তদারকির অভাবে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
দেশে প্রসাধন ও পার্সোনাল কেয়ার পণ্যের চাহিদা অনেক। ক্রমবর্ধনশীলও। এ কারণে বিদেশ থেকে প্রচুর পণ্য আনা হয় দেশে। এর মধ্যে অধিকাংশ পণ্যই আসে চোরাইপথে কিংবা লাগেজে করে। এক্ষেত্রে অনেক ব্যবসায়ী ডিকলারেন্স ভ্যালু কম দেখায়, আবার লাগেজ ব্যবসায়ীরা তুলনামূলক কম শুল্ক দিয়ে বিদেশি পণ্য আমদানি করেন। উভয় কারণেই সরকার রাজস্ব আয় বঞ্চিত হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রসাধন শিল্পের বাজারে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যে কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে রপ্তানি আয় থেকেও। এ খাতে দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বড় বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করার মতো গ্লোবাল মানের পণ্য উৎপাদন করছে এসব প্রতিষ্ঠান।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রসাধনী পণ্য রপ্তানি থেকে বিলিয়ন ডলার আয়ের সুযোগ রয়েছে। এমনকি তদারকির অভাবে নকল প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। এতে গ্রাহকরা আর্থিকভাবে প্রতারিত হচ্ছেন, পড়ছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। চ্যালেঞ্জ দুটি হচ্ছে সরকারের নীতি-সহায়তার অভাব এবং পর্যাপ্ত তদারকির অভাব।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব কারণে যে খাত থেকে সরকারের হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় সম্ভব, সেখানে আয় হচ্ছে এক তৃতীয়াংশেরও কম। আর নকল প্রসাধনীর কারণে যে পরিমাণ স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিচ্ছে, তার ব্যয় যোগ করলে এর পরিমাণও হবে কয়েকশ কোটি টাকা। চিকিৎসকরা বলছেন, নকল ও ভেজাল প্রসাধনী সামগ্রীর কারণে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ হয়, ক্যানসারও হতে পারে।
অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন বলেন, বিশাল এই প্রসাধন ও স্কিন কেয়ার পণ্যের বাজারে মাত্র পৌনে ৩০০ কোটি টাকার রাজস্ব আসে। অথচ এটা কয়েক হাজার কোটি টাকা হওয়া উচিৎ। এজন্য কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর পাশাপাশি পলিসিগত সাপোর্টের অভাব রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারের নীতি-সহায়তা পেলে, পলিসি সাপোর্ট পেলে প্রসাধনী পণ্যের রপ্তানি বাড়বে। রপ্তানি আয় বাড়লে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে, মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য বড় বড় কোম্পানিও এই খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। ফলে সামগ্রিক দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যাবে।
গবেষণা সংস্থা লাইট ক্যাসল পার্টনার্স এবং অ্যালাইড মার্কেট রিসার্চ জানিয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে আনুমানিক ১ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের স্কিনকেয়ার ও কসমেটিক পণ্য বিক্রি হয়েছে। ২০২৭ সালের মধ্যে এই পরিমাণ ২ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে তারা প্রাক্কলন করছে।
প্রসাধনী আমদানিকারক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনী আমদানি করে।
দুই বছর আগে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে এ শিল্পের বিভিন্ন অসঙ্গতি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যথাযথ প্রক্রিয়ায় কসমেটিকস পণ্য আমদানি না করায় সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য উল্লেখ না থাকায় দামের দিক থেকে ভোক্তারাও প্রতারিত হচ্ছেন। একই সঙ্গে বৈধ ও অবৈধ আমদানিকারক, ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে, যেখানে বৈধ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কিছু কাস্টমস কর্মকর্তার সহযোগিতায় ফ্রেইট এজেন্সিগুলো অবৈধভাবে অনেক পণ্য ছাড়িয়ে নেয়। এতে সুষ্ঠু ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়, আমদানিকারকদের প্রাইসট্যাগ ফেলে দিয়ে প্রাইসগান মেশিনের সাহায্যে খুচরা বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো মূল্য নির্ধারণ করে থাকেন।
এ খাতের ব্যবসায়ীদের নিয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরের আয়োজিত এক সভায় ব্যবসায়ীরা বলেন, লাগেজ ব্যবসায়ীরা তুলনামূলক কম শুষ্ক দিয়ে বিদেশি পণ্য আমদানি করেন। কসমেটিকস পণ্যের আমদানিকারকদের হয়ে ফ্রেইট এজেন্সিগুলো এতে জড়িত থাকে। কিছু পণ্যের শুল্ক বেশি থাকায় বাজারে অনেক সময় সেসব পণ্যের সরবরাহ কমে যায়। তখন অসাধু ব্যবসায়ীরা সেসব পণ্য নকল করে বাজারে ছাড়েন।
