খুনিদের বিচার নয়, ‘টাকা চায়’ পরিবার
রিয়াদ। ছবি সংগৃহীত
পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে কিশোর বয়সেই হোটেল বয়ের কাজে যোগ দেন রিয়াদ। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতায় জীবন দিতে হয় তাকে। যেই পরিবারের জন্য জীবন গেল, সেই পরিবারের সদস্যরা হত্যার বিচার চায় না। তারা চায় টাকা।
জানা যায়, রাজধানীর স্বামীবাগ এলাকায় নির্মাণাধীন বাসায় মুঠোফোন ও টাকা চুরির অভিযোগ তুলে ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর রাতে মতিঝিলের ঘরোয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের কিশোর রিয়াদকে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় রিয়াদের বড় ভাই রিপন হোসেন পরদিন রেস্টুরেন্টের মালিক আরিফুল ইসলাম সোহেল, গ্রিল কারিগর জসিম চৌকিদার ও খবির হোসেনকে আসামি করে ওয়ারী থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে ২০১৬ সালের ২২ জুলাই তিন জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ।
ওই বছরের ১ ডিসেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। মামলায় এখন পর্যন্ত রেস্টুরেন্টের ৮ কর্মচারী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে রিয়াদের ভাই রিপন সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির না হওয়ায় ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তবুও সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছেন না তিনি। মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. ইব্রাহিম মিয়ার আদালতে বিচারাধীন।
সর্বশেষ গত ২ অক্টোবর মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ছিল। তবে কোনো সাক্ষী না আসায় আদালত আগামী ১৫ জানুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন।
জানতে চাইলে রিয়াদের ভাই রিপন বলেন, “ভাই যখন মারা যায়, তখন মামলা করেছি। আর খবর নেওয়া হয়নি। কাগজপত্রও নাই।”
তিনি বলেন, “বাবা কৃষি কাজ করতেন। আমরা দুই ভাই। আমরা ছোট থাকতেই বাবা মারা যান। জমিজমা নাই। অভাবের সংসার। আমি ঢাকায় ওই দোকানে কাজ করি। রিয়াদ তখন মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতে থাকত। পড়াশোনা করতো না। লেখাপড়া করবে না, এজন্য ওকে ওই দোকানে নিয়ে যাই। সোহেল আমার ভাইকে খুন করেছে। বিচার চাই।”
আদালতে সাক্ষী দিতে না আসার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কোনো খবর পাই না। তাই আর যাওয়া হয় না। মামলার কাগজপত্রও নাই। আসামিদের ভয়ের কারণে যেতে পারিনি। আর আমার মা যেতে দেন না। বলে, ওরা প্রভাবশালী যদি তোকেও মেরে ফেলে। ওরা আওয়ামী লীগ করে, প্রভাবশালী। তখন তো ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। আর সোহেলের বোনের জামাই র্যাবে ছিল, কর্নেল। ভয়ের কারণে কিছু করতে পারিনি।”
আপসের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সোহেল জেলে থাকাবস্থায় রুপা নামে তার এক বোন ও মা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। আপসের কথা বলে। ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪০ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিল। ১০ লাখ টাকা দিছে। ৩০ লাখ দেয়নি।”
মামলা না বিচার চান জানতে চাইলে রিপন বলেন, “আমরা গরীব মানুষ। আমাদের কিছু নাই। ভাই তো চলে গেছে। মরে গেছে, মিলাদ পড়াতে হয়। তাতে খরচ হয়। ভাই মরে যাওয়ার পর মা দিনরাত কান্নাকাটি করে। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার চিকিৎসা করাতে হয়। এছাড়া মায়ের চোখের চিকিৎসা করাতে হয়েছে। বিচার চেয়ে আর কি হবে। জেল তো খেটেছেই। ৪০ লাখ টাকা দিলে নিজেদের চলার ব্যবস্থা হবে। মা তাতে রাজি। ভাই তো চলেই গেছে। ফিরে তো আর আসবে না। বাকি টাকাগুলো দিলে ভালোভাবে চলতে পারব।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিয়াদের ভাবী তামান্না বলেন, “আসলে ঘটনাটি আমার বিয়ের অনেক আগের। আমি এ বিষয়ে অবগত না। আমার স্বামী আর শাশুড়ি ভালো বলতে পারবেন।”
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সংশ্লিষ্ট আদালতে অ্যাডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, “২০১৫ সালের মামলা। সাক্ষ্য চলছে। দীর্ঘদিন সাক্ষী আসছে না। সাক্ষ্য হচ্ছে না। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার কারণে, আবার অনেক সময় রাজনৈতিক কারণেও শুনানি হতে পারে না। আমরা নতুন জয়েন্ট করেছি। চেষ্টা করব সাক্ষী হাজির করে মামলা শেষ করার।”
আপসের বিষয় নজরে আনলে তিনি বলেন, “মার্ডার মামলা আপসযোগ্য না। এমনটা হলে বাদীর সাক্ষ্যকে আমরা বৈরি ঘোষণা করব। অন্যান্য সাক্ষীদের হাজির করে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”
আসামিপক্ষের আইনজীবী মোরশেদুল ইসলাম বলেন, “মামলার ট্রায়াল চলছে। দীর্ঘদিন সাক্ষী আসে না। বিচার ডিলে হচ্ছে। আমরা বিচার করতে পারছি না। আসামিরা প্রতি ডেটে হাজিরা দিচ্ছেন। কিন্তু সাক্ষী আসছে না।”
আপসের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমি অবগত না। কিছু জানি না। আর সব ধারার মামলা তো আপসযোগ্য না। এটা তো হত্যা মামলা। আমরা আসামিদের পক্ষে ট্রায়াল ফেস করব। তাদের নির্দোষ প্রমাণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর বিকেলে রিপন তার ছোট ভাই রিয়াদকে ফোন দেন। ফোনটি শরীয়তপুরের একজন রিসিভ করে জানান, অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছ থেকে ফোনটি কিনেছেন। এরপর বার বার চেষ্টা করলেও ফোন আর রিসিভ করেনি। রাত ৮টার দিকে রিপন মতিঝিল ঘরোয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে আসেন। সেখানে এসে জানতে পারেন চুরির অভিযোগ তুলে আরিফুল ইসলাম সোহেলের নির্দেশে রিয়াদকে গ্রিলের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। রিপন রিয়াদের সাথে কথা বলেন। রিয়াদ বিষয়টি অস্বীকার করেন।
২৮ অক্টোবর রাত সাড়ে ১২টার দিকে সোহেল গাড়ি নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসেন।ওয়ারী থানার ৭৩ স্বামীবাগ নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় অন্যান্য আসামিদের দিয়ে রিয়াদকে নিয়ে যায়। সেখানে রিয়াদকে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখে। সোহেল অন্যান্য আসামিদের সহায়তায় রিয়াদকে পিটিয়ে জখম করে। তার কোমরে থাকা পিস্তল বের করে রিয়াদকে গুলি করে। গুরুতর জখম অবস্থায় রিয়াদকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। তবে তার আগেই রিয়াদ মারা যায়।
মামলাটি তদন্ত করে ২০১৬ সালের ২২ জুলাই ওয়ারী থানার তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) আলিম হোসেন শিকদার তিন জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। তিন আসামি বর্তমানে জামিনে আছেন।
ঢাকা/এসবি