ঢাকা     সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৮ ১৪৩১

আশ্রয়ণের ঘর

হোসনে আরাদের মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী

এসকে রেজা পারভেজ, ভোলা থেকে ফিরে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৮, ২১ জুন ২০২৪   আপডেট: ১০:১০, ২১ জুন ২০২৪
হোসনে আরাদের মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী

ছবি: রাইজিংবিডি

বেড়িবাঁধের পাশে ছোট্ট একটি নীড় ছিলো হোসনে আরার। ছেঁড়া কাপড়, কুড়িয়ে আনার কাগজ আর ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টের বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই গড়েছিলেন তার স্বামী। সেখানেই শীত, বর্ষা, গরমে অবর্ণনীয় কষ্টে দিন কাটিয়েছেন। নিজের ঠিকানা, একটি ঘর না থাকার কারণে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারেননি। দুই বছর আগে আশ্রয়ের ঘর পেয়ে দিন ফিরেছে হোসনে আরার। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। অতীত আর বর্তমানের তুলনা করতে গিয়ে চোখ ছলছল করে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তার।

‘ঘরডা পাওয়ার পর অনেক কান্দা কানছি বাবা। এই ঘর হওয়ার পর আমার একটা মেয়েরে বিয়ে দিতে পারছি। ঘরের লইগ্যা মাইডারে অনেক দিন বিয়ে দিতে পারি নাই। এই ঘরে আইছি মতো আল্লার হুমুক হইছে, সরকারে উছিলায় আমার মেয়েডারে আমি বিয়ে দিছি। আমি ঘর পাইছি, অনেক খুশি। আমার গার (গায়ের) চামড়া দিয়েও যদি শেখ হাসিনার জুতা সেলাই করেও দিই এই ঋণ শোধ করতে পারবে না’, বলছিলেন হোসনে আরা।

আরো পড়ুন:

দুই বছর আগে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার পশ্চিম এওয়াদপুর এক নম্বর ওয়ার্ডের আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পেয়েছিলেন হোসনে আরা। এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৭৫টি পরিবার পেয়েছেন নিজের একটি জমিসহ বাড়ি। এমন লাখো ভূমিহীন আর গৃহহীন, যারা সমাজে ভাসমান ছিলেন, মাথা গোঁজাই ঠাঁই ছিলো না, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে তারা এখন ঘর পেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। দেখছেন সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্ন। সম্মান আর মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছেন।

সম্প্রতি আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পঞ্চম পর্বের দ্বিতীয় ধাপে ১৮ হাজার ৫৬৬টি গৃহ ও ভূমিহীন পরিবারকে বাড়ি হস্তান্তরের পাশাপাশি তিনি ২৬ জেলার সব উপজেলাসহ আরও ৭০টি উপজেলাকে ভূমি ও গৃহহীন মানুষ মুক্ত ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত সারাদেশে ৮ লাখ ৬৭ হাজার ৯০৪ ভূমি ও গৃহহীন পরিবারের প্রায় ৪৩ লাখ ৪০ হাজার মানুষকে আশ্রয়ণ এবং অন্যান্য কর্মসূচির আওতায় পুনর্বাসন করা হয়েছে। শুধুমাত্র আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে ৫ লাখ ৮২ হাজার ৫৩ ভূমি ও গৃহহীন পরিবারের ২৯ লাখ ১০ হাজার ২৬৫ জনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

চরফ্যাশনের এওয়াদপুরের এক নম্বর আদর্শ গ্রামে ঘর পেয়ে খুশির শেষ নেই ইয়ানুর বেগমের। এক ছেলে, এক মেয়ে আর স্বামী নিয়ে এখন তার সুখের সংসার। অথচ দুই বছর আগেও ছিলো অনিশ্চয়তার সাগরে দোদুল্যমান।

