ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৪ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২০ ১৪৩১

নারকীয় ২১ আগস্ট

প্রচণ্ড শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন আহতরা

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১০, ২১ আগস্ট ২০২৩   আপডেট: ০৯:১৬, ২১ আগস্ট ২০২৩
প্রচণ্ড শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন আহতরা

রাশিদা আক্তার রুমা এবং মাহবুবা পারভিন

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের সেই নারকীয় গ্রেনেড হামলায় আহতরা এখনও সেই দিনের কথা ভাবলে আঁতকে ওঠেন। প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাচ্ছে। সেই যন্ত্রণা বলে বোঝানো কঠিন। তাদের কথায়, ‘এই যন্ত্রণা যাদের, শুধু তারাই বুঝবে, কতটা কষ্টে প্রতিটি দিন যায়। সেদিন মরে গেলেই ভালো হতো।’  

নারকীয়, বীভৎস, বর্বরোচিত; কোনো নেতিবাচক বিশেষণেই যেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অমানবিক ঘটনাকে বর্ণনা করা যায় না। ১৯ বছর আগে আওয়ামী লীগের সেই জনসভায় অনেক নেতাকর্মী নিহত হন। আর যারা সেই হামলায় আহত হয়েছেন, তারা শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছেন। 

সেই গ্রেনেড হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে বছরের পর বছর জীবনের সঙ্গে লড়তে লড়তে এখন ক্লান্ত রাশিদা আক্তার রুমা। শরীরের ভেতরে বাস করা স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সেদিন মরে গেলে বেঁচে যেতাম। তাহলে আমার বাচ্চা আর পরিবারকে এত কষ্ট ভোগ করতে হতো না।’

গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার পর থেকে প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, জানিয়ে রুমা বলেন, এখন শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপের দিকে। মাঝে মাঝে প্রস্রাবে রক্ত যায়। চেহারা ফুলে যায়। পা, পেট ফুলে যায়। ডাক্তার বলেছেন, কিডনিতে সমস্যা হয়েছে।

উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা কয়েকজন ভুক্তভোগী উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছি। দুই-চারটি অপারেশন আছে, এটি করা না হলে আমার শরীরে ইনফেকশন হয়ে যাবে। আমার শরীরের ভেতর যে রডগুলো আছে, তা বের করা হয়নি। গ্রেনেডের স্প্লিন্টার বের করতে হলে জার্মানি যেতে হবে। বাংলাদেশে তো এর চিকিৎসা নেই। ওষুধ খেয়ে খেয়ে ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখা হচ্ছে। অপারেশন না হওয়ায় কিছুদিন আগে সেলিম ভাই (২১ আগস্টে আহতদের অন্যতম) মারা গেছেন। এভাবে ৭-৮ জন মারা গেছেন, যারা ২১ আগস্টের ভুক্তভোগী।’

সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ওই দিন সমাবেশে জয় বাংলা বলে আপা (শেখ হাসিনা) নামতে যাবেন, এমন সময় বিকট শব্দ। এরপর কোথায় যেন উড়ে গিয়ে পড়লাম। কখন, কতক্ষণ ছিলাম, জানি না। সন্ধ্যার দিকে আমার কানে কোলাহলের শব্দ এলো। তখন আমি চোখ খুলে দেখি রক্ত আর রক্ত। আমার আঙুল, বাম হাত, দুটো পা ভেঙে গিয়েছিল। পা ভেঙে হাড় বাইরে বেড়িয়ে গিয়েছিল। হাতির পায়ের মতো ফুলে গিয়েছিলো আমার পা দুটো। পরে আমি আমার বাম হাতের ওপর ভর দিয়ে কোনো রকম উঠে দেখি আইভি আন্টি ওখানে পড়ে আছেন।  আমি ওনার পাশেই ছিলাম।  আমি উঠে যে কাউকে কিছু বলব, তা পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর মাথা ঘুরে পড়ে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। পরে কেউ একজন আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।’

রুমা বলেন, ২৪ ঘণ্টা ওষুধ খেয়ে থাকতে হয়। প্রতিটা দিন ৩০-৩৫টা ট্যাবলেট খেতে হয়। স্প্লিন্টার শরীরে প্রচণ্ড জ্বালা করে। দিনে ৪-৫ বার গরম পানি করে শরীরে ঢালতে হয়। না ঢাললে পোকার মতো হাটতে শুরু করে। চুলকাতে চুলকাতে রক্ত বের হয়ে যায়। গরমের দিন আসলে এটা হয়। রাতে যন্ত্রণা করে খুব বেশি। পা অবশ হয়ে যায়। 

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত আরেকজন নাজমুল হাসান নাজিম। তিনি ওই সময়ে ভৈরব উপজেলা যুবলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বীভৎস সেই হামলায় চোখের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছেন প্রয়াত আইভী রহমানকে। তাকে বাঁচাতে তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেও গ্রেনেডের আঘাতে ক্ষত- বিক্ষত হয়ে যান নিজেও। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান রাস্তায়। তারপর আর কিছু মনে নেই। সবাই মনে করেছিলেন, তিনি মারা গেছেন।

কতটা ভয়ঙ্কর ছিল সেই হামলা, তা বলতে গিয়ে বারবার শিউরে ওঠেন নাজমুল। শরীরে মধ্যে থাকা শত শত স্প্লিন্টারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছেন তিনি। নাজমুল বলেন, আসলে স্প্লিন্টারের জ্বালা কী, কত কষ্টের তা বলে বোঝানো যাবে না। যার শরীরে স্প্লিন্টার বিঁধেছে, সেই অসহ্য এই যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারে।’

