ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

৭৫ বছর বয়সেও অপ্রতিরোধ্য রানী হামিদ

আমিনুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
৭৫ বছর বয়সেও অপ্রতিরোধ্য রানী হামিদ

রানী হামিদ। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে একটি পরিচিত নাম। অনেকে হয়তো জানেন না রানী হামিদ কোন খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু তার নামটি সকলের কাছেই পরিচিত। স্বমহিমায় ভাস্বর তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে। হবেনই বা না কেন? তিনি যে বাংলাদেশের নারী দাবার কিংবদন্তি। প্রথম আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার। তার লম্বা ক্যারিয়ারের প্রত্যক পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে অর্জন। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর দাবাড়ুদের হারিয়ে ব্রিটিশ কাপ জয়, মহিলা দাবাড়ু হিসেবে একাধিকবার অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ, জাতীয় মহিলা দাবায় টানা ছয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়া, জাতীয় মহিলা দাবায় এক বছর পর পর চ্যাম্পিয়ন হওয়া- এমন অনেক অর্জন রয়েছে তার ঝুলিতে।

সবশেষ তিনি গেল শুক্রবার ‘মার্সেল রেফ্রিজারেটর জাতীয় মহিলা দাবা’ প্রতিযোগিতায় ৭৫ বছর বয়সেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। যেখানে দেশের বিভিন্ন জেলার খ্যাতিমান ৫৮ জন মহিলা দাবাড়ু অংশ নিয়েছিলেন। এই বয়সেও তাদের সবাইকে পেছনে ফেলে শিরোপা জিতে নিয়েছেন। যা জাতীয় মহিলা দাবায় তার ২০তম শিরোপা। বিশ্বে জাতীয় মহিলা দাবায় ২০বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নজির হয়তো নেই। রানী হামিদের এই অর্জন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মতো।

শনিবার তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন রাইজিংবিডি.কমের খেলাধুলা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক আমিনুল ইসলামের। লম্বা সময়ের গল্প-আলাপে কথা বলেছেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। তার চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল :

প্রশ্ন : এ বয়সেও চ্যাম্পিয়ন। তাও আবার ২০তম বার। কেমন লাগছে?

রানী হামিদ : খুবই আনন্দের ব্যাপার। এবার তো পাঁচজনের মধ্যে থাকা নিয়েই অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হলাম। এবার অবশ্য একটু অনুশীলন করেছিলাম। মাসে খানেকের মতো। সেটারই ফল পেলাম।

প্রশ্ন : আপনার বয়স ৭৫। এই বয়সেও দাপটের সঙ্গে খেলে যাচ্ছেন। বলা যায় অপ্রতিরোধ্য। রহস্য কী?

রানী হামিদ : আসলে দাবা কিন্তু বয়স্ক লোকেরই খেলা। আগেরকালে মানুষ কিন্তু এই বয়সেই খেলত। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন শুনতাম ছোটদের জন্য দাবা খেলা না। এটা বড়দের খেলা। তোমরা মাঠে যাও, দৌড়াও, খেলো। এখন অবশ্য দেখা যাচ্ছে সেটার ঠিক উল্টোটা। বুড়োরা খেলতে পারবে না দাবা। কারণ, বুড়োদের ব্রেন অচল হয়ে যায়। বাচ্চারা অনেক শার্প থাকে। আমি আসলে দাবার বাইরে আর কিছু চিন্তা করিনি। চিন্তা করতে পারিও না। হয়তো সেটাই আমার রহস্য।

প্রশ্ন : আমাদের মহিলা গ্র্যান্ডমাস্টার নেই। হচ্ছে না কেন?

রানী হামিদ : কিভাবে হবে আমাদের মহিলা গ্র্যান্ডমাস্টার! বছরে একটা টুর্নামেন্ট খেলি আমরা। এভাবে কী হওয়া যায়? গ্র্যান্ডমাস্টার হতে হলে প্রফেশনাল ওয়েতে খেলতে হয়। আমি যখন খেলতাম তখন না আমাদের ফেডারেশন ভেবেছে আমার গ্র্যান্ডমাস্টার হতে কী করা উচিত। না আমি নিজে ভেবেছি। তখন আমরা মনের আনন্দে খেলেছি। খেলার জন্য খেলেছি। অন্যকিছু চিন্তা করিনি।

প্রশ্ন : আপনার এই যে লম্বা ক্যারিয়ার, অনেক অনেক অর্জন, এগুলোর মধ্যে সেরা অর্জন বলবেন কোনটাকে?

