ঠাকুরগাঁওয়ের ৬ টাকার শসা ঢাকায় ৪০, ৩৪ টাকা কার পকেটে
ঢাকা শহরে যেসব সবজি পাওয়া যায়, তার বেশিরভাগই উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে আসে
রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ভ্যানে ফেরি করে ভালো মানের শসা বিক্রি করা হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি দরে। পাশের ভ্যানে বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। তবে, এই শসার মান অতটা ভালো না। ঢাকার আরও দু’-একটি কাঁচাবাজার ঘুরে প্রায় একই দাম পাওয়া গেলো। আকার ও মানভেদে ২৫ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে শসা বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর মগবাজার এলাকার ফুটপাতে শসা বিক্রি করেন মো. জলিল। আরও কয়েকজন মিলে ময়মনসিংহ শহর থেকে শসা কিনে এনে ঢাকায় বিক্রি করেন তিনি। বুধবার (১ মে) কথা হয় তার সঙ্গে।
মো. জলিল জানান, তারা তিন-চারজন মিলে ময়মনসিংহ শহরের ভোরের চর থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে শসা কিনে এনে ঢাকায় ২৫ টাকায় বিক্রি করছেন। তাদের তিনজনের ৪০ মণ শসা একটি পিকআপ ভ্যানে আনতে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এতে তার কেজিপ্রতি খরচ হয়েছে সাড়ে ৩ টাকা। প্রতি কেজি শসায় লাভ করছেন ৫ থেকে ৬ টাকা। সারা দিন শসা বিক্রি করে তার আয় হয় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা।
ঢাকা শহরে যেসব সবজি পাওয়া যায়, তার বেশিরভাগই উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে আসে। এর মধ্যে বগুড়া ও ঠাকুরগাঁও জেলা অন্যতম। মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বগুড়া শহরের খান্দার বাজার, কলোনি বাজার এবং ফতেহ আলী বাজারে শসা বিক্রি হচ্ছিল প্রকারভেদে ২০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে।
তবে, বগুড়ার শিবগঞ্জের মাঝপাড়া গ্রামের চাষি শাকিল আহমেদ মাঠ থেকে শসা বিক্রি করেছেন ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা মণ দরে। অর্থাৎ ১৫ থেকে ২২ টাকা কেজিতে। শাকিল আহমেদ জানান, এ বছর শসার দাম একেক সময় একেক রকম ছিল। গত রমজানের শুরুতে মণ ছিল ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। পরের সপ্তাহে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় নেমে আসে। ঈদের আগে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা মণ, আর ঈদের পরে ১০০ টাকা মণ দরে অর্থাৎ আড়াই টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হয়েছে।
এই চাষিদের কাছ থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা শসা কিনে এনে জেলা শহরের খুচরা বাজারে অথবা ঢাকাসহ বিভিন্ন বাজারে পাঠান। বগুড়ার মহাস্থান হাটের পাইকার আব্দুস সোবহান বলেন, ভালো জাতের শসা চাষির কাছ থেকে সাড়ে ২২ টাকা কেজি দরে কিনতে হয়েছে। ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে ট্রাকভাড়া, খাজনা, লেবার খরচ মিলিয়ে কেজিতে আরও ৫ টাকা ৫০ পয়সা খরচ হবে। ঢাকার খুচরা বিক্রেতাদের কাছে কোনোদিন ৩২ টাকা কেজি, কোনো দিন ৩৫ টাকা আবার কোনো দিন ২৫ টাকা দরে শসা বিক্রি করেন।
