ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে খুলনা বিকেএসপির এগিয়ে চলা

আব্দুল্লাহ এম রুবেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ২৪ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে খুলনা বিকেএসপির এগিয়ে চলা

বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপি। সেই প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়েছেন ক্রীড়াঙ্গনের একাধিক তারকা। যারা দেশের পতাকা তুলে ধরেছেন বিশ্বমঞ্চে।

ক্রীড়ার মানোন্নয়ন, পর্যাপ্ত  ক্রীড়া  অবকাঠামোগত সুবিধাদি  এবং  সঠিক  প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৪ সালে ‘বাংলাদেশ  ইন্সটিটিউট  অব স্পোর্টস  (বিআইএস)  প্রতিষ্ঠার  পরিকল্পনা  করে। এরপর ১৯৮৩ সালে যার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ  ক্রীড়া  শিক্ষা  প্রতিষ্ঠান  (বিকেএসপি)।  ১৯৮৬ সালের  ১৪ এপ্রিল  প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকেই বিকেএসপি সর্বোচ্চ একাগ্রতার সাথে উচ্চমানের খেলোয়াড় তৈরির কাজে  নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সাভারে মূল বিকেএসপির বাইরেও পাঁচটি আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। সেগুলো হলো বরিশাল, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, খুলনা ও সিলেটে।

ভবিষ্যত অ্যাথলেটদের স্বপ্নের ঠিকানা বিকেএসপি কেমন চলছে? কেমন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন অ্যাথলেটরা। রাইজিংবিডি-র ধারাবাহিক প্রতিবেদনে উঠে আসবে সব। আজ পড়ুন খুলনা বিকেএসপির আদ্যোপান্ত।

আরও পড়ুন :

শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার পশ্চিমে, আফিল গেট এলাকায় সবুজের আচ্ছাদনে দাঁড়িয়ে আছে খুলনা বিকেএসপি। ১৩ একর জমির উপর চারতলা একটি ভবন, ৫২ কক্ষ বিশিষ্ট একটি ট্রেনিং হোস্টেল, একটি জিমনেশিয়াম, একটি করে ক্রিকেট ও ফুটবল মাঠ, চারতলা বিশিষ্ট দুই ইউনিটের একটি অফিসার্স কোয়ার্টার ও একটি স্টাফ কোয়ার্টার ভবন মিলিয়ে খুলনা বিকেএসপি। ২০০৪ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। চার বছরে শেষ হয় বিকেএসপির অবকাঠামো নির্মাণ কাজ। তবে একাডেমি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে লেগে যায় আরও দুই বছর।  যাত্রা শুরু হয় ফুটবল ডিসিপ্লিন দিয়ে। এরপর সেখানে যুক্ত হয় টেবিল টেনিস। সর্বশেষ, মাত্র দুই বছর আগে, ২০১৮ সালে খুলনা বিকেএসপিতে চালু হয় ক্রিকেট ডিসিপ্লিন।

খুলনায় অবস্থিত বিকেএসপি নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নতুন খেলোয়াড় তৈরীতে অবদান রেখে আসছে দারুণভাবে। প্রায় এক দশকেরও বেশী সময় ধরে এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বয়স ভিত্তিক ও মূল জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন বেশ কয়েকজন প্রতিভাধর ফুটবলার। বর্তমানে ফুটবল, ক্রিকেট ও টেবিল টেনিস এই তিনটি ডিসিপ্লিনে খুলনা বিকেএসপিতে মোট প্রশিক্ষণার্থী আছেন ৮০ জন। যারা খেলাধুলার পাশাপাশি পড়াশুনাও চালিয়ে যাচ্ছেন। অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা আছে এখানে।

