সংকটেও আশা
‘রেমাল’ ক্ষত নিয়ে ইলিশ শিকারে জেলেরা
যেখানে ছিল বাড়ি, সেখানে এখন জোয়ারের পানি। ছবি: রফিকুল ইসলাম মন্টু
বাড়িঘরের কংকালগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির উঠোন, পুকুরঘাট, কলপাড়, খেলার মাঠ, এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যাওয়ার গলি— সবই যেন একাকার। কেউ বসবাস করছেন ভাঙা ঝুপড়ি ঘরে, কেউবা ঘরের চালা ঠিক করতে পারেননি। অনেকে ভাঙা ঘরের চালা একত্রিত করে তার ভেতরেই কোনমতে দিন কাটিয়ে দিচ্ছেন। বিধ্বস্ত ঘরের আসবাবপত্র, মাছ ধরার ট্রলারের ভাঙা অংশ এখনো পড়ে আছে নদীর ধারে। সাইক্লোন রেমাল-এর দুইমাস পরেও বাংলাদেশের দক্ষিণে সমুদ্র উপকূলের মোহনায় জেগে থাকা ঢালচরের অবস্থা এমনই। কিন্তু এর মধ্যেই ইলিশ ধরার সব আয়োজন গোছাতে হয়েছে জেলে, আড়ৎদার, দোকানদারসহ সকলকে। ঘর গোছানো শেষ হওয়ার আগেই প্রবল সাইক্লোন রেমাল-এর দগদগে ক্ষত নিয়ে এই দ্বীপের জেলেরা নদী-সমুদ্রে ইলিশ ধরতে নেমেছেন।
২৩ জুলাই থেকে সমুদ্রে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় ইলিশের ঘাটগুলো জমজমাট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। মার্চ-এপ্রিল দু’মাস ঝাটকা ইলিশ (ছোট ইলিশ) ধরার নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর পহেলা মে থেকে নদী ও সমুদ্রে ইলিশ ধরা শুরু হয়। কিন্তু ২০ মে থেকে পুনরায় সমুদ্রে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়; যা শেষ হয়েছে ২৩ জুলাই মধ্যরাতে।
এ বছর প্রবল সাইক্লোন ‘রেমাল’ বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকায় ইলিশ ধরার প্রস্তুতিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেমাল স্থলভাগ অতিক্রম করেছিল ২৬ মে সন্ধ্যা থেকে ২৭ মে সকাল নাগাদ। এটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। কিন্তু এই সময় জেলেদের ইলিশ-প্রস্তুতির মৌসুম। অন্যদিকে রেমাল-এর দু’মাস যেতে না যেতেই ঢালচরের মানুষের সামনে এসে দাঁড়ায় প্রধান ইলিশের মৌসুম। ফলে তাদের ধারদেনা করে, মহাজনদের কাছ থেকে অতিরিক্ত দাদন নিয়ে ইলিশ ধরা শুরু করতে হয়েছে। এদিকে ইলিশ ধরা শুরু হতে না হতেই কারফিউ’র প্রভাব পড়েছিল। সামান্য ইলিশ যা পাওয়া গেছে, তা বাজারজাতকরণে ছিল সমস্যা। ফলে অনেককে লোকসান গুনতে হয়েছে। শুধু ঢালচরের মানুষেরা নয়, গোটা উপকূলের মাছধরা পেশায় নিয়োজিত মানুষ এই সংকট মোকাবিলা করেছে এবার ইলিশ মৌসুমের শুরুতেই।
ইলিশকালের ঢেউ আনন্দবাজারে
কে কোন ট্রলারে ইলিশ ধরবে! কে কার ভাগীদার হবে! সুযোগ-সুবিধার সমীকরণটা কেমন— এ সব নিয়ে দর কষাকষি হতে থাকে ইলিশের মূল মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই। এরপর অনেকে ট্রলার নিয়ে সমু্দ্রে নেমেছেন। কিন্তু সংকটের কারণে অনেকে এখনো সমুদ্রে নামতে পারেননি। অনেক আড়ৎও চালু হয়নি পুরোদমে। দূর থেকে ঢালচরে আসা জেলেদের অনেকে এখনো ট্রলারগুলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আলোচনায় ব্যস্ত। ঢালচরের আনন্দবাজার যেন সেই আলোচনারই কেন্দ্রবিন্দু। চায়ের দোকান, হোটেল কিংবা বাজারের মুক্ত প্রান্তরে একই আলোচনা। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নতুন-পুরানো জেলেরা এখানে এসে একটি মৌসুম ইলিশ ধরায় নিয়োজিত হয়।
রেমাল-এর আঘাতে ঢালচরের ঘর হারানো মানুষ