ঠাকুরগাঁও জেলায় কৃষক পর্যায়ে শসার দাম অনেকটা কম। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের চাষি রাহাত ইসলাম জানান, বর্তমানে তিনি প্রতি মণ শসা মাত্র ২৪০ থেকে ২৫০ টাকায় অর্থাৎ ৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। এতে তার শসা চাষের খরচ তো দূরের কথা, খেত থেকে শসা তোলার শ্রমিকের খরচও উঠছে না। ক্ষেতে শসা পচে নষ্ট হচ্ছে।
জেলার গড়েয়া এলাকার চাষি সাদেকুল জানান, রমজান পার হওয়ার পর থেকে ৫-৬ টাকা কেজি দরে শসা বিক্রি করছেন।
ঠাকুরগাঁওয়ের পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম চাষিদের কাছ থেকে শসা কিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ট্রাকে করে পাঠান। তিনি জানান, চাষিদের কাছ থেকে ৪০ কেজির এক বস্তা শসা ২৪০ থেকে ২৫০ টাকায় অর্থাৎ ৬ টাকা কেজি দরে কিনছেন তিনি। ট্রাকে করে ঢাকায় শসা পাঠাতে প্রতি কেজিতে খরচ পড়ে দেড় টাকা, বস্তা-লেবার খরচ হয় আরও ১ টাকা। ঢাকায় পৌঁছানোর পর লেবার ও আড়তের কমিশন বাবদ খরচ আরও ১ টাকা। তাহলে কেজি প্রতি খরচ পড়ে সাড়ে ৯ টাকা।
পাইকার আব্দুর রহিম আরও জানান, শসা ঢাকায় পৌঁছানোর পর কিছুটা লাভসহ তারা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ১২ থেকে ১৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। তবে বাজার মন্দা থাকলে কখনও কখনও লোকসানও গুনতে হয়। এই খুচরা বিক্রেতারা ঢাকার কাঁচা বাজার এবং অলিগলিতে ভ্যানে শসা বিক্রি করেন।
ঢাকার যাত্রাবাড়ীর সম্রাট মার্কেটের শসার আড়ত মায়ের দোয়া বাণিজ্যালয় পরিচালনা করেন আক্তার হোসেন। তিনি জানান, ঠাকুরগাঁও থেকে যে শসা তার আড়তে আসে, তা তিনি খুচরা বিক্রেতার কাছে ১৩-১৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। তা ঢাকার বাজারে খুচরা বিক্রেতারা প্রকারভেদে ৩০-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন।
তিনি জানান, ঠাকুরগাঁওয়ের শসা দেখতে সুন্দর ও মোটা, কিন্তু হাইব্রিড জাতের। এই জাতের শসার স্বাদ কম। চাহিদা ও দাম কম। ময়মনসিংহ, বগুড়ার শসা দেশি জাতের। দামও কিছুটা বেশি।
আড়তদার আক্তার হোসেন আরও বলেন, তার আড়ত থেকে প্রতিদিন ২০ থেকে ৫০ মণ শসা বিক্রি হয়। তিনিসহ চারজন কাজ করেন। তাদের বেতন ও আড়ত ভাড়া বাদ দিয়ে মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার আয় হয়। তা দিয়ে কোনোরকমে ঢাকা শহরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে টিকে আছেন।
তিনি জানান, তার আড়তে যেহেতু বিক্রি বেশি, তাই ২-৩ টাকা লাভে বিক্রি করেন। খুচরা বিক্রেতার হাতে দাম বেড়ে যায়।
বৃহস্পতিবার (২ মে) সকালে মালিবাগে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করছিলেন আব্দুল হালিম। তার কাছে অন্যান্য সবজির মধ্যে শসাও আছে। শসা বিক্রি করছেন ৪০ টাকা কেজি দরে। তিনি জানান, প্রতি কেজি শসায় তিনি লাভ করছেন ১৫ টাকা। কিছু শসা নষ্ট হয়। ছোটগুলোর দামও কম। ২০ কেজি শসায় তার লাভ হবে ২০০ টাকার মতো। তিনি গভীর রাতে কারওয়ানবাজারের আড়তে সবজি আনতে যান। তারপর সারা দিন রাস্তায় ঘুরে বিক্রি করেন। এতে দিন শেষে তার ৮০০-৯০০ টাকা আয় হয়।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন রাইজিংবিডি ডটকমের বগুড়া প্রতিনিধি এনাম আহমেদ ও ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি মঈনুদ্দিন তালুকদার হিমেল)
/রফিক/