অ্যাকশনে জিএম কাদের, বহিষ্কারে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা
মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন || রাইজিংবিডি.কম
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভরাডুবি, নির্বাচনি ফান্ড কুক্ষিগত করাসহ নানা অনিয়ম তুলে ধরে দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। গত বুধবার তারা জিএম কাদেরের বনানীর অফিস ঘেরাও করে পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের অপসারণ দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন। এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের আন্দোলন দমাতে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন জিএম কাদের। ইতোমধ্যেই দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী দুই নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ এবং সুনীল শুভ রায়। আরও বেশ কিছু নেতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন তিনি।
দলের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে জিএম কাদের আন্দোলনরত নেতাকর্মীদের নিজস্ব লোক দিয়ে নজরদারি করছেন।
ওই সূত্র জানায়, নির্বাচনের পর নেতাকর্মীদের তোপের মুখে রয়েছেন জিএম কাদের। ঘরে-বাইরে প্রচণ্ড চাপে থাকা দলের চেয়ারম্যান নিজস্ব বলয়ে থাকা নেতাদের পরামর্শে দলীয় নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে বহিষ্কার কার্যক্রম শুরু করেছেন। এভাবেই তিনি বিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে নেমেছেন।
তবে এত কিছুর মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে নেতাকর্মীদের অনেকে জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, চেয়ারম্যান কতজনকে বহিষ্কার করবেন? এবার একটা বিহীত চাই। আমরা আর কত বলি হবো? আমাদের বিক্রি করে তিনি নিজে (জিএম কাদের) এমপি হয়েছেন, স্ত্রীকে এমপি করতে চেয়েছেন। দলের অসংখ্য ত্যাগী মহিলা নেত্রীদের বাদ দিয়ে এখনও তিনি শেরিফা কাদেরকে মহিলা কোটায় এমপি করতে চান। এজন্য ত্যাগী নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করছেন বলেও জানান তারা।
জানা গেছে, আন্দোলনরত নেতারা জিএম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে রোববার বর্ধিত সভা ডেকেছেন। সেই সভায় সারাদেশের সব প্রার্থীদের আসতে বলা হয়েছে। এই কর্মসূচি ভেস্তে দিতে শুক্রবার বিকালে একটি জরুরি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তার আহ্বান ছাড়া সারাদেশের প্রার্থীদের অন্য কারও আহ্বানে দলসংশ্লিষ্ট ঢাকায় কোনো সভা, সমাবেশ কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করতে বিজ্ঞপ্তিতে তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন।
একই দিন দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়কে দলের সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহম্মদ কাদের এমপি।
দলীয় গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন বলেও দলীয় প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
অব্যাহতির বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ভালো হয়েছে। আমার কোনো বক্তব্য নাই।
অন্যদিকে জিএম কাদেরের এই অব্যাহতির বিষয়ে অবহিত নন বলে জানিয়েছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়।
তিনি বলেন, ‘আপনাদের মাধ্যমে আমি জেনেছি। কাচু (জিএম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নু) পরিচালিত জাতীয় পার্টি নামক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে অব্যাহতি দেয়ার বিষয়টি আমার কাছে কচু পাতার চেয়েও মূল্যহীন। আমি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলাম, আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো।’
মাঠ পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন, নির্বাচনে ভরাডুবি, দলীয় বিপর্যয়ের মধ্যে দলের প্রভাবশালী এক কো-চেয়ারম্যান এবং প্রেসিডিয়াম সদস্যকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের অনেকেই প্রতিবাদে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলীয় ব্যর্থতার দায়ে জিএম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুর পদত্যাগ করা উচিত ছিল।
দলটির সিনিয়র নেতারাও বহিষ্কারের বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছেন না। তাদের প্রশ্ন- নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে আর কতজনকে বহিষ্কার স্কার করা হবে? এভাবে একের পর বহিষ্কার করতে থাকলে দল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একদিন জাতীয় পার্টি নেতাকর্মী শূন্য হয়ে মুসলিম লীগে পরিণত হবে।
জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান, রওশনপন্থী সিনিয়র নেতা ইকবাল হোসেন রাজু বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছিলাম জিএম কাদের দলকে শেষ করে দিচ্ছেন। তিনি পল্লীবন্ধুর নাম মুছে জনবন্ধু নাম দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। নির্বাচনের পর নেতাকর্মীরা বুঝতে পারছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা কথা বলবেন এটাই স্বাভাবিক। সবার গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। নির্বাচনে প্রার্থীদের বলিদান করে নিজের আখের গুছিয়ে ‘‘ভার্যার মন রাখা গেল না আবার নেতা উলঙ্গ’’- এ কথাও বলা যাবে না। এখন চেয়ার হারাবার ভয়ে বিদ্রোহ দমনে বহিষ্কার করে চলছেন তিনি।’
