ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

শেকল ভাঙা নারীদের ফুটবলপ্রেম (প্রথম পর্ব)

কামরুল ইসলাম ইমন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:১২, ৩ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শেকল ভাঙা নারীদের ফুটবলপ্রেম (প্রথম পর্ব)

বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম গর্বের জায়গা জুড়ে আছে ফুটবল। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ ভারতে বিভিন্ন প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে বেড়িয়েছে কেবল বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করতে। ফুটবলের সে গৌরব ৭০-৮০ এর দশকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে পুরুষ ফুটবলাররা। সে ধারা বয়ে নিয়ে গেছে আরো কুড়ি বছর। এরপরে ক্ষয় দেখা শুরু করে বাংলাদেশের ফুটবল।

সেই ক্ষয়িষ্ণু সময়ে প্রথমবারের মতো আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। স্বাধীনতার পর ৩০ বছর অপেক্ষা করতে হয় বাংলাদেশের নারীদের ফুটবল পায়ে মাঠে ছোটাছুটি করতে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নারীরা বিভিন্ন অ্যাথলেটিকসে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে থাকেন। টেবিল টেনিস খেলে জোবেরা রহমান লিনু তো রীতিমতো গিনেজ বুকে বাংলাদেশের নাম তোলেন। হ্যান্ডবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টনে নারীরা মাঠে নামলেও সুযোগ মিলতো না ফুটবলে। কারণ নারীদের মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো ভালো চোখে দেখতো না সমাজ!

যে দেশে স্বাধীনতার আগে নারী জাগরণের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন বেগম রোকেয়া, কামিনী রায়, নুরুন নাহার ফয়জুননেসারা, সে দেশের জনপ্রিয় খেলা ফুটবল খেলতে নারীদের পিছিয়ে রাখা লজ্জা ছাড়া আর কিছু নয়। তবুও একটা সময় মানসিকতা পাল্টে শুরু হয় নারীদের ফুটবল যুদ্ধ। সেই যাত্রার খবর জানাব আজ,

এক অধ্যক্ষের ফুটবলপ্রেম

ধারনা করা হয় ১৯৭৭ সালে, ফুটবলের উন্মাদনা দেখে ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ হামিদা আলী মেয়েদের নিয়ে ফুটবল দল গঠন করেন। তবে সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সে দল নিজেদের ক্যাম্পাসের মাঠ ছেড়ে বেরুতে পারেনি কখনো।

১৯৯১ সালে ফিফা প্রথমবারের মতো নারী ফুটবলকে বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। চালু করে নারী ফুটবল বিশ্বকাপ। তবে তখনকার সময়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) পুরুষদের ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। নারীদের ফুটবল দেখতে তাই অপেক্ষা করতে হয় আরো ১০ বছর।

আলোর মুখ দেখে প্রথম দল

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অফিসিয়ালি নারী ফুটবল দল গঠন করা হয় ২০০১ সালে। সেখানেও ছিলো না বাফুফের অবদান। পশ্চিমবঙ্গের একটি দলের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলার জন্য ক্রীড়া সংগঠক হাসানুজ্জামান খান বাবলু গঠন করেন সে দল। বাংলাদেশের প্রাক্তন নারী অ্যাথলেট মুরেল গোমেজের নেতৃত্বে মাঠে নামে বাংলাদেশের প্রথম নারী দল। যদিও ম্যাচটিতে বাজেভাবে হারে বাংলাদেশ। তবে সে থেকে শুরু হয় নারী ফুটবল ইতিহাসের যাত্রা।

ওই এক ম্যাচের পর তিন বছরের শীতনিদ্রায় ছিলো নারী ফুটবল দল। ২০০৪ সালে ভাঙ্গে সেই ঘুম। নারী ক্রীড়া সমিতি ও বাফুফে একত্রিত হয়ে নারী ফুটবলের প্রসার ঘটানোর পরিকল্পনা করে। প্রথমবারের মতো নারী ফুটবলের ঘরোয়া প্রতিযোগিতা চালু হয়। মাত্র ছয়টি দল ছিলো সেই শুরুর সাক্ষী।

