ঢাকা     রোববার   ৩০ জুন ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৬ ১৪৩১

জিরো টলারেন্স নীতি: তবু লাগামহীন দুর্নীতি, আ.লীগে অস্বস্তি

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৯, ২৭ জুন ২০২৪   আপডেট: ১১:৩৮, ২৭ জুন ২০২৪
জিরো টলারেন্স নীতি: তবু লাগামহীন দুর্নীতি, আ.লীগে অস্বস্তি

টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের আগে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনি ইশতেহার দিয়েছিলো, তাতে গুরুত্ব পেয়েছিলো ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি’। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের পর ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’র অগ্রযাত্রায় দুর্নীতিকেই এখন মূল প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মনে করছেন দলের নেতারা। 

সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে দায়িতত্বশীল কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে থাকায় বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা বলছেন, দুর্নীতি সরকারের সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। জিরো টলারেন্স নীতির পরেও দুর্নীতি দমন করতে পারেনি বা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এখনই বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে দুর্নীতির এই বিস্তার রোধ করা না গেলে হিমশৈলের ধাক্কায় দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির সলিলসমাধি হবে।

সম্প্রতি সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের দুর্নীতি। এই পুলিশ প্রধানের সম্পত্তি নিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূতভাবে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের প্রমাণও পেয়েছে। এসব কারণে বেনজির আহমেদ ও তার পরিবারের সম্পত্তি জব্দ এবং ব্যাংক একাউন্ট জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। দুদক বলছে, এখনও তার সম্পদের অনুসন্ধান চলছে। বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির খোঁজ মেলা নিয়ে আলোচনা থামতে না থামতেই আবার শুরু হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের খবর।

অন্যদিকে, দুর্নীতি নিয়ে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কমিশনার (শুল্ক ও আবগারি) এবং ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মতিউর রহমানের বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচার। এই বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত লোপোটের খবর।

সরকারের দায়িত্বশীলদের লাগামহীন দুর্নীতি, অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পাওয়ায় সরকারের সমালাচনায় মুখর বিএনপি। বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছেন না আওয়ামী লীগের নেতারাও। তারা বলছেন, যে বিএনপি পাঁচবার দেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান বানিয়েছে, তারাও এখন দুর্নীতি নিয়ে কথা বলে! যেখানে আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে আজ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত করিয়েছে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে এখন অন্যভাবে দেখা হয়, সেখানে সরকারের বিভিন্ন সেক্টরের দুর্নীতিবাজদের জন্য ঢালাওভাবে সরকারের সমালোচনা করা হচ্ছে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং সংসদ সদস্য  বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘‘দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সরকারি বা বেসরকারি যে কোনো দলের বা সংস্থার হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে। ঋণ খেলাপি, অর্থপাচারকারী, ব্যাংক লুটেরা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সিন্ডিকেট যারা করে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদের তালিকা প্রণয়ন করে জাতির সামনে উপস্থাপন করা প্রয়োজন।’’

বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে এই দুষ্টচক্র, সর্বগ্রাসী, স্বার্থন্বেষী চক্রের হাত থেকে দেশের জনগণকে রক্ষা করতে হবে বলেও মত দেন আওয়ামী লীগের এ নেতা।

আওয়ামী লীগ মনে করে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জাতির নৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হল দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইস্পিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয় না। কেবল আইন প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স এবং কেউ দুর্নীতি করে ছাড় পাবে না জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদক আছে। দুদক সম্পূর্ণ স্বাধীন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান জিরো টলারেন্স। এক্ষেত্রে তিনি অটল।’

তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি যেই করুক, এক্ষেত্রে সরকারের জিরো টলারেন্স। দুদকের দুর্নীতির তদন্ত করার অধিকার রয়েছে এবং এখানে সরকার তাদের স্বাধীনতায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না।’

জিরো টলারেন্স নীতির পরেও দুর্নীতি দমন বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘দুর্নীতি সরকারের সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। সরকারি কর্মচারীদের দফায় দফায় বেতন বাড়ানো হয়েছে। তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তারপরও কেন দুর্নীতি হবে?’

