পর্ব-২
মিটারের কমিশন বাণিজ্যে সর্বস্বান্ত গ্রাহক, নেপথ্যে কারা
ছবি: গ্রাফিক্স
এক বছরে ডিপিডিসির একজন গ্রাহকের তিনবার মিটার নষ্ট হয়েছে। তিনবার মিটার পরিবর্তন করতে তার খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টাকা। আরেক গ্রাহকের ৮ বছরে একবারও নষ্ট হয়নি মিটার। দুজনই উচ্চচাপ বিদ্যুৎ সংযোগগ্রহীতা। এই দুটি মিটারের পার্থক্য হচ্ছে—একটি এইচটি মিটার, আরেকটি এলটিসিটি। তিনবার নষ্ট হওয়া মিটারটি এইচটি, আর গ্রাহককে ‘হয়রানিমুক্ত সেবা’ দেওয়া মিটারের নাম এলটিসিটি। অভিযোগ রয়েছে, ডিপিডিসির মিটার বিভাগের একটি সিন্ডিকেটের কমিশন বাণিজ্যের কারণে গ্রাহককে বাড়তি খরচ বহন করতে হচ্ছে।
ডিপিডিসি সূত্র জানিয়েছে, নতুন উচ্চচাপ বিদ্যুৎ সংযোগে ২০০ কিলোওয়াট সাবস্টেশনে ১৬০ কিলোওয়াট লোড পর্যন্ত এলটিসিটি মিটারে সংযোগ দেওয়া যাবে। এই সুযোগ রাখা হলেও পুরনো উচ্চচাপ সংযোগে যাদের এইচটি মিটারে ১৬০ কিলোওয়াট লোড পর্যন্ত রয়েছে, তাদের কারও এইচটি মিটার খারাপ হলে তাকে ওই মিটারই নিতে হচ্ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নতুন উচ্চচাপ সংযোগ যারা নিচ্ছেন, তাদেরও বেশি দামে এইচটি মিটার কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, এইচটি মিটার বেশি দামে কিনতে বাধ্য করার নেপথ্যে রয়েছে কমিশন বাণিজ্য। ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শাহেদ বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে এই কমিশন বাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যখনই এলটিসিটি মিটার ব্যবহারের জন্য এ-সংক্রান্ত বৈঠক হয়, তখন তিনি এর বিরোধিতা করেন। তার সঙ্গে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলামের নামও অভিযোগের তালিকায় উঠে এসেছে। এইচটি মিটারের দাম বেশি হওয়ায় এখানে কমিশনও বেশি। এজন্য সুযোগ থাকলেও এলটিসিটি মিটারের অনুমোদন দিতে ‘সাত-পাঁচ’ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিটারিং ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শাহেদ বিশ্বাস রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘উপরমহল যা বলে, আমি সে অনুযায়ী কাজ করি। কমিশন শব্দ থেকে আমি অনেক দূরে। এ ধরনের শব্দের সাথে আমি পরিচিতি নই’।
অন্যদিকে, এ ধরনের অভিযোগের সঙ্গে কোনও সম্পৃক্ততা নেই, দাবি করে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মিটারিং ডিভিশন আলাদা, এখানের আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই’।
ডিপিডিসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, এইচটি মিটার ও এলটিসিটি মিটার সংযোগে জটিলতা নিয়ে বেশ কয়েকজন গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে বিষয়টি উনার দৃষ্টিগোচর হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাৎক্ষণিকভাবে নির্বাহী পরিচালককে (অপারেশন) বিষয়টি সমাধানের নির্দেশ দেন। নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) সম্প্রতি কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের বোর্ড রুমে ডিপিডিসির সব প্রধান প্রকৌশলী এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানে পুরনো গ্রাহক যারা ১৬০ কিলোওয়াট পর্যন্ত ব্যবহার করেন, তাদের এইচটি মিটার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত হয়। অর্থাৎ, সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়ে তাকে এই মিটার কিনতে হবে। অথচ, এলটিসিটি মিটার ব্যবহার করলে তাকে খরচ গুনতে হতো ৪০ হাজার টাকা।
ডিপিডিসির দায়িত্বশীল আরেকটি সূত্র বলছে, গ্রাহকের কাছ থেকে এলটিসিটি মিটার ব্যবহারের জন্য অনুরোধ আসলে যদি কোনও কর্মকর্তা এর পক্ষে সুপারিশ করেন; তাহলে তাকে ডেকে নিয়ে ভর্ৎসনা করেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলাম। এমন ঘটনা কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে ঘটলেও তারা কিছু বলতে পারেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিপিডিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি গ্রাহকের স্বার্থ বিবেচনা করে এলটিসিটি মিটার দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু, আমাদের হেড অফিসে এভাবে ডেকে নিয়ে তিরস্কার করবে, তা ভাবিনি। আমি তো কোনও অন্যায় করিনি। যেহেতু, ১৬০ কিলোওয়াট পর্যন্ত উচ্চচাপের গ্রাহকদের এলটিসিটি মিটার ব্যবহার করতে দেওয়ার সুযোগ আছে, সেজন্য আমি সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু, এ ঘটনার পর থেকে আমি আর সুপারিশ করি না’।
