তার নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। নৌকাটি নদী থেকে উঠিয়ে দূরে ফেলে দিয়েছিল। এতে নৌকা ভেঙে চুরমার হযে যায়। তখন ধার দেনা করে চলছিলেন। অনেক কষ্ট করে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে নৌকা কিনেছিলেন। সুখেন বলেন, ‘এই নৌকা আমার সব। নৌকা দিয়ে জাল ফেলে মাছ ধরি। নৌকায় আমার ঘর সংসার। শিবসা ব্রিজের পাশে মাসের ১৫-২০ দিন মাছ ধরি। যে মাছ পাই তা বিক্রি করে চাল-ডালসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দুই জনের সংসার চালাই। রাতে নদীর পাশে গাছে নৌকার রশি বেধে ঘুমাই। ঝড়ের খবর পেলে খালের ভিতর নৌকা নিয়ে বেঁধে রাখি। মাঝে মাঝে বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় কপোতাক্ষ নদে এসে মেয়ের বাসায় রান্না করে খাবার নিয়ে নৌকায় যাই। রাতে খাওয়া শেষে নৌকায় ঘুমাই। আগের মতো নদীতে মাছ নেই। ফলে জীবন জীবিকা চালিয়ে নেওয়া খুব কঠিন হচ্ছে। একবার জাল ফেললে ১-২ কেজি মাছ পাওয়া যায়। এই মাছ বিক্রি করে কোনো রকমে সংসার চলছে।’

পুরুষের পক্ষে নৌকায় বসবাস করা সম্ভব হলেও একজন নারীর পক্ষে নৌকায় বসবাস করা কষ্টসাধ্য। সুখেনের স্ত্রী নমিতা রানী বিশ্বাস সেই কষ্ট করছেন এক যুগের বেশি সময় ধরে। নমিতা বলেন, ‘আমাদের বসবাসের জন্য একটি ছোট্ট বাড়ি ছিল। বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ করতাম। আগে নদীতে মাছও পড়ত অনেক বেশি। জীবনে কখনো কল্পনাই করিনি নৌকায় বসবাস করতে হবে। নারী হিসাবে আমার খুব কষ্ট হয়। নৌকায় রান্নার কাজে সমস্যা যেমন আছে, তেমনি অন্যান্য কাজেও সমস্যা আছে। রান্নার কাজ শেষ করে আমাকে মাছ ধরার কাজেও সাহায্য করতে হয়। নৌকা বাঁধা, বাজার করা, সব কাজই আমরা দুইজন মিলে করি। কত ঝড়-ঝাপটা মোকাবিলা করেছি। তবুও জীবন চালিয়ে নিতে হচ্ছে এভাবে।’

মালোপাড়ার অনেক পরিবার এখনো ভাঙন ঝুঁকিতে

সরকারের কাছে একটি ঘরের দাবি সুখেনের। বসবাসের জন্য একটি ঘর পেলে শেষ বয়সে তার জীবনে কিছুটা সাচ্ছন্দ্য আসতে পারে। সুখেন বলেন, গদাইপুর কপোতাক্ষ নদের পশ্চিম তীরে সরকারি খাস জমিতে গড়ে ওঠা আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি ঘর চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি সেখানে ঘর পাইনি। নৌকায় থাকতে ভয় লাগে, ঝড় ঝাপটায় কখন কি হয়! আমাকে একটা ঘর দিলে নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারবো বাকি জীবন।’ 

সুখেনের এই দাবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মমতাজ বেগম বলেন, ‘নদীর ধারের কোনো আশ্রয়ণ কেন্দ্রে ঘর খালি আছে কিনা খোঁজ নিতে হবে। কোথাও খালি ঘর পাওয়া গেলে সুখেনকে ঘর দেওয়া হবে।’ 
 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়