চরফ্যাসন উপজেলার দক্ষিণে কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে ছোট লঞ্চটি এসে শেষ বেলায় ভেড়ে আনন্দবাজার ঘাটে। আগে লঞ্চ ভেড়ার আরো কয়েকটি ঘাট থাকলেও এখন ঢালচরের প্রাণকেন্দ্র আনন্দবাজার। লঞ্চ থেকে এখানেই নেমে যায় অধিকাংশ যাত্রী। অন্য মৌসুমে প্রায় ঘুমিয়ে থাকা এই বাজার ইলিশের মৌসুমে জেগে ওঠে। সন্ধ্যা থেকে অধিক রাত অবধি এখানে জেলে, আড়ৎদার, মহাজন, ব্যবসায়ীসহ সব শ্রেণীর মানুষের আনাগোনা। সূর্যবাতির মিটমিটে আলো জ্বলে কোথাও; কোথাও বা জেনারেটরচালিত ঝকঝকে বাতির ঝলক। বিদ্যুৎ স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর থেকে যে আলো ছড়ায়, তা আনন্দবাজারের গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ। শত চেষ্টায়ও, জীবন বাজি রেখেও, জেলে জীবনে সে আলো আসে না। মৌসুম শেষে অধিকাংশ জেলে খালি হাতে বাড়ি ফেরেন। আবার সেই ধারদেনা, ঋণ করা, সংকটে চলা। তবুও ইলিশের আশায় জেগে থাকে জেলেমন; হয়তো কয়েক ঝাঁক চকচকে ইলিশ তার জীবনে ফেরাবে সমৃদ্ধি।
শুধু আনন্দবাজার নয়, এমন আরো বেশি কয়েকটি বাজার ছিল ঢালচরে; যা গত দশ বছরের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে মেঘনার ভাঙনে। ইলিশের অনেকগুলো ঘাটও ছিল; যেখানে শত শত মাছধরা ট্রলার এসে ভিড়ত। পুরানো বাজার হিসাবে কেবল আনন্দবাজারই এখনো নদীর ভাঙনমুক্ত আছে। দ্বীপের হাওলাদার বাজারটি কয়েক বছর আগে বিলীন হয়েছিল। যদিও সে বাজারটি নতুন করে বনের নিকটে গড়ে উঠেছে। তবে সেটি এখনো জমজমাট হয়নি। আনন্দবাজার থেকে নদীর ভাঙন খুব কাছাকাছি; অন্যদিকে হাওলাদার বাজার ভাঙনের অনেক দূরে। মৌসুমে হাওলাদার বাজারেও ভিড় জমে জেলে, আড়ৎদার এবং দোকানদারদের। পশ্চিম আকাশে বেলা ডুবে যায়; সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত গভীর হতে থাকে; অধিক রাত অবধি এ বাজারেও চলতে থাকে চায়ের আড্ডা আর ইলিশ ধরার নানা আয়োজন ও প্রস্তুতি।
বাড়ির ভিটেয় পড়ে আছে মাছধরা নৌকার অংশ
‘ইলিশের এই মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করি। এই কয়েকটি মাস খাটুনি দিয়ে আয় করার চেষ্টা করি। কখনো পারি, আবার কখনো খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়।’ বলছিলেন ঢালচরে ইলিশ ধরতে আসা জেলে হাবিবুর রহমান। তার মতো এমন আরো পুরানো এবং নতুন অনেক জেলের সাথে সাক্ষাত হয়। সংকটের মধ্যেও সকলের কথায় আশা প্রতিফলিত হয়। ইলিশ ধরতে আসা জেলে আনিচুর রহমান বলেন, ‘সাইক্লোন রেমাল-এ অনেক ক্ষতি হয়েছে। বাড়িঘর এখনো ঠিক করতে পারিনি। তবুও সময়মত ইলিশ ধরতে এসেছি। কারণ আগেই মহাজনের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়েছিলাম।’ এদের মতো আরো অনেক জেলে ইলিশ ধরার জন্য মহাজনদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেয়। কিন্তু গোটা মৌসুম কঠোর পরিশ্রম করেও খুব কম সময়েই জেলেরা লাভের মুখ দেখে।
শুধু ঢালচর নয়, ভোলার দক্ষিণে সমুদ্র লাগোয়া চরফ্যাসন উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় চোখে পড়ে ইলিশ ধরার প্রস্তুতি। বেতুয়া লঞ্চঘাটে নেমে ঢালচর অবধি যেতে এমন নানান দৃশ্য চোখে পড়ে। মাছঘাটগুলো খুব ব্যস্ত। মাছের আড়তে জেলেদের আনাগোনা বাড়ছে।
রেমাল-এর ক্ষত স্পষ্ট
পড়ন্ত বেলায় ছোট্ট লঞ্চটি কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে এসে ধাক্কা খেলো ঢালচরের আনন্দবাজার ঘাটের ভঙ্গুর তীরে। ঘাটে অনেক মানুষের ভিড়। শুকনো মুখ, কংকালসার দেহ অথবা উদোম শরীরে নদী তীরে খেলছে শিশুদের দল। পুরুষের পাশাপাশি অপেক্ষমান কতগুলো নারী। হয়তো স্বজনদের অপেক্ষায় অনেক আগেই ঘাটে এসে অপেক্ষা করছেন কেউ কেউ। প্রতিদিন একই সময় ভয়াল নদী পাড়ি দিয়ে লঞ্চটি এখানে ভেড়ে। লঞ্চের সিঁড়ি বেয়ে ঢালচরে পা রাখতেই চোখে ভেসে ওঠে ধ্বংসস্তুপ। সাইক্লোন রেমাল যে এখানকার মানুষদের ওলটপালট করে দিয়ে গিয়েছিল, তার চিত্র এখানে স্পষ্ট। গত দশ বছর ধরে তীব্র ভাঙনে ঢালচর খুব ছোট হয়ে গেছে। তার ওপর প্রতিটি সাইক্লোন-জলোচ্ছ্বাস এই দ্বীপের মানুষদের কাঁদিয়ে যায়।