তিনি জানান, এক সময় শহরে ভাসমান মানুষের মতো থেকেছেন। গ্রামে এসে অন্যের জমিতে থেকেছেন। কল্পনা করতেন নিজের একটি ঘর হবে। সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন শেখ হাসিনা।  সেই কথা বলতে গিয়ে ইয়ানুর বলেন, ‘ঘর পেয়ে আমরা খুব খুশি। আগে চেয়ারম্যানের বাড়ির কাছে অন্যের জমিতে ছুপরিঘর করে থাকতাম। শহরে কাম করছি, আর খাইছি। সারাজীবন কি শহরে থাকা যায়? কিন্তু আমগো তো কিছুই নাই। এই ঘর পাইয়া কি যে উপকার হইছে। আগে তো মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিলো না। এহন নিজের ঘরে থাকতে পারি, ঘুমাইতে পারি ঠিক মতোন।’

আশ্রয়ণের ঘর পেয়ে এখন নতুন দিনের স্বপ্ন দেখেন খায়রুন নাহার। স্বামী, এক ছেলে আর মেয়ে নিয়ে তার সুখের সংসার। অথচ এক সময় এখানে সেখানে ছন্নছাড়া জীবন ছিলো তার। দুই বছর আগে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ভোলা চরফ্যাশনের দক্ষিণ জাহানপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পাঁজকপাট এলাকায় জমিসহ ঘর পেয়েছেন তিনি। স্বামী নদীতে মাছ ধরে আর ছেলে মেয়েরা স্কুলে যায়। এই খায়রুন নাহারই এক সময় অনিশ্চিত জীবন কাটাতেন। ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নেও শঙ্কা তাড়িয়ে বেড়াতো তাকে।

একই সময়ে ঘর পেয়েছিলেন সাজেদা বেগম। আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা জানালেন তিনি।

‘অনেক লাত্থিগুতা খাইছি। আজ এইখানে তো কাল ওইখানে। কেউ দাম দিতো না। এক সময় ভাইবতাম ঘর কি হইবো না। এহন হইছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঘর দিছে। আমরা অনেক শান্তিতে আছি।’

উপকারভোগীদের আরেকজন ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘নিজেদের কোনো জমি ছিলো না। সরকার ঘর দেওয়ার যে কি উপকার হইছে তা বলে শেষ করা যাবে না। এখন অন্তত একটা থাকার জায়গা হইছে।’

ভোলার জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান বলেন, ‘নিঃস্ব, অসহায় মানুষকে যাতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা যায়, একই সাথে আশ্রয়ণ প্রকল্পের যে মূল উদ্দেশ্য আমাদের সামাজিক সুরক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য, সেগুলো কিন্তু এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের যারা উপকারভোগে রয়েছেন, তাদেরকে সরকার নিশ্চিত করছে। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কাজ করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, তাদের যে সন্তান রয়েছে, সেসব সন্তান যাতে উন্নত, সমৃদ্ধ, স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য উপযোগী হয়ে উঠতে পারে, সেজন্য যথাযথভাবে শিক্ষা পায় সেই বিষয়ে নজর দেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী সারাদেশে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রথম ধাপে ৬৩ হাজার ৯৯৯টি, দ্বিতীয় ধাপে ৫৩ হাজার ৩৩০টি, তৃতীয় ধাপে ৫৯ হাজার ১৩৩টি এবং চতুর্থ ধাপে ৩৯ হাজার ৩৬৫টি বাড়ি বিতরণ করেন। প্রকল্পের আওতায় ভূমি ও গৃহহীন প্রতিটি পরিবারকে দুই দশমিক ৫ শতাংশ জমির মালিকানা দিয়ে একটি আধা-পাকা বাড়ি দেওয়া হচ্ছে, যা স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই হবে। প্রতিটি বাড়িতে দুটি বেডরুম, একটি রান্নাঘর, একটি টয়লেট এবং বারান্দা রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে গৃহহীনদের পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহ ও ভূমিহীনদের ঘর ও জমির মালিকানা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে, ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৭ লাখ ৭১ হাজার ৩০১টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। পুনর্বাসিত মানুষের সংখ্যা ৩৮ লাখ ৫৬ হাজার ৫০৫ জন (একটি পরিবারে ৫ জন ব্যক্তি হিসাবে)।

/এসবি/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়