বাংলাদেশের বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। দুই বছর আগে ক্রিকেট কার্যক্রম ‍শুরু হয় মাশরাফি, সাকিব, সৌম্যদের ডেরায়। শুরুর মাত্র দুই বছর হলেও চলতি মৌসুমে অনূর্ধ্ব-১৮ জাতীয় ক্রিকেটে খুলনা বিকেএসপির ১১ জন ক্রিকেটার খেলেছেন বিভিন্ন দলের হয়ে। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত হওয়া ইয়ুথ ক্রিকেট লিগেও খেলেছেন খুলনা বিকেএসপির তিন ক্রিকেটার। বিকেএসপির গন্ডি পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এখানকার ক্রিকেটাররা। ব্যাট-বলের প্রশিক্ষণের জন্য এখানে রয়েছে বিশাল একটি মাঠ। অনুশীলন উইকেটসহ এখানে মোট উইকেট তিনটি।

২০১৮ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রমে উত্তীর্ণ প্রশিক্ষণার্থীদের থেকে ৩০ জনকে নিয়ে খুলনা বিকেএসপির কার্যক্রম শুরু হয়। শুরু থেকেই খুলনার স্থানীয় দুই কোচের হাত ধরে চলছে ক্রিকেট কার্যক্রম।  প্রতিষ্ঠানটির ক্রিকেটের হেড কোচ সালাহ উদ্দীন বলেছেন,‘প্রতিদিন দুই সেশনে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সকালে একাডেমিক ক্লাস চলে। ক্লাস শুরুর আগে একবার এবং দুপুরের পর অনুশীলন করানো হয়। এছাড়া নিজেদের মধ্যেই প্রায়ই ম্যাচ খেলে এখানকার ক্রিকেটাররা।’ নিজের ছাত্রদের নিয়ে বেশ আশাবাদী সালাহ উদ্দীন। তিনি বিশ্বাস করেন দ্রুতই বয়সভিত্তিক দলে খুলনা থেকে ভালোমানের ক্রিকেটার পাবে।

‘আমি একঝাঁক মেধাবী ক্রিকেটার পেয়েছি। যারা দেশের হয়ে খেলার জন্য বেশ প্রত্যয়ী। হয়তো সবাই সুযোগ পাবে না, কিন্তু এই বিশ্বাসটাই তাদের ক্রিকেটে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।’ - বলেছেন সালাহ উদ্দীন।

সম্প্রতি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলে খেলা ৭ ক্রিকেটার ছিলেন দিনাজপুর বিকেএসপির প্রশিক্ষাণার্থী।  একই রকম স্বপ্ন দেখেন এখানকার ক্রিকেটাররাও। শুধু অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ নয়, জিততে চান দেশের হয়ে বড়দের বিশ্বকাপও। তবে এখানে ক্রিকেট হয় গ্রীষ্ম ও শীত মৌসুমে। কোচ আক্ষেপ করে জানালেন, ইনডোর ফ্যাসিলিটিজ না থাকায় বর্ষা মৌসুমে ব্যাট-বল নিয়ে মাঠে নামতেই পারেন না ক্রিকেটাররা।

ক্রিকেট দুই বছর আগে চালু হলেও ফুটবল ডিসিপ্লিন এখানে রয়েছে ২০১১ সাল থেকে। তাই সাফল্যটা ফুটবলেরই বেশী। ২০১৭ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত সুব্রত কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় বিকেএসপি। যে দলটির প্রায় সব খেলোয়াড়ই ছিল খুলনা বিকেএসপির প্রশিক্ষণার্থী। এছাড়াও এখানকার ২০১২ সালের ফুটবল ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থীদের অনেকে এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে জানান এখানকার ফুটবল কোচ মোস্তাকিম বিল্লাহ। এই ফুটবল কোচ বলেন, ‘প্রথম ব্যাচের ২৪ জনের দুই/তিন জন এখন জাতীয় দলে আছে। বাকিরা সবাই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলের কোনো না কোনো বড় দলে খেলছে। নতুন যে ব্যাচ ভর্তি হচ্ছে বিকেএসপিতে ওই ব্যাচের ৬৪ জনকে ফুটবলে খুলনা বিকেএসপিতে দেওয়ার কথা।’

