‘পাবজি’ নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা
বিশ্বের জনপ্রিয় গেমগুলোর মধ্যে 'পাবজি' অন্যতম। এ গেম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। বাংলাদেশে গেমটির জনপ্রিয়তা দিনকে দিন যেমন বেড়ে চলেছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এ গেমে বেশি আসক্ত হয়ে সমাজ-পরিবার থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে চলেছে তরুণরা। অনেকে পড়ালেখা ফাঁকি দিয়ে পাবজি নিয়ে ব্যস্ত থাকছে বলে অভিযোগ অভিভাবকদের। আসক্তি তৈরি হওয়ায় দিন রাত এ গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকছে তারা, ফলে অনেকের মধ্যে আচরণগত সমস্যাও তৈরি হচ্ছে বলে বহুদিন থেকেই অভিযোগ করে আসছেন অভিভাবকেরা।
প্লেয়ার আননোনস ব্যাটেলগ্রাউন্ডস (পাবজি) গেমটি তৈরি করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার ভিডিও গেম কোম্পানি ব্লুহোল স্টুডিওর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান পাবজি করপোরেশন। এটি একটি অনলাইন ভিডিও গেম, যা একের অধিক খেলোয়াড় একসঙ্গে খেলে থাকে। এ গেমে একশজন খেলোয়াড় একইসঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয় এবং একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। একে এক কথায় শুটিং গেমও বলা যায়। প্রত্যেকটা খেলোয়াড় এক বৃহদাকার যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে এবং প্রত্যেকে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য। খেলোয়াড় এ যুদ্ধের ময়দানে একা প্রবেশ করতে পারে আবার একাধিকভাবে প্রবেশ করতে পারে অথবা চার সদস্যের একটি ছোট দল হিসেবে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু বিজয়ী হবে সেই যে খেলোয়াড় অথবা যে দল শেষ পর্যন্ত জীবিত থাকবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গেমটি এতই উত্তেজনাদায়ক যে যারা এ গেমে আসক্ত তারা সামাজিকভাবে মোটেই সক্রিয় নয়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক উম্মে ওয়ারা রাইজিংবিডিকে বলেন, আগে আমরা যখন অবসর সময় পার করতাম, তখন বই পড়তাম বা খেলাধুলা করতাম। এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ম্যাক্সিমাম তরুণ বা কিশোর একটা বিষয়ের প্রতি জোরালো মনযোগ দিতে পারে না। ফেসবুক, ইউটিউব বা গেমস, এখান থেকে ওখানে, কোনো জায়গায় স্থির থাকতে পারছে না। আর যারা পাবজির মতো গেমে প্রথমে আসক্ত হয় তখন অতো ভালোভাবে বুঝতে পারে না।
তার মতে, একটা পর্যায়ে সে এটার প্রতি ধীরে ধীরে আরও বেশি আসক্ত হচ্ছে। সে যখন দেখতে পায় এটাতে হিরোইজম আছে তখন আর বের হতে পারে না। যেটা তাকে অপরাধবোধের দিকেও ঠেলে দিতে পারে। এক্ষেত্রে পরিবারকে দায়িত্ব নিয়ে দেখতে হবে তার সন্তান কতটুকু সময় ইন্টারনেটে ব্যয় করছে বা সে কি করছে।
এটা এক ধরনের মানসিক সমস্যার কারণও হতে পারে বলে মনে করছেন অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাহরিয়া আফরিন। তিনি বলেন, এটির কারণে একটা মানুষ যখন নিজেকে এটার ভেতর হারিয়ে ফেলে, তখন সে বিভিন্ন সমস্যাগ্রস্ত হয়। এসবের কারণে একটা ছেলে বা মেয়ের ভেতর ইনডিভিজ্যুয়ালিজম কাজ করে। যার কারণে সে সামাজিকীকরণ থেকে বিচ্যুত থাকে।