রানী হামিদ : আজকের জন্য আমি এটাকেই সেরা বলব। আর পুরো ক্যারিয়ার বিশ্লেষণ করলে আমার ব্রিটিশ কাপ জয়টাকে সেরা বলব। আমি ১৯৮৫ সালে যখন প্রথম ব্রিটিশ কাপ পেয়েছিলাম সেটা একটা অন্যধরনের অনুভূতি ছিল। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভারতসহ কমনওয়েলথভুক্ত সবগুলো দেশের দাবাড়ুরা অংশ নিয়েছিল। সেখানে সবাইকে পেছনে ফেলে, ব্রিটিশদের হারিয়ে শিরোপা জিতেছিলাম। তখন খুবই ভালো লেগেছিল। কারণ, ব্রিটিশরা আমাদের ২০০ বছর শাসন করেছিল। তাদের দেশে, তাদের হারিয়ে শিরোপা জেতাটার মহত্ব ছিল অন্যরকম।

প্রশ্ন : এবারের আসরে ৯ রাউন্ডের মধ্যে একটি রাউন্ডে আপনি ড্র করেছেন...

রানী হামিদ : একটা রাউন্ড ড্র করেছি। ব্যাড লাক। ওটাও উইনিং ছিল। আমি মিস করেছি। প্রতিপক্ষের টাইম প্রেসারে আমি পাজলড হয়ে গিয়েছিলাম।

প্রশ্ন : এই বয়সে কী চাপ অনুভব করেন?

রানী হামিদ : অনেক বেশি। আমার আসলে এখন ব্লান্ডার হয়। বেশিরভাগ গেম যে আমি হারি সেটা আসলে খেলে হারি না ঠিক। আমার খেলা সব সময় প্লাস পজিশনে থাকে। খুব ভালো পজিশনে থাকে। কিন্তু আমি ব্লান্ডার করি বলেই হেরে যাই।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের মহিলা দাবার ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন? আমরা কী আরো একজন রানী হামিদ পাব?

রানী হামিদ : নিশ্চয়ই। যদি পাই সেটা পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যেই পাব। যদি পরবর্তী পাঁচ বছরে না পাই তাহলে বুঝতে হবে আসলে ট্রেনিং দিয়ে কিছু হবে না। বাই বর্ন ট্যালেন্ট আসতে হবে। আসলে মেয়েদের দাবাকে এগিয়ে নিতে ফান্ডের খুব অভাব। যখন আমরা খেলতে চাই কোনো টুর্নামেন্ট, তখন আমরা কোনো ট্রেনিং পাই না। আবাসিক প্রশিক্ষণ পাই না। নিজেরা থেকে যে প্রাকটিস করব সেই সুযোগও পাই না। কারণ, ফান্ডের অভাব। কোথায় খেলতে যাব, কিভাবে যাব, টিকিট জুটবে কিভাবে এগুলো নিয়ে ফেডারেশনের অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হয়।

প্রশ্ন : সামনে টার্গেট কী আপনার?

রানী হামিদ : আমাদের একটা মহিলা দাবা সমিতি আছে। সেটার সঙ্গে আমি আছি। আরো কয়েকজন আছেন। আমরা সেসব মেয়েদের নিয়ে কাজ করি যারা ভালো টিমে চান্স পায় না। ফার্স্ট ডিভিশন খেলতে পারে না। তাদেরকে আমরা সাহায্য করি। তারা উৎসাহ পায়। খেলার মান বাড়ে। প্রতি বছর আমরা দাবা লিগে অংশগ্রহণ করি। এ ছাড়া আমাদের সমিতি থেকে তিন-চারটা টুর্নামেন্ট আয়োজন করি। সেখানে ছেলে-মেয়েরা খেলে। প্রাইজমানি পায়। উৎসাহিত হয়। সামনে আমরা মেয়র আনিসুল হকের নামে একটা টুর্নামেন্ট আয়োজন করব। এগুলো নিয়েই থাকব।

প্রশ্ন : আপনার দাবার হাতেখড়িটা হয়েছিল কিভাবে?

