ঢাকা     বুধবার   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১১ ১৪৩১

ফিটনেসের সংজ্ঞা পাল্টে দেওয়া কর্নওয়াল

ফাহিম হোসেন মাজনুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৩:৩৩, ১৪ ডিসেম্বর ২০২১
ফিটনেসের সংজ্ঞা পাল্টে দেওয়া কর্নওয়াল

‘মেদ ভুঁড়ি, কী করি?’- পেটের মধ্যে অতিরিক্ত মেদ জমে যাওয়ায় দুশ্চিন্তা বাড়াটা স্বাভাবিক। আর খেলোয়াড়দের চাই এই ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগ। মোটা হলে ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন না উঠে পারেই না! এই তো গত বছরের কথা- স্পট ফিক্সিংয়ের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সময় নিষেধাজ্ঞায় থাকার পর পাকিস্তান সুপার লিগে করাচি কিংসের হয়ে শারজিল খান ফিরেই হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন। কিন্তু রমিজ রাজা ও শোয়েব আখতারের মতো সাবেক পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের নজর পড়লো তার ভুঁড়ির দিকে। তবে এই পাকিস্তানি এই ধ্যান ধারণার সঙ্গে নিশ্চয় দ্বিমত রয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। নয়তো রাকিম কর্নওয়ালের মতো ‘পর্বতসম’ ক্রিকেটারের ওপর কেন আস্থা রাখবেন অধিনায়ক ও নির্বাচকরা? অনাস্থার প্রশ্নই তো আসে না।

সাড়ে ৬ ফুট লম্বা আর ওজন ১৪০ কেজি! আধুনিক ক্রিকেটে যেখানে খেলোয়াড়রা জিম করতে ব্যস্ত থাকেন, সেখানে খুব একটা সময় হয়তো কাটান না কর্নওয়াল। বিশাল শরীর নিয়ে খুব একটা নেতিবাচক ভাবনাও নেই তার। বরং ক্রিজে থেকে বড় বড় শট খেলাতেই মনোযোগ তার, আর বল হাতে শারীরিক উচ্চতার সদ্ব্যবহারে কমতি নেই তার। অ্যান্টিগার তৃতীয় বৃহত্তম শহর লিবার্টায় জন্ম নেওয়া কর্নওয়ালের ক্রিকেটে আসা মামা ওয়াইডেন কর্নওয়ালের পথ ধরে, যিনি খেলেছেন ৫৩টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। ২০১৪ সালে ২০ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক, ২০১৯ সালের আগস্টে ৩১৯তম টেস্ট ক্যাপ পাওয়ার আগে প্রত্যেক মৌসুমে অন্তত ৪০ উইকেট! ২০১৭ সালের আঞ্চলিক সুপার৫০ টুর্নামেন্টে ২৫২ রান ও ১০ উইকেট নেয়ার পর নজরে আসেন তখনকার নির্বাচক সভাপতি কোর্টনি ব্রাউনের। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ছেলেটার ‘বিশেষ প্রতিভা’ আছে; তার দিকে বাড়তি নজর দেওয়া দরকার।

আরো পড়ুন:

পরের দুই বছরে কেবল তার চমৎকারিত্ব ফুটে উঠেছে। লিওয়ার্ড আইল্যান্ডের হয়ে অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্স করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘এ’ দলে জায়গা পান। শ্রীলঙ্কায় ১৯ গড়ে নেন ২৩ উইকেট। ২০১৮ সালে ইংল্যান্ড লায়ন্সের ক্যারিবিয়ান সফরে সফরকারীদের ৩-০ তে হোয়াইটওয়াশ করতে ‘এ’ দলের হয়ে নেন ১৯ উইকেট। অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২০১৯ সালে ভারতের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ইনজুরিতে পড়েন রোস্টন চেজ। কর্নওয়াল আগস্টে প্রথমবার টেস্ট দলে ডাক পান। ওই মাসেই ক্রিকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছ থেকে পান বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার। দুই সপ্তাহ পর পেয়ে যান টেস্ট ক্যাপ। সত্যিই ‘বিশেষ প্রতিভা’র অধিকারী কর্নওয়াল।

