দাবদাহে মরছে ঘেরের চিংড়ি
আলী আকবর || রাইজিংবিডি.কম

দাবদাহে চিংড়ি চাষে বিপর্যয় নেমে এসেছে
বাগেরহাট প্রতিনিধি : প্রচন্ড দাবদাহে বাগদা চিংড়ি ও সাদা মাছের চাষে বিপর্যয় নেমে এসেছে।
বাগেরহাট জেলা সদরসহ সব উপজেলার চিংড়ি ঘেরগুলোতে মাস খানেক ধরে ব্যাপক হারে মাছ মরে যাচ্ছে। তার ওপর এবার রপ্তানি বাজারে বাগদার দাম গত বারের তুলনায় কিছুটা কম।
প্রচন্ড গরমের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানির অভাব, অতিরিক্ত লবন ও জলবায়ূ পরিবর্তনসহ নানা কারণে ঘেরের বাগদা চিংড়ি মারা যাচ্ছে বলে মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে। অধিকাংশ ঘেরে মাছ মরে যাবার কারণে এবার এ অঞ্চলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হবার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে চিংড়ি চাষি ও মৎস্য ঘের মালিকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, লবণ পানি অধ্যুষিত বাগেরহাটে প্রায় আড়াই যুগ আগে থেকে ধানের পরিবর্তে বছরের প্রায় আট মাসই বাগদা চিংড়ি চাষ হয়ে আসছে। ৭১ হাজার ৪৭ হেক্টর জমিতে বাগদা, গলদা ও সাদা মাছের চাষ হয়। এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে ঘেরের সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার।
বাগেরহাট সদরের উপজেলার পশ্চিমভাগ গ্রামের ঘের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর শেখ জানান, ফেব্রুয়ারি মাসে ঘেরে পোনা ছাড়ার পর এপ্রিল মাস থেকে বিরতিহীন ভাবে ঘেরে মাছ মরে ভেসে উঠছে। ঘেরের ভেড়ির পাশে লালচে আকার ধারণ করে মরা মাছ পড়ে থাকছে। আবার যে অল্প কিছু জীবিত মাছ পাওয়া যাচ্ছে তার অধিকাংশই দূর্বল। এগুলো নড়াচড়া করতে না পেরে মাটির সঙ্গে মিশে থাকছে।
মংলার সুন্দরবন ইউনিয়নের বাঁশতলা গ্রামের চিংড়ি ঘের ব্যবসায়ী আনিস ও চিলা গ্রামের মাহবুবুর রহমান টুটুল জানান, তিনি শতাধিক বিঘা জমি লিজ নিয়ে তিনি এবার বাগদা চাষে প্রায় ১৭ লাখ টাকা লগ্নি করেছেন। এবারের চলতি মৌসুমের মাঝামঝি এ ঘের থেকে যে পরিমান মাছ পাওয়ার আশা ছিল তাতে তার এ খাতে লগ্নি করা টাকার অধিকাংশই উঠে আসার কথা। কিন্তু মাছ মরে যাওয়ায় তিনি এখন পর্যন্ত এক লাখ টাকার বেশি মাছ পাননি।
এদিকে ব্যাপক হারে মাছ মরে যাওয়ার কারণে চিংড়ি চাষীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। মাছ মরে যাওয়ায় ইতিমধ্যে অনেক চাষীর সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। চাষীরা জানান, মহাজন ও ব্যাংকের কাছ থেকে লোন এবং ধারদেনা করে তারা এবার ঘেরে পোনা ছেড়েছেন। কিন্তু মৌসুমের শুরুতেই মাছ মরে যাচ্ছে। তার ওপর যাও পাওয়া যাচ্ছে তার দাম গতবারের তুলনায় অনেক কম। কিভাবে এ লোন পরিশোধ করবেন তা নিয়ে তারা চিন্তাগ্রস্ত।
বাগেরহাট সদর উপজেলার গোড়াপাড়া, পশ্চিমভাগসহ কয়েকটি গ্রামের কয়েকজন চিংড়ি ঘের ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, সরকার চিংড়ী মাছ রপ্তানি করে শত শত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করলেও চিংড়ী উৎপাদনকারীদের সমস্যা সমাধানে কোন পদক্ষেপ নেয় না। উপজেলা মৎস্য অফিসও চিংড়ী চাষীদের সচেতন করার কোন পদক্ষেপ নেয় না।
কয়েকজন চিংড়ি চাষী জানান, এ পর্যন্ত কোন ক্ষতিগ্রস্ত চিংড়ী ঘেরে গিয়ে কি কারণে মাছ মারা যাচ্ছে বা আমাদের কি করা উচিত সে বিষযে তাদের কোন দিক নির্দেশনা আমরা পাই নি। ফলে আমাদের একমাত্র জীবিকা- চিংড়ী চাষ নিয়ে আমরা খুবই সমস্যার মধ্যে আছি।
ব্যাপকহারে মাছ মরে যাওয়ার কারণে উপজেলার চিংড়ি উৎপাদন গতবারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক বলে দাবি করেছেন চিংড়ি চাষী ও ডিপো মালিকরা। মংলা উপজেলা চিংড়ি বনিক সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মাহে আলম জানান, এবারে মাছ মরে যাওয়ার কারণে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। গতবারের তুলনায় মংলার মাছের আড়তগুলোতে মাছের আনা-গোনা প্রায় অর্ধেক।
তিনি অভিযোগ করে আরো বলেন, চিংড়ি ঘেরে ভয়াবহ আকারে মাছ মরে গেলেও উপজেলা মৎস্য কর্মকতাসহ সংশি¬ষ্টরা এ ব্যাপারে রহস্যজনক কারণে চাষীদের কোন খোঁজ খবর নিচ্ছেন না।
এ বিষয়ে বাগেরহাট জেলার ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা নারায়ন চন্দ্র মন্ডল বলেন, বিভিন্ন কারণে বাগদা চিংড়ি মারা যায়। অতিরিক্ত লবণের কারণে বেশি সাদা মাছ মারা যাচ্ছে। তবে এবারে প্রচন্ড দাবদাহ, পর্যাপ্ত পানি না থাকায় চিংড়ি মারা পড়ছে। কিছু কিছু ঘেরে এই সমস্যা হচ্ছে। তবে যে ভাবে বলা হচ্ছে তেমন না। কারন এখনও পুরোপুরি মাছ চাষের মৌসুম শুরু হয়নি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন কারণে চিংড়ি মাছের মধ্যে এক ধরনের ‘পীড়ন’ তৈরী হয় আর যার শেষ পরিণতি মৃত্যু। সচেতনতা তৈরিতে আমরা চিংড়ী চাষীদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছি ও সেমিনারের মাধ্যমে তাদের সচেতন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আর কোন এলাকায় মড়ক লাগার খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে গিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় বলে তিনি দাবি করেন।
রাইজিংবিডি/৯ জুন ২০১৫/আলী আকবর/নওশের
রাইজিংবিডি.কম