আসল বাধা, ভাঙল শেকল

টুর্নামেন্ট শুরু করলেও সমাজের রক্তচক্ষুর সামনে সে সময়ও পড়তে হয়। কিছু মহল বলতে শুরু করে, ‘ফুটবল খেলার নাম করে নারীদের এমন নগ্ন প্রদর্শনের অর্থ কি?’ এ নিয়ে কতো পক্ষে-বিপক্ষে মত। কতো লিখালেখি। কত যুক্তি খন্ডন।তবে শেষ পর্যন্ত জয় হয় নারীদের। এবার আর দমে যায়নি সংগঠক ও আয়োজকরা। পুলিশের সহায়তা নিয়ে শেষ করে টুর্নামেন্ট। কার্যক্রম শুরু করে নারী ফুটবল প্রতিভা অন্বেষণের। বলা যায়, এই সফল পদক্ষেপই আজ এগিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশের নারী ফুটবলকে। এরপরে বাংলাদেশ জাতীয় দল ও বয়সভিত্তিক দল বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কিছু প্রীতি ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়।

ইনফিল্ড-অফফিল্ড চ্যালেঞ্জ

নারী ফুটবল চালু রাখার বাধায় জিতলেও সমস্যার শেষ ছিলো না নারী ফুটবলের উন্নয়নের পথে। প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিলো, মেয়েদের লম্বা সময় ধরে ক্যাম্পে রাখা। বাংলাদেশে নারী ফুটবল শুরুর সময়কালে মাত্র ৫ কিংবা ৬টি জেলার খেলোয়াড় পাওয়া যেত। তাও সেসব মেয়েরা আসতো খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, যশোরের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। খেলোয়াড়দের পরিবার থেকে বের করে আনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়তো। তবে সময়ের সাথে এখন এই বাধাও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে বাফুফে।

নারী ফুটবল উন্নয়নের পথে আরেকটি বড় সমস্যা ছিলো স্পন্সরের অভাব। শুরুর দিকে বাফুফে কিছু সরকারী বিনিয়োগ ব্যবস্থা করলেও নারী ফুটবল ‘গ্ল্যামারলেস স্পোর্ট’ ও অলাভজনক হওয়ায় সময়ের সাথে বন্ধ হয়ে যায় সবকটি রাস্তা। তখন এগিয়ে আসে ক্রীড়া বান্ধব প্রতিষ্ঠান ‘ওয়ালটন’। তারা নারী ফুটবলের উন্নয়নের পথে সহযোগিতা করে। ফলে নারী ফুটবলের সফলতার পথ হয়ে ওঠে আরো মসৃণ।

এরপর এগিয়ে যাওয়া

২০০৯ সালে এসে প্রথমবারের মতো নারীদের জন্য ‘জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ’ চালু করে বাফুফে। দেশজুড়ে চলা এই টুর্নামেন্টের মাধ্যমে জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করার মতো যোগ্য খেলোয়াড় পেয়ে যায় বাফুফে। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো শক্ত এক দল দাঁড় করায় বাফুফে। ২০১০ সালের সাউথ এশিয়ান গেমস ও সাফ গেমসে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের নারী জাতীয় ফুটবল দল।

দেশজুড়ে চলা এই জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ চলে টানা তিনি বছর। এ সময়ের মধ্যে জেলাভিত্তিক নারী ফুটবলের প্রতিযোগিতাও চালু হয়ে যায়। ঢাকায়ও একটি টুর্নামেন্ট শুরু হয়। ফলে আর জাতীর দল ছাড়াও বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দল গঠন করতে অসুবিধায় পড়তে হয়নি বাফুফেকে।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বর্তমানে আশার আলো দেখছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। সেই হামিদা আলীর একক চেষ্টা দিয়ে শুরু, মুরেল গোমেজের নেতৃত্বে পূর্ণতা পাওয়া, সে থেকে জাতীয় দলকে অদম্য করে গড়ে তোলার গল্প দিয়ে সাজানো নারী ফুটবল দলের ইতিহাসের প্রতিটি পাতা।

 

***সামনের পর্বে থাকবে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সাফল্য, বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য।

 

ঢাকা/কামরুল/ইয়াসিন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়