এলটিসিটি মিটার চাইলেও তা দেওয়া হচ্ছে না, এমন অভিযোগ করেছেন একজন গ্রাহক। তার অভিযোগ, একটি ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী সম্প্রতি মিটারিং ডিভিশনকে চিঠি দিয়েছিলেন ওই গ্রাহকের এলটিসিটি মিটারটি চালু করার জন্য। সেটিও রোজার ঈদের আগে। এখন পর্যন্ত মিটারিং ডিভিশন মিটারটি চালু করেনি।
জানা গেছে, ওই জমির মালিক টাকা না থাকায় ডেভেলপার কোম্পানি দিয়ে ভবনটি নির্মাণ করেছেন। ডেভেলপার কোম্পানি ১৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছে। ৯টি ফ্ল্যাট প্লটমালিকের এবং ৯টি ডেভেলপার কোম্পানির। ডেভেলপার কোম্পানি তার ৯টি ফ্ল্যাটের জন্য ২০০ কেভিএ সাবস্টেশন নির্মাণ করে ১৬০ কিলোওয়াট লোড এলটিসিটি মিটার দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করে বিভিন্ন মালিকের কাছে ফ্ল্যাট বিক্রি করে চলে যায়। আর প্লটমালিক ৯টি ফ্ল্যাটের জন্য ২০০ কেভিএ সাবস্টেশন নির্মাণ করে এইচটি মিটার দিয়ে ১৬০ কিলোওয়াট লোড নিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়। পরবর্তীতে ওই প্লটমালিকের ভবনের অবকাঠামোর কারণে ওই মিটারটি খারাপ হলে উনি দ্বিতীয়বার এইচটি মিটার কিনে সংযোগ চালু করেন। পরে গত ৬ মাস পূর্বে ওই প্লটমালিকের আবারও এইচটি মিটারটি খারাপ হয়ে যায়। এইচটি মিটার কেনা ব্যয়বহুল হওয়ায় তিনি গত ১৮ মার্চ ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে এটার পরিবর্তে এলটিসিটি মিটারে সংযোগ চালু করার জন্য আবেদন করেন। ওই দিনই ব্যবস্থাপনা পরিচালক এলটিসিটি মিটারে ওই বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে লিখিত নির্দেশনা দেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নির্দেশনা পেয়ে ওই ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী (কপি সংযুক্ত) মিটারিং ডিভিশনের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শাহেদ বিশ্বাসের কাছে চিঠি দিয়ে ওই গ্রাহকের এইচটি মিটারের পরিবর্তে এলটিসিটি মিটারটি চালু করার জন্য অনুরোধপত্র পাঠান। এখন পর্যন্ত মিটারটি চালু করেনি মিটারিং ডিভিশন।
প্রশ্ন উঠেছে, একই বেইজমেন্টে ওই ভবনটির একপাশে ২০০ কিলোওয়াট সাবস্টেশনে ১৬০ কিলোওয়াট লোড এলটিসিটি মিটারে কীভাবে চলছে? ওই প্লটমালিক ১৬০ কিলোওয়াট লোডে এলটিসিটি মিটার না পাওয়ার কারণ কী? আর তখন শাহেদ বিশ্বাস কীভাবে মিটারিং ডিভিশন থেকে ওই ডেভেলপার কোম্পানির ১৬০ কিলোওয়াট লোডে এলটিসিটি মিটার চালু করলেন? এদিকে, ওই প্লটমালিক ৫-৬ মাস ধরে তার খারাপ হয়ে যাওয়া এইচটি মিটার পরিবর্তন না করায় গ্রাহককে ইস্টিমেটেডে (নর্মাল বিল থেকে গ্রাহককে ডাবল বিল করা হয়) বিল প্রদান করছে ডিপিডিসির কর্তৃপক্ষ; যা গ্রাহকের এখন গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি মাসেই তার দ্বিগুণ বিদ্যুৎ বিল আসছে।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘গ্রাহকসন্তুষ্টির বিষয়টি আমরা আগে অগ্রাধিকার দিই। কেউ আবেদন করলে বিষয়টি বিবেচনার সুযোগ আছে’।
এদিকে, গ্রাহকরা অভিযোগ করেছেন, তারা ডিপিডিসি থেকে আগে মিটার কিনতে পারতেন। এখন ডিপিডিসি মিটার বিক্রি করে না। ডিপিডিসি সর্বশেষ মিটার বিক্রি করেছে দেড় বছর আগে। ডিপিডিসি থেকে মিটার বিক্রয় না করায় চড়া দামে খোলাবাজার থেকে কিনতে হচ্ছে। এতে মিটারের মানও খারাপ হচ্ছে বলে জানান গ্রাহকরা। অভিযোগ উঠেছে, ডিপিডিসির পরিবর্তে খোলা বাজার থেকে গ্রাহককে মিটার কেনানোর মাধ্যমে মোটা অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য হয়।
তবে, ডিপিডিসিতে মিটার বিক্রি বন্ধ হয়নি জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার (আইসিটি অ্যান্ড মিটারিং) মো. রবিউল হাসান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘স্টকে থাকলে গ্রাহক মিটার কিনতে পারেন। আমি এ বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি। কমিশন বাণিজ্যের যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হবে, এমন কিছু আছে কি না’।
পড়ুন পর্ব-১: ডিপিডিসি: গ্রাহক বাধ্য হচ্ছেন ৯ গুণ বেশি দামে মিটার কিনতে
এনএইচ/রফিক