ক্রিকেট ও ফুটবলের পাশাপাশি টেবিল টেনিস চলছে আপন ছন্দে। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে খেলার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে চলছে তাদের অংশগ্রহণ ।বর্তমানে এখানে মাত্র তিনটি ডিসিপ্লিনে শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের আশা দ্রুত বাড়বে ডিসিপ্লিনের সংখ্যা। এছাড়া প্রশিক্ষণার্থীদের আবাসন সুবিধাও দ্রুত বৃদ্ধি করতে পারবে বলে বিশ্বাস করেন খুলনা বিকেএসপির ভারপ্রাপ্ত উপ পরিচালক মতিউর রহমান। 

খুলনা বিকেএসপির সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা  চিকিৎসা ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠানটিতে ৮০ জন প্রশিক্ষণার্থী থাকলেও নিয়মিত চিকিৎসক নেই এখানে। ফলে কেউ একটু গুরুতর অসুস্থ্ হলে বিপাকে পড়ে যান কর্মকর্তারা। আবার শহর থেকে বিকেএসপি দূরে অবস্থিত হওয়ায় তাৎক্ষণিক চিকিৎসাও মেলে না।  প্রতি সপ্তাহে একজন মেডিকেল অফিসার সব প্রশিক্ষণার্থীর চেকআপ করেন। ভারপ্রাপ্ত উপ পরিচালক মতিউর রহমানের দাবি, ‘একজন মেডিকেল অফিসার সপ্তাহে একদিন যে চেকআপ করান সেটাই যথেষ্ট। ভবিষ্যতে ডিসিপ্লিন ও প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা বাড়লে নিয়মিত চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হবে।’

তবে খুলনা বিকেএসপির নানা সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেছেন তিনি। আশ্বাস দিয়েছেন ক্রিকেটার ইনডোর ফ্যাসিলিটিজ সমস্যা সমাধানের,‘আমরা ইতিমধ্যে আমাদের বেশ কিছু চাহিদার বিষয়ে ঢাকা বিকেএসপিতে চিঠি পাঠিয়েছি। সেখান থেকে বেশ কিছু ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। আশা করছি ক্রিকেটারদের সমস্যা দ্রুতই সমাধান হয়ে যাবে।’

এছাড়াও খুলনা বিকেএসপির উন্নয়নে নানা পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান সদ্য নিয়োগ পাওয়া এই কর্মকর্তা। বিকেএসপির হেড কোয়ার্টারে যেসব পরিকল্পনা পাঠানো হয়েছে সেগুলো হল- বিকেএসপির জায়গা দ্বিগুণ করা, ডিসিপ্লিন বাড়ানো, ৬ তলা বিশিষ্ট নতুন একাডেমিক ভবন, আরও একটি ক্রিকেট ও ফুটবল মাঠ, ক্রিকেটের জন্য ইনডোর এবং সুইমিংপুল নির্মাণ। নতুন এই পরিকল্পনা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বিকেএসপি কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে পরিদর্শনে এসে ফাইল তৈরি করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে এ পরিকল্পনা পাঠানো হবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (একনেক)। একনেকে পাশ হলেই টেন্ডার দিয়ে নতুন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে হাত দিবে বিকেএসপি কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ আশা করছে নতুন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এই অঞ্চলের খেলাধুলা প্রসারে আরও অনেক এগিয়ে যাবে।

নিজেদের পরিকল্পনা নিয়ে বিকেএসপির নির্বাহী প্রকৌশলী শাহ আশরাফ আলী বলেছেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য খুলনা বিকেএসপিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া। এর জন্য ইতোমধ্যে আমরা জায়গা বৃদ্ধিসহ আধুনিকায়নের পরিকল্পনাগুলো মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছি। আশা করছি খুব শিগগিরই মন্ত্রণালয় থেকে একনেকে গিয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এতে করে এই অঞ্চলের খেলাধুলার আরও উন্নয়ন হবে। নতুন ফুটবল মাঠটি হবে আধুনিক সিনথেটিক টার্ফের। নতুন ক্রিকেট মাঠের সাথেও থাকবে আধুনিক সব সুবিধা। একসাথে ৪০০ জন প্রশিক্ষণার্থী এখানে প্রশিক্ষণ নিতে পারে সে ব্যবস্থা করা হবে।’

 

ঢাকা/রুবেল/কামরুল/ইয়াসিন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়