বিএনপির কাউন্সিল হচ্ছে না, শূন্য পদে নতুন নেতৃত্ব আসছে
ছবি: গ্রাফিক্স
বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে বছরব্যাপী বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে দলটি। সরকারবিরোধী আন্দোলনে আপাতত কঠিন কোনও কর্মসূচিতে না গিয়ে চলমান কর্মসূচির পাশাপাশি ‘জাতীয় কাউন্সিল’ না করে আপাতত শূন্য পদ পূরণ করে দলকে গোছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এসব পদে তুলে আনা হবে নতুন নেতৃত্ব।
বিএনপির শীর্ষনেতারা বলছেন, গত কয়েক বছর রাজপথে জোরালো আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে সাংগঠনিক কার্যক্রমে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। তাই সংগঠনকে কার্যকর করতে মূলদল বিএনপিসহ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। একই বছর ৬ আগস্ট নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। সম্মেলনের পর ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও দ্রুতই কেন্দ্রীয় সম্মেলন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা জানিয়েছেন। তবে, চলতি বছরে সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হলেও পূরণ করা হবে শূন্য পদগুলো। ইতোমধ্যে এর কাজও শুরু করেছে দলটি।
দলটির নেতারা বলছেন, চলতি বছর বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে আনা হবে নতুন নেতৃত্ব। ইতোমধ্যে ছাত্রদলে নতুন নেতৃত্ব আনা হয়েছে। ছাত্রদল ছাড়াও যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, শ্রমিক দল, জাসাস, তাঁতী দল, মৎস্যজীবী দলেও পরিবর্তন আনা হবে।
বিএনপির বিভিন্ন দলীয় সূত্রে জানা গেছে, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন কমিটিতে পরিবর্তন আনা হলেও সেটা কোনও কাউন্সিলের মাধ্যমে হচ্ছে না। ছাত্রদলের মতোই প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি ঘোষণা করা হবে। কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের যারা বিগত আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন, তাদেরই প্রাধান্য দেওয়া হবে।
এদিকে, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপিতে পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেছে। যদিও মহানগরের দুটি ইউনিটই ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। মহানগরের কমিটিতে নবীন-প্রবীণের সমন্বয় করা হবে বলেও জানা গেছে।
ইতোমধ্যে ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। শিগগিরই ঘোষণা করা হবে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটিও। বিগত আন্দোলনে স্বেচ্ছাসেবক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব অনেকের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা না রাখার অভিযোগও রয়েছে। সেক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক দলে আসতে পারে ব্যাপক রদবদল।
শ্রমিক দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে এক দশকেরও বেশি সময় আগে। দীর্ঘদিন সম্মেলন বা কমিটি পরিবর্তন না হওয়ায় অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে এ সংগঠনটি। যদিও বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী শামছুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের সার্বিক তত্ত্বাবধানে শ্রমিক দলকে চাঙা করার কাজ অব্যাহত রয়েছে।
তাঁতী দল দীর্ঘদিন আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে চললেও সংগঠনের ভেতরের একটি অংশ মূল নেতৃত্বের বিরোধিতা করে আসছে। বিরোধিতা করা অংশটি একাধিক সভাতে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটিয়েছে। এমনকি, তারা দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পোস্টার-ফেস্টুনও ছিঁড়ে ফেলেছেন।
জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যকার বিরোধও বিএনপিতে ওপেন সিক্রেট। জাসাস একসময় শক্তিশালী সংগঠন হলেও বর্তমানে নেই কোনও কার্যক্রম।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির শূন্য পদ পূরণসহ কেন্দ্রীয় কমিটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। যার মধ্যে যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদে নতুনদের আনা হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে বর্তমানে পাঁচটি পদ খালি আছে। এ ছাড়া, ভাইস চেয়ারম্যানের ১৭টি, উপদেষ্টা পরিষদের ১৭টি এবং সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক মিলে একশটির মতো পদ খালি রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর মধ্যে আইন, যুব, জলবায়ু পরিবর্তন ও মহিলাবিষয়ক সম্পাদক এবং ছাত্রবিষয়ক, তথ্য ও গবেষণা এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক সহ-সম্পাদকের পদ খালি