তিনি বলেন, ‘এরকম হাজার হাজার মতিউর আছেন। দফায় দফায় বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। তারপরও দুর্নীতি কমানো সম্ভব হয়নি। দুর্নীতির বিধিবিধানকে বরং আরও নমনীয় ও শিথিল করে দেওয়া হয়েছে। নামমাত্র দণ্ড দিয়ে তাদের চাকরিতে বহাল রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে।’ 

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যা আছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে: আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে ৩.২ এর ‘সুশাসন’ অধ্যায়ের ‘চ’ ধারায় বলা হয়েছে, জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সমাজ তথা রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতির মুলোৎপাটন করা হবে।এতে অঙ্গীকার করা হয়েছে,

১. দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতি মোকাবিলায় কার্যকর পন্থা ও উপায় নির্বাচনপূর্বক তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। 

২. জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঘুষ, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য ও দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ চলমান থাকবে।

৩. প্রশাসনে দুর্নীতি নিরোধের জন্য ভূমি প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, আদালত, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সকল ক্ষেত্রে সূচিত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণ করা হবে।

৪. শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলার জন্য পাঠ্যক্রমে দুর্নীতির কুফল ও দুর্নীতি রোধে করণীয় বিষয়ে অধ্যায় সংযোজন করা হবে।

রাজনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের জিরো টলারেন্স নীতি দুর্নীতির মাত্রা ক্রমহ্রাসমান থাকলেও সম্প্রতি তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দুর্নীতি রুখে দেওয়া না গেলে উন্নত ও সমৃদ্ধ যে আগামীর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে, তা সুদূর পরাভূত হবে।

তারা বলছেন, জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে তাদের গ্রেপ্তারে অনুমতি নেওয়া লাগে না। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে একই ধরনের মামলা হলে তাকে গ্রেপ্তারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিতে হয়। সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি করতে উৎসাহিত করেছে। এই আইনের কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের আইনের আওতায় আনতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটা কার্যত অপরাধী সুরক্ষা আইন হিসাবে বিবেচিত। আইনটি পুনর্বিবেচনার দবি তুলেছেন তারা।

দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে প্রথমে ভোগের রাস্তা বন্ধ করতে হবে জানিয়ে বিশেজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনের আগে রাজনীতিবিদদের হলফনামা দিতে হয়, সব সম্পদের বিবরণ দিতে হয়। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের হলফনামা দিতে হয় না। চাকরিতে নিয়োগের সময় হলফনামা বাধ্যতামূলক এবং প্রতি পাঁচ বছর পর বা পদোন্নতির সময় হলফনামা দিতে হলে তার সম্পত্তির পরিমাণ জাতি জানতে পারবে।

সরকারের বিভিন্ন সেক্টরের দুর্নীতিবাজদের কঠোর সমালোচনা করে লালমনিরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন বলেন, ‘সব পলিটিশিয়ানরা নাকি দুর্নীতি করে। আর উনারা সব কিছু ঠিক করেন, অন্য কিছু করেন না। বাড়ি-গাড়ি করে দেশে-বিদেশে, বেগমপাড়ায়, আর কোন কোন পাড়ায় বাড়ি করে, সুইস ব্যাংকে টাকা রাখে। আজকে দোষ কিন্তু আমাদেরই, পলিটিশিয়ানদের।’

এনবিআরের আলোচিত কর্মকর্তা মতিউর রহমানের মতো আরও কোনো মতিউর রহমান আছেন কি না, তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে খুঁজে বের করার আহ্বান জানান সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।

তিনি বলেন, ‘বিশেষ কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তখন তার সংস্থা, গোষ্ঠী বা অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দুর্নীতিবাজের পক্ষে সাফাই বক্তৃতা, বিবৃতি দেয়, যা প্রকারান্তরে ওই বিশেষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের দায় সংস্থাগুলো নেয়। পুরো সংস্থার ওপর চলে আসে এ দায়। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’

১৪ দলীয় জোটের শরিক নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘এখনই বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে দুর্নীতির এই বিস্তার রোধ করা না গেলে হিমশৈলের ধাক্কায় দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির সলিলসমাধি হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘বিএনপির আমলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচ-পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। দেশ এখন সে কলঙ্ক থেকে মুক্ত হলেও এখনো শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে। বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির যে চিত্র সম্প্রতি বেরিয়ে আসছে, তা দেশের ভাবমূর্তি কেবল নয়, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জনমনে অনাস্থা সৃষ্টি করছে।’ 

পারভেজ/ইভা 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়