কাস্টমস সংক্রান্ত জটিলতা দূর হলে নকল পণ্য তৈরির প্রবণতা কমবে বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেন।
প্রতিবেদনটিতে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কসমেটিকস পণ্য আমদানি রোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা ও সঠিক মানদণ্ড নিশ্চিত করতে বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
এতে আরও বলা হয়েছে, আমদানিকারক ও খুচরা বিক্রেতাদের প্রদত্ত সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় মূল্যের চেয়ে বেশি দামে কেউ যেন কসমেটিকস বিক্রি না করে সে বিষয়ে তদারকি জোরদার করতে হবে।
দোকানদার এবং খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাপক চাহিদার কারণে দেশে বিদেশি ব্র্যান্ডের নকল কসমেটিকস পণ্য তৈরি করে বিদেশি পণ্য হিসেবে বিক্রয় করা হয়। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী আসল ব্র্যান্ডের মোড়ক বা কৌটা সংগ্রহ করে তাতে নকল প্রসাধনী ঢুকিয়ে বাজারে সরবরাহ করছে। এসব নকল ও মানহীন প্রসাধনসামগ্রীর মাধ্যমে অনৈতিকভাবে মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি তারা শিশুসহ সব বয়সী মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে ক্ষতির মুখে।
জানা গেছে, এসব প্রসাধনী সামগ্রী ঢাকার চকবাজার, কেরানিগঞ্জ ও আশেপাশের অবৈধ ও নিন্মমানের কারখানায় তৈরি হয়। এসব কারখানায় দেশের বিভিন্ন কোম্পানি ও বিদেশি নামকরা কোম্পানির পণ্য হুবহু নাম অথবা নামের একটি অক্ষর পরিবর্তন করে থাকে। আবার দেশের কিছু জনপ্রিয় পণ্যও এসব কারখানায় তৈরি হয়। যেমন-মেরিলের অনুকরণে লেখা হয় মারিল, মেরিট, মরিল ও মোরিন। জুঁই নারকেল তেলের অনুকরণে জুহি ও জুন, তিব্বতের অনুকরণে বিব্বাত ও তিবত লেখা হয়। এ্যারোমটিককে অনুসরণ করে এ্যারোমা, এ্যারোমেকি ও এ্যারোমেরিট ইত্যাদি।
আরও জানা গেছে, বিদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে খালি কৌটা কিনে নকল পণ্য ঢোকানো হয়। যখন এসব পণ্য দোকানে বিক্রি করা হয় তখন আসল পণ্যর সঙ্গে এগুলোর দামের অনেক পার্থক্য থাকে। আমদানি করা প্রসাধনীর প্যাকেট বা মোড়কে নকল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, অনুমোদন, বিএসটিআই এর লোগো, ব্যাচ নং, এমআরপি, এমএফজি, ট্যাক্স অ্যান্ড ভ্যাট, মেয়াদ, তারিখ উল্লেখ থাকে। ফলে দেখে বোঝার উপায় নেই কোনটি আসল, আবার কোনটি নকল। অনেকে আসল নকল বুঝতে না পেরে এগুলো কিনে প্রতারিত হন। ফুটপাত থেকে শুরু করে স্থানীয় বাজারের দোকানগুলোয় এসব ভেজাল ও নকল সামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে। আবার প্রান্তিক পর্যায়ে ফেরি করেও বিক্রি করা হয় ক্ষতিকর এসব প্রসাধনী। আসল নামে তৈরি করা এসব নকল পণ্য খুবই কম মূল্যে বাজারে ছাড়া হয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে এগুলোর আসল-নকল বোঝা কঠিন। এসব নকল কসমেটিকস পণ্য ব্যবহার করে চর্মরোগসহ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরছেন ভোক্তারা।
এসব অবৈধ তৎপরতা ঠেকাতে অধিদপ্তর, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা সংস্থার তদারকি অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছে দেশের প্রকৃত উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা।
রিমার্ক এইচবি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল আম্বিয়া বলেন, আমদানিকারক ও খুচরা বিক্রেতাদের প্রদত্ত সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় মূল্যের চেয়ে বেশি দামে কেউ যেন কসমেটিকস বিক্রয় না করে সে বিষয়ে তদারকি জোরদার করতে হবে।
তিনি বলেন, প্রসাধনীর পুরো বাজার অনেক সম্ভাবনাময়। দেশে গুণগত মানের পণ্য উৎপাদন করতে পারলে আমদানিনির্ভরতা কমবে। তাতে ডলার সাশ্রয় হবে, কর্মসংস্থানও বাড়বে। সে চিন্তা থেকে বড় পরিসরে এ খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, ভেজাল পণ্য বিক্রি এবং ভোক্তাদের প্রতারিত করার প্রবণতা বন্ধে অধিদপ্তর নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে। নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল পণ্য বিক্রি করায় প্রায়ই প্রতিষ্ঠানকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে আর্থিক জরিমানা করা হয়। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান পরিচালনা অব্যাহত থাকবে।
/এসবি/