ঢাকা     রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৮ ১৪৩১

পর্ব-৩

অপ্রতিরোধ্য মিটার সিন্ডিকেট, অসহায় গ্রাহক

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫৫, ১ জুন ২০২৪   আপডেট: ২০:১০, ১ জুন ২০২৪
অপ্রতিরোধ্য মিটার সিন্ডিকেট, অসহায় গ্রাহক

ছবি: গ্রাফিক্স

প্রতিনিয়ত নিয়মের মারপ্যাঁচ দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহককে হয়রানি করছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) একটি সক্রিয় সিন্ডিকেট। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে— টাকা না দিলে মিটার দিতে সময়ক্ষেপণ, বিল বেশি দেখানো, সিন্ডিকেটের কাছ থেকে বেশি দামে মিটার কিনতে বাধ্য করা, নানা ধরনের নিয়ম-অনিয়মের ভয় দেখিয়ে গ্রাহকের কাছে টাকা দাবি করা হয়। আরও অভিযোগ রয়েছে— দীর্ঘদিন একই পদে থাকায় এই সিন্ডিকেট যেমন হয়ে উঠেছে প্রভাবশালী, তেমনই একেকজন পরিচিতি পেয়েছেন দুর্নীতির ‘মহীরুহ’ হিসেবে। গ্রাহকরা তাদের কাছে হয়ে পড়েছেন অসহায়।

ডিপিডিসির বেশ কয়েকটি সূত্র থেকে ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশ কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেছেন মিটারের এই সিন্ডিকেট। এর মধ্যে অন্যতম মিটারিং বিভাগের ‘মাফিয়া’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মিটারিং বিভাগের উত্তর বলয়ের (নর্থ বেল্ট) সহকারী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন। প্রায় ৯ বছর একই জায়গায় কর্মরত আছেন তিনি। তার সঙ্গে রয়েছেন মিটারিং ডিভিশনের দক্ষিণ বলয় (সাউথ বেল্ট) সাব-ডিভিশনাল (এসডি) প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরী। তিনিও প্রায় ৮ বছর একই জায়গায় কর্মরত।

সূত্র বলছে, একই পদে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকায় এই দুই কর্মকর্তার দুর্নীতির নেটওয়ার্ক গভীরে বিস্তার লাভ করেছে। স্বেচ্ছাচারিতা শুধু নয়, ঘুষ না দিলে গ্রাহকদের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার দেখিয়ে টাকা আদায়, নয়-ছয় বুঝিয়ে বাড়তি টাকা নেওয়া ও দুর্ব্যবহার তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ নোমান দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতিমুক্ত ‘স্মার্ট ডিপিডিসি’ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ প্রতিশ্রুতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে চলেছে এই সিন্ডিকেট। বেশ কয়েকজন গ্রাহকের অভিযোগ— ডিপিডিসির মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের স্পর্শকাতর এই বিভাগে থেকে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এরা। দুই প্রকৌশলী আনোয়ার-পলাশের ইশারায় চলে মিটারিং বিভাগ। তাদের কথাতেই মিটারিং বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এসি) সাহেদ বিশ্বাস ওঠেন-বসেন। এই চক্রে নাম এসেছে সাহেদ বিশ্বাসেরও। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিপিডিসির ৩৬টি ডিভিশন থেকে বিদ্যুৎ চুরির ঘটনায় জব্দকৃত মিটার টেম্পারিং ও বাইপাস করে বিদ্যুৎ চুরির মিটার জব্দ করে পরীক্ষা করার জন্য মিটারিং ডিভিশনে পাঠানো হয়। জব্দকৃত ওই মিটারে গ্রাহক কী পরিমাণ বিদ্যুৎ চুরি করেছে, তা রিপোর্ট নেওয়ার জন্য পাঠানো হয় মিটারিং ডিভিশনে। এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে গ্রাহকের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়। এ-জাতীয় বেশিরভাগ কাজের জন্য আনোয়ার-পলাশ ওই শ্রেণির গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে রিপোর্ট নয়-ছয় করে দেন। তাতে করে ডিপিডিসি হারাচ্ছে রাজস্ব। 

ডিপিডিসির অপর একটি সূত্র জানায়, এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রধান কার্যালয়ে কয়েকবার গ্রাহকদের অভিযোগের পরও রহস্যজনক কারণে প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ বিভাগ (এইচআর) তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এইচআর বিভাগের একটি সূত্র জানায়, বর্তমান দুজন প্রভাবশালী নির্বাহী পরিচালক এবং ডিপিডিসির আইসিটি বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার কারণে তাদের বিরুদ্ধে এইচআর বিভাগ কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মিটারিং বিভাগের ওই দুই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সঙ্গে শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনৈতিক আর্থিক সম্পর্ক রয়েছে।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে মিটারিং বিভাগের উত্তর বলয়ের (নর্থ বেল্ট) সহকারী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা। এখানে দুর্নীতি করার কোনও সুযোগ নেই।’