এখন শরীর কেমন, কিভাবে চিকিৎসা চলছে, জানতে চাইলে নাজমুল বলেন, ‘শরীরে অনেক স্প্লিন্টার আছে এখনো। ১০-১২টা অপারেশন শুধু আমার পেটেই হয়েছে। পরে পায়ে হয়েছে। আপা (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) বিদেশ থেকে উন্নত চিকিৎসা করিয়ে এনেছিলেন। পরে স্প্লিন্টারগুলো আর বের করা হয়নি।’

১৯ বছরের যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে বেঁচে আছেন, জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২০০৪ থেকে খুব কষ্টে আছি। এসব চিকিৎসা দেশের বাইরে ছাড়া হবে না। সবগুলো স্প্লিন্টার বের করা যাবে না। যার শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার ঢুকেছে, সে-ই বোঝে, কী কষ্ট। মাঝে মাঝে শরীর অবশের মতো হয়ে যায়। যেখানে স্প্লিন্টার আছে, গরম এলে সেখানে খুব চুলকায়।’

ব্যথার ওষুধ খেতে খেতে কিডনিতে সমস্যা হয়ে গেছে, জানিয়ে নাজমুল হাসান নাজিম বলেন, ‘ওষুধ না হলে আর চলা যায় না। ব্যথার ট্যাবলেট খাওয়ার কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডাক্তার বলেছে যে, এই ট্যাবলেট আর খাওয়া যাবে না। আমি এখন কিডনি নিয়ে বড় সমস্যায় আছি।’

চিকিৎসা করতে করতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছেন, জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অধৈর্য হয়ে গেছি…। আসলে কী দিয়ে কী করবো। আপা আসলে অনেক চেষ্টা করেছেন, আমাদের জন্য অনেক করেছেনও তিনি। উনি ওই সময়ে উন্নত চিকিৎসা না করালে আজকে আমি হয়ত এই অবস্থায় থাকতাম না। গুরুতর আহত ২২ জনের মধ্যে সবাই জানত, আমি মারা গেছি। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি বেঁচে আছি।’

সেদিনের ঘটনার ভয়াবহতা স্মরণ করে নাজমুল বলেন, ‘গ্রেনেডের আঘাতে আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। ভুড়ি বের হয়ে যায়। পায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এখনও পা প্লাস্টার করা। বিভিন্ন জায়গা থেকে মাংস এনে পায়ের ক্ষতগুলো পূরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।’

স্প্লিন্টারের কারণে হাঁটাচলা ঠিকমতো করতে পারেন না, জানিয়ে তিনি বলেন, ‘১০০-২০০ গজ গেলেই আর পা চলে না। যাদের গায়ে স্প্লিন্টার লেগেছে, তারা ছাড়া এর যন্ত্রণা কেউ বুঝবে না।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সেই নারকীয় হামলায় আহতদের একজন তৎকালীন ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মাহবুবা পারভিন। ওই ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ৭২ ঘণ্টা আইসিইউতে ছিলেন তিনি। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছেন। বাঁচবেন কি না, তা নিয়ে তখন ছিল শঙ্কা।

মাহবুবা পারভিন বলেন, ‘উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। ২৫ দিন পর আমার জ্ঞান ফেরে। কলকাতায় যখন আমার জ্ঞান ফিরল, তখন থেকেই প্রতিদিন প্রতিক্ষণ যন্ত্রণা ভোগ করছি। এমন কষ্ট যে, চিৎকার করে কেঁদেছি। সেই থেকে আজ অবধি একটি রাতেও ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না।

২১ আগস্টের রক্তাক্ত হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।

ভয়াবহ বীভৎস সেই ক্ষণের বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখে-মুখে আতঙ্ক ভর করে পারভিনের। তিনি বলেন, ‘আমার এক সাইড প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিল। বাম হাত, বাম পা অবশ হওয়ার কারণে আমাকে দাঁড় করাতে পারছিল না। স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রচার সম্পাদক আশীষ কুমার মজুমদার আমাকে সেখান থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যান। আমার ভাই যখন ডাক্তারের কাছে আমার অবস্থা জানতে চাইলেন, তখন ডাক্তার বলেছিলেন, উনি বেঁচে আছে না কি মরে গেছে তা ৭২ ঘণ্টা পর বোঝা যাবে।’

এত বছরেও শরীরের ভেতরে থাকা স্প্লিন্টারের কারণে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না, জানিয়ে মাহবুবা পারভিন বলেন, ‘মাঝে মাঝেই রাতে চিৎকার করে কেঁদে উঠি। পায়ের মধ্যে স্প্লিন্টারগুলো কাটার মতো বিঁধে। যন্ত্রণা সইতে না পেরে নিজেই ব্লেড দিয়ে পা কেটে স্প্লিন্টার বের করতে চেয়েছিলাম। প্রতিনিয়ত মৃত্যুযন্ত্রণা বয়ে চলেছি।’

চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং সার্বিক খোঁজ রাখায় দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান মাহবুবা পারভিন। তিনি বলেন, ‘ওই হামলায় তিনি নিজের (শেখ হাসিনা) কথা চিন্তা না করে আমাদের চিকিৎসা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, খোঁজ নিয়েছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছেন।’

‘২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন, তাদের জীবন কিভাবে চলছে। কতটা যন্ত্রণা, কষ্ট নিয়ে প্রতিটি দিন পার করেন তারা। প্রতিদিনই আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই’, বলেন মাহবুবা পারভিন।

পারভেজ/রফিক 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়