চাকরির প্রলোভনে অনৈতিক সম্পর্ক, পিটুনিতে প্রাণ যায় জেপি নেতা সালামের
আব্দুস সালাম মিয়া (সংগৃহীত ছবি)
সরকারি চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ২৫ বছরের তরুণীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেন জাতীয় পার্টির (জেপি) কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ সম্পাদক আব্দুস সালাম মিয়া। পরে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তারা। কিন্তু, কামরুন নাহার চাঁদনী নামের ওই তরুণীকে চাকরি দিতে পারেননি আব্দুস সালাম। অভিযোগ উঠেছে, প্রতারণার শিকার হওয়া তরুণী তার স্বজনদের নিয়ে আব্দুস সালামকে পিটিয়ে হত্যা করেন।
গত বছরের ১৫ জুলাই রাতে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে আব্দুস সালামের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তার ছোট ভাই আব্দুল করিম খলিফা শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করে আব্দুস সালামের প্রেমিকা কামরুন নাহার চাঁদনীসহ আট জনকে অভিযুক্ত করে গত ৯ অক্টোবর আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার উপ-পরিদর্শক মো. আকতারুজ্জামান। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট গত ২৫ নভেম্বর চার্জশিট গ্রহণ করেন। পরবর্তী বিচার কার্যক্রমের জন্য মামলাটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়েছে। আগামী ২৩ জানুয়ারি এ মামলায় চার্জ শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়েছে।
চার্জশিটভুক্ত অপর আসামিরা হলেন—চাঁদনীর মা মোছা. মমতা বেগম, আকাশ আহম্মেদ নয়ন, জসিম খাঁ, শরিফ মিয়া, রুবেল মিয়া, সাইফুল ইসলাম ও মোসলেম উদ্দিন। আসামিদের মধ্যে শরিফ মিয়া কারাগারে। অপর আসামিরা জামিনে আছেন।
তদন্ত কর্মকর্তা মো. আকতারুজ্জামান বলেছেন, “মামলার তদন্ত শেষে আট জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছি। আব্দুস সালামের সঙ্গে চাঁদনীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। চাঁদনীর গ্রামের বাড়িতে যান আব্দুস সালাম। সেখানকার লোকজন তার কাছে চাঁদা দাবি করেন। টাকা দিতে না পারায় আব্দুস সালামকে মারধর করা হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে। মূলত, একটা ইয়াং মেয়ের সঙ্গে অসম প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।”
মামলার বাদী আব্দুল করিম খলিফা বলেছেন, “আমার ভাই খুন হয়েছে। দোষীদের বিচার চাই। জানতে পেরেছি, মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে।”
অসম প্রেমের সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তা ঘটলে আমরা টের পেতাম। আর টের পেলে এ ধরনের কোনো কিছু হতো না। তার বয়স হয়েছে। এ বয়সে এ ধরনের কিছু করা…। তার ফ্যামিলি আছে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে ‘এ’ লেভেল শেষ করেছে। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে পলিটিক্স আছে।”
আব্দুল করিম খলিফা বলেন,“ঘটনার দিন দুপুরে ড্রাইভারকে রেখে তিনি একা বের হন। কী কাজে গেছেন, জানি না। মামলার চার্জশিট এসেছে। দেখে-শুনে মানার মতো না হলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।”
এদিকে, চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “আব্দুস সালামের সঙ্গে কামরুন নাহার চাঁদনীর কয়েক বছর আগে পরিচয় হয়। চাঁদনীকে সরকারি চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সুসম্পর্ক তৈরি করেন আব্দুস সালাম। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক অন্তরঙ্গ সম্পর্কে গড়ায়। তবে, পরবর্তী সময়ে চাঁদনী বুঝতে পারেন, আব্দুস সালাম তাকে চাকরির বিষয়ে সহযোগিতা করতে পারবেন না। পরিবারে বিষয়টি জানাজানি হলে চাঁদনী অনৈতিক সম্পর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। কিন্তু, আব্দুস সালাম তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও চাঁদনীর পরিচিতজনদের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার চাপ দিয়ে আসছিলেন। চাঁদনীর পরিবার এ বিষয়ে বিব্রত হয়ে পড়ে এবং এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে থাকে। একপর্যায়ে চাঁদনী এবং তার পরিবার আব্দুস সালামকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিতে থাকে।”