রয়েছে। এর মধ্যে যুব ও ছাত্রবিষয়ক সহ-সম্পাদকের দুটি পদ ৮ বছরেও পূর্ণ হয়নি। আর বাকিগুলো রদবদল, মৃত্যু, বহিষ্কার কিংবা পদত্যাগের কারণে শূন্য হয়েছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, বার্ধক্য, অসুস্থতাসহ নানা কারণে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এখন ৮ থেকে ১০ জনের বেশি সদস্য উপস্থিত থাকেন না। নির্বাহী কমিটির অনেকে অসুস্থ ও বয়সজনিত কারণে নিষ্ক্রিয়। অনেকেই জেলা পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করায় কেন্দ্রে সময় দিতে পারেন না। আবার কেউ কেউ কেন্দ্রে থাকলে এলাকায় সময় দিতে পারেন না। ফলে নির্বাহী কমিটির শূন্য পদ পূরণ এবং ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে।
বিএনপির গত কাউন্সিলের পর থেকেই স্থায়ী কমিটিতে দুটি পদ খালি ছিল। পরবর্তী সময়ে এম কে আনোয়ার, তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ ও মওদুদ আহমদ মারা যান। এ ছাড়া, সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান পদত্যাগ করেন। সব মিলিয়ে স্থায়ী কমিটিতে শূন্য পদের সংখ্যা বর্তমানে সাতটি। এর মধ্যে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারপরও স্থায়ী কমিটিতে পাঁচটি পদ খালি রয়েছে।
আবার স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে খালেদা জিয়া ‘সাজাপ্রাপ্ত’ ও অসুস্থ হওয়ার পাশাপাশি আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে রাজনীতিতে সক্রিয় নন। চিকিৎসাধীন থাকায় দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারছেন না ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। রফিকুল ইসলাম মিয়া দীর্ঘদিন যাবত শয্যাশায়ী। নব্বইয়ের বেশি বয়সি জমির উদ্দিন সরকার বৈঠকে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করেন। বিদেশে অবস্থান করায় সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারছেন না ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সালাহউদ্দিন আহমেদ। এমতাবস্থায় সক্রিয় নেতাদের দিয়ে স্থায়ী কমিটির শূন্য পদ পূরণের জন্য দলের ভেতর দাবি উঠছে।
স্থায়ী কমিটির শূন্য পদের জন্য বেশ কয়েকজন নেতা আলোচনায় আছেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দীন আহমদ, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, বরকত উল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, জয়নুল আবেদিন, আবদুস সালাম, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেল।
যুগ্ম মহাসচিব পদের জন্য আলোচনায় আছেন সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আসাদুল হাবিব দুলু, নজরুল ইসলাম মঞ্জু, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, প্রশিক্ষণবিষয়ক সহ-সম্পাদক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সহ-সম্পাদক প্রকৌশলী আশরাফ উদ্দিন বকুলসহ কয়েকজন।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক পদেও পরিবর্তন আনা হতে পারে বলে একাধিক সূত্র জানা গেছে। যাদের মধ্যে আলোচনায় আছেন যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, কেন্দ্রীয় নেতা তাইফুল ইসলাম টিপু, আমিরুল ইসলাম খান আলিম, আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, এবিএম মোশাররফ হোসেন, জি কে গউছ, শহীদুল ইসলাম বাবুল, সেলিমুজ্জামান সেলিম, আবদুল খালেক, মো. শরীফুল আলম, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, দলের গঠন এবং পুনর্গঠন নিয়মিত কার্যক্রম। বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আমরা মনে করি, কর্মীদের মতামত ও ভোটের মাধ্যম দলের বিভিন্ন কমিটি নির্বাচন করা হবে। আমরা জাতীয় কাউন্সিলসহ মেয়াদোত্তীর্ণ সকল কমিটি পুনর্গঠনের জন্য কাজ করছি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সাংগঠনিক কাজ একটি চলমান প্রক্রিয়া। দলের কাউন্সিল করা এবং নেতৃত্ব পরিবর্তন এই প্রক্রিয়ারই অংশ। দলের নেতৃত্ব নির্ধারিত হবে নেতাদের ত্যাগ, অতীত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যক্তিগত যোগ্যতার ওপর।
ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, সাংগঠনিক বিষয়টা একটা রেগুলার প্রসেস। সম্মেলন বা নতুন কমিটি সংগঠনকে গতিশীল এবং নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙা করতে ভূমিকা রাখবে। সে লক্ষ্যেই দল কাজ করছে।
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সংগঠন তার নিজস্ব গতিতে চলছে, চলবে। কখন কোন কমিটি পরিবর্তন হবে, তা দিনক্ষণ মেনে করা সম্ভব হয় না। আমরা সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনে আছি। আন্দোলনের পাশাপাশি আমার সাংগঠনিক কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে।
/এনএইচ/