এদিকে, অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন করলে দপ্তরপ্রধানের সঙ্গে কথা বলতে বলেন মিটারিং ডিভিশনের দক্ষিণ বলয় (সাউথ বেল্ট) সাব-ডিভিশনাল (এসডি) প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমি একজন বসের আন্ডারে আছি। আমাদের স্যারেরা যেখানে পাঠান এবং যা করতে বলেন, আমরা সে অনুযায়ী করি।’

মিটারিং ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শাহেদ বিশ্বাস রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘উপরমহল যা বলে, আমি সে অনুযায়ী কাজ করি। কমিশন শব্দ থেকে আমি অনেক দূরে। এই ধরনের শব্দের সাথে আমি পরিচিতি নই।’

ডিপিডিসির মিটারিং বিভাগের একটি সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন সিন্ডিকেটটি একই জায়গায় থাকায় তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সবাই ভয়ে তটস্থ থাকেন। এদের মধ্যে একজন আরেক ‘মাফিয়া’ মিটারিং বিভাগের মধ্য বলয়ের (সেন্ট্রাল বেল্ট) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুনিম ইসলাম। তাকে সহযোগিতা করছেন তার অধীনস্থ উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন। মো. মুনিম ইসলাম মিটারিং ডিভিশনে প্রায় আট বছর যাবৎ একই জায়গায় কর্মরত রয়েছেন। একই জায়গায় কর্মরত থাকায় দুর্নীতির নেটওয়ার্ক গড়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এই মুনিম ইসলাম হলেন মিটারিং ডিভিশনের দুর্নীতির বরপুত্র। তার কাছ থেকে এলটিসিটি মিটার না কিনলে গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ করতে গিয়ে বিভিন্ন রকম টালবাহানা করেন। পরে বেশি টাকার বিনিময়ে কানেকশন দেন। প্রতিটি কানেকশন দিতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা নেন। টাকা না পেলে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ফিরে আসেন। মিটারের পিটি নষ্ট হলে যতটুকু লস হয়েছে, সেটার বিল না করে ভোল্টেজ শূন্য ধরে কয়েক গুণ বেশি বিল করেন। টাকা দিতে না চাইলে গ্রাহকদের সঙ্গে করেন খারাপ ব্যবহার। এলটিসিটি মিটারের দাম খোলা বাজারে প্রায় ৪০ হাজার, কিন্তু তার কাছ থেকে নিলে গুনতে হয় ৬০ হাজার টাকা। এইচটি মিটার ক্রয়েও সে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেশি নেয়। তার কাছ থেকে মিটার না নিলে কানেকশন দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা অজুহাত খোঁজেন এবং বেশি টাকার বিনিময়ে কানেকশন দেন। আগে মুনিম ইসলাম নিজে সব করতেন। এখন তিনি মিটারিং ডিভিশনে তার অধীনস্থ উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেনকে দিয়ে সব কাজ করান। আরিফ মিটারিং ডিভিশনে চার বছর যাবৎ একই জায়গায় কর্মরত রয়েছেন। মুনিমের দিকনির্দেশনায় আরিফ পরিচিত হয়ে উঠেছেন মিটারিং বিভাগের দুর্নীতির রাজপুত্র হিসেবে।   

দুর্নীতি ও গ্রাহক হয়রানি নিয়ে জানতে চাইলে মো. আরিফ হোসেন এসব অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, এগুলো ভুল তথ্য।

এ সম্পর্কে ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুনিম ইসলামকে ফোন দিলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। তার সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে পিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তিনি বলেন, ‘এগুলো মিথ্যা। যেটা যৌক্তিক, আমরা সে অনুযায়ী কাজ করি। আর এই অনুমোদন নিই ডিরেক্টর আইসিটি স্যারের মাধ্যমে। গ্রাহকদের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।’

ডিপিডিসির জেনারেল ম্যানেজার (আইসিটি অ্যান্ড মিটারিং) মো. রবিউল হাসান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মিটারিং বিভাগের কয়েকজনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসছে, সেগুলো আমরা খতিয়ে দেখব।’

পড়ুন

পর্ব-১: ডিপিডিসি: গ্রাহক বাধ্য হচ্ছেন ৯ গুণ বেশি দামে মিটার কিনতে

পর্ব-২: মিটারের কমিশন বাণিজ্যে সর্বস্বান্ত গ্রাহক, নেপথ্যে কারা

এনএইচ/রফিক


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়