তিনি বলেন, “পরবর্তী সময়ে চাঁদনী আব্দুস সালামের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক বজায় রাখেন। ২০২৩ সালের ১৫ জুলাই আব্দুস সালামকে গ্রামের বাড়িতে যেতে বলেন চাঁদনী। আব্দুস সালাম তার ধানমন্ডির বাসা থেকে বিকেল ৩টায় মানিকগঞ্জের সিংগাইরে চাঁদনীর গ্রামের বাড়িতে যান। আব্দুস সালাম সেখানে পৌঁছানোর আগেই চাঁদনী আকাশ আহমেদ নয়নকে ফোন করে বলেন, ‘আজ আব্দুস সালাম আমাদের বাসায় আসবেন। সংবাদ দিলে আপনি আমাদের বাসায় চলে আসবেন।’ আব্দুস সালাম যখন চাঁদনীর বাসায় যান, এর মধ্যে চাঁদনী ও তার মা মমতা বেগমের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আকাশ আহমেদ নয়ন, মোসলেম উদ্দিন, মো. সাইফুল ইসলাম, রুবেল মিয়া, শরিফ মিয়া ও মো. জসিম খাঁ চাঁদনীর বাড়িতে আসেন। তারা একে অপরের সহায়তায় আব্দুস সালামকে লাঠি ও গাছের ডাল দিয়ে মারধর করেন।”
চার্জশিটে বলা হয়, “আব্দুস সালামকে দীর্ঘ সময় আটকে রেখে কয়েক দফায় মারধর করে টাকা দাবি করেন আসামিরা। টাকা দিতে অস্বীকার করলে নয়ন আব্দুস সালামকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। এভাবে ভিকটিমকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় মারপিট করে জখম করা হয়। আব্দুস সালামের শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। পরবর্তীতে নয়নের নির্দেশে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ডা. মো. মোশারফ হোসেনকে ডেকে এনে ভিকটিমকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলে রাত ৯টার দিকে মমতা বেগম, মোসলেম উদ্দিন, সাইফুল ইসলাম, নয়ন, মো. রুবেল মিয়া, শরিফ মিয়া ও জসিম খাঁ একে অপরের সহায়তায় আব্দুস সালামকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। সাভার হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি এলে ভিকটিম আরো অসুস্থ বোধ করেন। তখন আসামিরা ভয় পান এবং আব্দুস সালামকে সিএনজি অটোরিকশা থেকে নামিয়ে প্রাইভেটকারে উঠিয়ে মমতা বেগমকে দিয়ে ঢাকার উদ্দেশে পাঠানো হয় এবং অন্য আসামিরা পালিয়ে যান। আব্দুস সালামকে ১৫ জুলাই রাতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন মমতা বেগম। তিনি বুঝতে পারেন, আব্দুস সালাম মারা গেছেন। তখন মমতা বেগম গাড়ি থেকে নেমে এদিক-ওদিক হাঁটাহাটি করে ফিরে এসে গাড়িচালককে বলেন, ‘কোনো ট্রলি পাচ্ছি না। তুমি আমাকে একটু সাহায্য করো। এ লোককে গাড়ি থেকে নিচে নামার ব্যবস্থা করে দাও।’ তখন ড্রাইভার ও মমতা বেগম আব্দুস সালামকে জরুরি বিভাগের সামনে রাস্তার ওপর নামিয়ে রাখে। মমতা বেগম গাড়িচালককে ১ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে বলেন, ‘তুমি চলে যাও। আমি সবকিছু সামলে নেব।’ চালক গাড়ি নিয়ে চলে যাওয়ার পর মমতা বেগম লাশ ফেলে রেখে পালিয়ে যান। হাসপাতালের কর্মচারীরা লাশটি জরুরি বিভাগে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।”
কামরুন নাহার চাঁদনী ও মমতা বেগমের আইনজীবী আনছারী কবির আহম্মেদ বলেছেন,“পুলিশ আট জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে। এদের মধ্যে চাঁদনী ও মমতা বেগমও আছেন। চাঁদনীকে সরকারি চাকরির দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে ১ লাখ টাকা নেন আব্দুস সালাম। শুধু টাকা নেননি, অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করেন। অনৈতিক কাজ করতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন আব্দুস সালাম। হত্যার সঙ্গে চাঁদনী ও মমতা বেগম জড়িত নন। কারণ, তারা তো খুন করেননি। তারপরও তাদের নাম চার্জশিটে দেওয়া হয়েছে। তাদের নির্দোষ প্রমাণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”
আবদুস সালাম মিয়ার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলায়। ঢাকার ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডের ৩৫/এ বাড়িতে পরিবার নিয়ে বাস করতেন তিনি। রাজনীতির পাশাপাশি সড়ক ও জনপথ বিভাগে ঠিকাদারি করতেন আব্দুস সালাম মিয়া।
ঢাকা/রফিক