রানী হামিদ : ছোটবেলায় দেখতাম বাবা তার বন্ধুদের সঙ্গে দাবা খেলত। অবশ্য আমরা ছোট বলে দাবা ধরার নিয়ম ছিল না। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই দাবার প্রতি আমরা একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। আমি খুব চঞ্চল ছিলাম। দৌড়ে সব সময় চ্যাম্পিয়ন হতাম। চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ন হতাম। সব ধরনের খেলায় চ্যাম্পিয়ন হতাম। কিন্তু দাবা দেখলেই আমি থেমে যেতাম। বাবা যখন খেলতেন তখন আমি কিছুই জানতাম না। চাল বুঝতাম না। ঘুটি চিনতাম না। তারপরও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে দেখতাম। হয়তো আকর্ষণটা ভেতর থেকে আসত। দাবা শেখার পর থেকেই বেশ ভালো করছিলাম। একবার আমার এক টিচার বাবাকে বললেন যে আপনার মেয়েকে নিয়ে আমরা করাচি যাই। অলিম্পিয়াডে আপনার মেয়ে গোল্ড জিতবে। ওর টাইমিং খুব ভালো। কিন্তু বাবা রাজি হননি। ওই আমলে দুজন মেয়ে করাচি যাবে, সেটাতে বাবা সায় দেননি। না হলে ছোটবেলায়ই আমি পাকিস্তানে রেকর্ড করতে পারতাম। বাবা যেহেতু পুলিশে চাকরি করতেন, তার কেবল চোর-ডাকাতদের সঙ্গেই পরিচয় (হাসি)...। মেয়েকে একা ছাড়তে ভয় পেতেন।

প্রশ্ন : আপনি কোচিং কিংবা সংগঠকের ভূমিকায় আসেননি কেন?

রানী হামিদ : আমি আসলে দাবার বাইরে কিছু ভাবিনি। আমি কোচিং পেশায় কিংবা সংগঠকের ভূমিকায় আসিনি। আসলে অনেক আগেই আসতে পারতাম। না আসার কারণ, ওগুলোর সঙ্গে জড়ালে আমার খেলাটা হয়তো আর চালিয়ে যাওয়া হত না। একসময় থেমে যেতে হত। এখন আমার থামার তাড়া নেই। খেলে যাচ্ছি। অবসর সময়টা ভালো কাটছে। ভালো সময় কাটছে। মনের আনন্দ খেলছি।

প্রশ্ন : রানী হামিদ বাংলাদেশের কিংবদন্তি। তার নাম একটা চেস একাডেমি থাকতেই পারত। যেটার সস্ত্বাধিকারী তিনি। নেই কেন?

রানী হামিদ : আসলে এভাবে ভাবিনি। আমার নামে চট্টগ্রামে একটা চেস একাডেমি আছে। যদিও সেটার সত্ত্বাধিকারী আমি নই। তবুও আমার নামে আছে শুনে ভালো লাগছে।

প্রশ্ন : লম্বা সময়ের ক্যারিয়ারে রানী হামিদের হয়তো অনেক ভক্ত আছেন। বিশেষ দুই একজনের কথা যদি বলতেন...

রানী হামিদ : হ্যাঁ কিছু ভক্ত তো আছেই। তাদের মধ্যে একজনের নাম না বললেই নয়। তার নাম হারুন বেপারী। ১৯৮০ সাল থেকে আমার খেলার, শিরাপা জয়ের, অর্জনের যত ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে তার সবগুলোই সে সংরক্ষণ করেছে। তার কাছে আছে। শুক্রবার দিন সকালেও সে আমাকে ফোন করে শুভকামনা জানিয়েছে। যাতে আমি ভালো খেলি। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছে।

 

সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ

আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।


ঢাকা/আমিনুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়