মনোবিদ অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, যে যে জিনিসের প্রতি বেশি মজা পায় তারা সেটির প্রতি বেশি আসক্ত থাকে। বিশেষ করে বর্তমানে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ বিভিন্ন গেমসে আসক্ত থাকে। এটা মনস্তাত্ত্বিকভাবে একটা মানুষকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আমাদের তরুণ যারা, বাসায় বসে থাকে, তাদের প্রতি নজর রাখতে হবে। তাদের সরাসরি গেমসের ব্যাপারে নিষেধ করা যাবে না। তবে তারা যাতে এটার প্রতি অনেক বেশি আসক্ত না হয়, অনেক বেশি ঝুঁকে না যায়, সেদিকে অবশ্যই নজরে রাখতে হবে।
অভিযোগ আছে, পাবজি গেম শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহিংস মনোভাবও তৈরি করছে। কারণ এই গেমের বিষয়বস্তু সহিংসতামূলক। যদিও গেমাররা খেলার সময় তারা বুঝতে পারে না। কিন্তু আক্রমণাত্মক চিন্তাভাবনা এবং অস্থিরতা তাদের আচরণে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সিনিয়র সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন খান রাইজিংবিডিকে বলেন, আমরা যদি পাবজি গেমের বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কারো পক্ষ থেকে ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানতে পারি অথবা এটা সম্পর্কে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসে তাহলে অবশ্যই সেটা খতিয়ে দেখা হবে। এটাতে ক্ষতির কোনো বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ পেলে অবশ্যই কারিগরি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে ওভাবে কোনো অভিযোগ আসেনি।
গত বছরের অক্টোবরে অভিভাবকদের কাছ থেকে অসংখ্য অভিযোগ পাওয়ার পর গেমটি বাংলাদেশ সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু রিভিউ করে তা আবার খুলে দেওয়া হয়। এছাড়া গতবছরে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যের সরকার এবং নেপালও পাবজি নিষিদ্ধ করার পর তা আবার খুলে দিয়েছে। বর্তমানে কেবল বিশ্বের তিনটি দেশে পাবজি নিষিদ্ধ রয়েছে- দেশগুলো হচ্ছে, চীন, ইরাক এবং জর্ডান।
এ প্রসঙ্গে সিআইডির সাইবার পুলিশ ব্যুরোর অতিরিক্ত উপ মহাপরিদর্শক শাহ আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে বলা আছে কোনোগুলো অপরাধ, কোনোগুলো অপরাধ না। যদি সেখানে এটাকে (পাবজি) অপরাধ বলা হয় তাহলে এটি অপরাধ। আর এখানে টাকা পয়সার কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকে, যদি জুয়া না হয়, তাহলে এটি অবৈধ হওয়ার সুযোগ নেই।
তিনি জানান, একবার লিংক বন্ধ করে আবার চালু করা মানে এটাকে অ্যালাউ করা হয়েছে। যদি লিংকটা খুলে দেওয়া না হতো তাহলে তো কেউ খেলতে পারতো না। সাইবার পুলিশ দেখবে, আইনে কী রয়েছে। গেমে যদি আইনের কোনো ব্যত্যয় থাকে তাহলে ব্যবস্থা নেবো।
এদিকে অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও পাবজি গেম ঘিরে গড়ে উঠছে নানা কমিউনিটি, ক্রিয়েটরস এবং বিজনেস। পাবজি মোবাইল কমিউনিটি বাংলাদেশ (পাবজিএমসিবিডি) এমনই একটি নাম। এ গ্রুপের অ্যাডমিন আলিউর রাহমান সোহান, রাশিদ উদ জামান রাশিদ ও সামিউল হাসান মাহিন বলেন, পাবজি নিয়ে দেশে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হবে। এর ভালো-খারাপ দিকগুলো গেমারদের কাছে তুলা ধরা হবে।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন রাইজিংবিডির প্রতিবেদক আবু বকর ইয়ামিন এবং আহমেদ নূর।
ঢাকা/এসএম
ঢাকা/ফিরোজ