আগের মতো বহিষ্কার-আবিষ্কার করে জিএম কাদের একদিন নিজেই হারিয়ে যাবেন বলেও মন্তব্য করেন এক সময়ের এরশাদ মুক্তি আন্দোলনের এই নেতা।
দুই নেতার বহিষ্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে দলের কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা তার ভাইয়ের মৃত্যুতে শোকাহত এবং ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত বলে এড়িয়ে যান।
বহিষ্কারের ঘটনায় জাতীয় পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে জানিয়ে দলের অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা বলেন, ‘পার্টির চেয়ারম্যান কিছুদিন আগেও কয়জনকে বহিষ্কার করেছেন। এখন দুজন সিনিয়র নেতাকের বহিষ্কার করেছেন। এভাবে আর কতজনকে বহিষ্কার করবেন? এতে জাতীয় পার্টি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
অব্যাহতি দেওয়ার একক ক্ষমতা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের রয়েছে জানিয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য হাজি সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন বলেন, ‘পার্টির চেয়ারম্যান অব্যাহতি দিতে পারেন। তার সেই এখতিয়ার রয়েছে। আমরা চাইলেও তাকে অব্যাহতি দিতে পারি না। নির্বাচন নিয়ে আমাদের ক্ষোভ ছিল, সেই ক্ষোভ থেকে একটা বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামের সঙ্গে আমি ছিলাম না। তাছাড়া দলীয় ফোরামে আলোচনা কিংবা অনাস্থা ছাড়া আলটিমেটাম দিয়ে চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা যায় না।’
দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, চেয়ারম্যানের অপসারণের এই আলটিমেটামের সঙ্গে হয়তো কাজী ফিরোজ রশীদরা জড়িত আছেন মনে করে চেয়ারম্যান তাদের দল থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন বলে জানান হাজি সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন।
অভিন্নসুরে কথা বলেছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি জহিরুল আলম রুবেল। তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দুজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের অপসারণ একটি গণতান্ত্রিক নিয়ম পদ্ধতিতে হয়। যখন মিডিয়ার মাধ্যমে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয় এ অবস্থায় বহিষ্কার করা ছাড়া চেয়ারম্যানের আর বিকল্প কোনো পথ থাকে না। এটাই তিনি করেছেন।’
দলের ভাঙ্গন নয়, একতা কামনা করে জাতীয় পার্টির রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সাহিন আরা সুলতানা বলেন, ‘আমরা এখন খুব নাজুক অবস্থায় আছি। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা হতাশ। তারা দলের এহেন বিপর্যয় কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। দলের যারা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আছেন, তারা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেন আমার মনে হয় ভালো হবে। জাতীয় পার্টির ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল কেন হলো পর্যালোচনা করতে হবে। কীভাবে দল ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তা ঠিক করতে হবে।’
যে কোনো সমস্যা সমাধানে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে বুধবার বনানী অফিস ঘেরাও কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও মহানগর দক্ষিণের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা, সুনীল শুভ রায়, হাজি সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবক পার্টির সভাপতি লিয়াকত হোসেন খোকা, এমরান মিয়া, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মহানগর উত্তরের প্রেসিডেন্ট শফিকুল ইসলাম সেন্টু, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দক্ষিণের সেক্রেটারি জহিরুল আলম রুবেল, প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল ইসলাম জহির, এমরান হোসেন মিয়া, ভাইস চেয়ারম্যান শাহাজাহান সরদার, জাহাঙ্গীর আলম পাঠান, আমানত হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ রাজু, ফখরুল আহসান শাহাজাদা, বেলাল হোসেন, আব্দুল হামিদ ভাসানী, সাংগঠনিক সম্পাদক সুমন আশরাফ, সাইফুল ইসলাম, সৈয়দ ইফতেখার আহসান, প্রচার সম্পাদক মাসুদুর রহমান মাসুম, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক জহিরুল ইসলাম মিন্টু, যুগ্ম যুব বিষয়ক সম্পাদক দ্বীন ইসলাম, শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক মিজানুর রহমান মিরু, যুগ্ম সাংগঠনিক আকতার হোসেন দেওয়ান, আব্দুস সোবাহান, সুজন দে, আলমগীর হোসেন প্রমুখ।
এর আগে ধানমন্ডির একটি অফিসে বৈঠক করেন জাপা কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম, লিয়াকত হোসেন খোকা, হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, জহিরুল আলম রুবেল, সালাউদ্দিন মুক্তিসহ অনেক সিনিয়র নেতা। মিটিং থেকেই পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে আন্দোলন কর্মসূচি ঠিক করা হয়।
তারা//