জীবনের প্রথম টেস্টে চেতেশ্বর ‍পুজারা, রবীন্দ্র জাদেজা ও মোহাম্মদ শামিকে স্পিন ভেল্কিকে পরাস্ত করেন কর্নওয়াল। বাংলাদেশ প্রথমবার পা রাখার আগে আরও তিনটি টেস্ট খেলেন তিনি। আফগানিস্তানকে ধরাশায়ী করতে এক ইনিংসে ৭ উইকেটসহ ম্যাচে নেন ১০ উইকেট। এরপর অবশ্য ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ছিলেন উইকেটশূন্য।

দ্বিতীয় সারির দল নিয়ে বাংলাদেশের স্পিন স্বর্গে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, প্রথম তিন ম্যাচে ১৩ উইকেট নেওয়া কর্নওয়ালের হাতেই ছিল স্পিন আক্রমণের ভার। সেখানে যে তিনি সফল তা না বললেও চলে। তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচেই ৫ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে হুঙ্কার দিয়ে রেখেছিলেন। চট্টগ্রামে প্রথম টেস্টে দুই ইনিংসে ২ ও ৩ উইকেট নিলেন। অবশ্য তার অবদানকে ছাপিয়ে যায় কাইল মায়ার্স বীরত্বে।

মঞ্চটা সাজানো ছিল ঢাকা টেস্টে। প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে তিনশ রান পার হতে দিলেন না। আর দ্বিতীয় ইনিংসে পেলেন আরও চার উইকেট। তার স্পিনে ধরাশায়ী নাজমুল হোসেন শান্ত, মোহাম্মদ মিথুন, লিটন দাশ ও তাইজুল ইসলাম। শুধু উইকেট নিয়েই ক্ষান্ত হননি। আরও তিন উইকেটে তার অবদান দারুণ। লেগ স্লিপে দাঁড়িয়ে মুমিনুল হকের ক্যাচটা সহজেই ধরলেন, তার ঘণ্টাখানেক আগে উইকেটকিপার জশুয়া ডা সিলভার গ্লাভসে আঘাত করে মাধ্যকর্ষণ শক্তির টানে নিচে নামতে থাকা বলটি মাটিতে পড়ার আগেই ধরলেন।

ম্যাচের শেষ ৩০ মিনিটের কথাই ধরুন। এই কর্নওয়ালের দুটি ওভারে দশম উইকেটে মিরাজ দুটি ছয় ও দুটি চার মারলেন। চল্লিশেরও বেশি লক্ষ্যটা কমে এলো বিশের কাছাকাছি। এমন অবস্থায় ফিল্ডিং দল যে স্নায়ুচাপে ভোগে, তা ভুগছিল ক্যারিবিয়ানরাও। কিন্তু টেস্ট সিরিজ যেখানে জেতার সুযোগ তা লুফে নিতে ভুল করেনি তারা। কম শক্তিশালী ও তৃতীয় জৈব সুরক্ষা বলয়ে থাকা দলটি তাদের উজ্জীবনী শক্তি ধরে রেখেছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আর সেটা যে কর্নওয়ালের মধ্যেও কম ছিল না, তা নিশ্চিত। ম্যাচ শেষে ২৮ বছর বয়সী অফস্পিনার বললেন, ‘আজ সকালেও স্লিপ ফিল্ডিং নিয়ে অনেক কাজ করছিলাম।’ সেই কাজটা ফলপ্রসূও হয়েছে। মুহূর্তটা এসেও গেলো। জোমেল ওয়ারিকানের ঘুরানো বল মেহেদী হাসান মিরাজের ব্যাটের আউটসাইড এজে লেগে নিচের দিকে ছুটলো, গন্তব্য কর্নওয়ালের দিকেই। ডানদিকে ডাইভ দিয়ে অবিশ্বাস্য এক ক্যাচ ধরলেন ‘দ্য মাউন্টেইন ম্যান’।

শেষ উইকেট নেওয়ার আনন্দে ওয়ারিকান ডিপ থার্ড ম্যানের দিকে ছুটলেন। কিন্তু অবদানটা যে কোনও অংশে কর্নওয়ালের কম নয়, তা ভুলে যাননি সতীর্থরা। দুজন তো লাফ দিয়ে উঠে গেলেন কর্নওয়ালের কোলে। ওই দুজনের বোঝা হয়তো কিছুই মনে হয়নি তার, কিন্তু এই দীর্ঘদেহী অলরাউন্ডারের বোঝা সামলাতে পারলো না বাংলাদেশ। ফিটনেসের সংজ্ঞা যেন পাল্টে দিলেন কর্নওয়াল!

ঢাকা/ফাহিম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়