সংকটের মধ্যেও আশা! জেলেরা ইলিশ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন
সাইক্লোন রেমাল-এর দু’মাস অতিবাহিত হলেও ঘরদোর ঠিক করতে পারেননি ঢালচরের অনেক মানুষ। ইলিশ মৌসুমের ঠিক আগে সাইক্লোনের আঘাত দ্বীপের মানুষদের চরম বিপাকে ফেলেছে। জেলেরা মহাজনদের কাছ থেকে যখন অগ্রিম টাকা নিয়ে জালনৌকা গোছানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন; ঠিক তখনই সাইক্লোনের আঘাত। সাইক্লোনে দ্বীপটি পুরোপুরি ডুবে গিয়েছিল; ভেসে গেছে অনেক বাড়িঘর। সরেজমিনে দ্বীপটি ঘুরে চোখে পড়ে বহু বাড়িঘরের ধ্বংসস্তুপ। যে ট্রলার দিয়ে জেলেরা মাছ ধরতে যাবে, সেই ট্রলারের কংকাল পড়ে আছে বাড়ির দরজায়। কোথাও বসত ঘরটি উড়িয়ে নিয়েছে; কিন্তু কিছু আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে বাড়ির ভিটেয়। অনেকে বিধ্বস্ত ঘরের চালা-বেড়া জোড়া লাগিয়ে ঝুপড়ি বানিয়ে বসবাস করছে।
‘ঘর এবং ঘরের আসবাবপত্রসহ প্রায় তিন লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এখন ঘর গোছানো আর ইলিশের জাল-নৌকা গোছানোর কাজ একই সাথে করতে হচ্ছে।’ — বলছিলেন ঢালচরের নিরব হোসেন। এই পরিবারটি রেমাল-এ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইলিশ ধরা তার প্রধান পেশা। কিন্তু রেমাল তার সামনে সংকটের পাহাড় রেখে গেছে। রেমাল আঘাতের পর বেশ কয়েকদিন অন্যের বাড়িতে বসবাস করেছেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। কিন্তু এভাবে কতদিন! নিরুপায় নিরব হোসেন মাসিক এক হাজার টাকা ভাড়ায় আবাসন প্রকল্পের একটি ঘরে বসবাস করছেন।
আরেকজন নাছির মিয়া। নিরব হোসেনের মতোই। বয়স ৬০ বছর পেরিয়েছে। সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন ঢালচরের ভদ্রপাড়ায়। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে ভোলার লালমোহন থেকে ঢালচরে এসেছিলেন। সেই থেকে বহুবার ঝড়ের কবলে পড়েছেন। নদীর ভাঙনে সব হারিয়েছেন। কথা বলতে বলতে তার মনে পড়ে বাবার সহায়-সম্পদের কথা, সুদিনের কথা। ক্ষয়ে ক্ষয়ে জীবনের সব শেষ হয়েছে। সর্বশেষ মাত্র দু’মাস আগে সাইক্লোন রেমাল তার ঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। শূন্য ভিটেয় দাঁড়িয়ে তার হাহাকার — ‘এখন বাকি জীবন কীভাবে কাটবে?’
সাহায্য সামান্যই
প্রাকৃতিক বিপদের মুখে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দ্বীপের এই মানুষদের জন্য সাহায্য আসে সামান্যই। যাদের সাথে কথা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই বলেছেন সাইক্লোন রেমাল-এর পরে বিশেষ কোনো সহায়তা তারা পায়নি। অনেকে জরুরি খাদ্য সহায়তা পেলেও ঘরদোর ঠিক করে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য স্টার্ট ফান্ড-এর অর্থায়নে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশন। আরো কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। আবদুল জলিল বলেন, আমরা এই দ্বীপের মানুষেরা ছোটখাট কোনো প্রাকৃতিক বিপদের ঘটনায় সাহায্য পাই না। রেমাল-এর মতো বড় বিপদ এলে বিভিন্ন সংস্থা থেকে সাহায্য দেওয়া হয়। এবারও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ সাহায্য ক্ষতির তূলনায় অনেক কম।
তারা//