পড়াশোনা-ক্রিকেট, দুই নৌকায় পা রেখেও ‘ধ্রুবতারা’ ভেঙ্কটেশ
ফাহিম হোসেন মাজনুন || রাইজিংবিডি.কম
‘আমি ছিলাম মেধাবী ছাত্র, শুধু পাঠ্যপুস্তকে ঝোঁক ছিল। গোঁড়া দক্ষিণ ভারতীয় পরিবারের ক্ষেত্রে যা হয় আর কী, বাবা-মারা তার বাচ্চাদের পড়াশোনা করতেই চাপ দেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ভিন্ন ব্যাপার, আমার মা আমাকে ক্রিকেট খেলার জন্য ধাক্কা দিত।’- এই কথা ভেঙ্কটেশ আইয়ারের। উল্টোপথে তাকে হাঁটিয়ে ভুল করেননি তার মা, গত সোমবার আবুধাবিতে কলকাতা নাইট রাইডার্সের জার্সিতে অভিষেকেই তা প্রমাণ হয়েছে। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে ২৭ বলে ৭ চার ও ১ ছয়ে ৪১ রানের ইনিংস খেলে দলকে জেতান ৯ উইকেটে। হৈচৈ পড়ে যায় তাকে নিয়ে। ধুমকেতুর মতো কিছু সময়ের জন্য নয়, ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকতে এসেছেন, সেই প্রমাণ দিলেন মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিপক্ষে ৩০ বলে ৪টি চার ও ৩টি ছয়ে ৫৩ রান করে। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে ৭ উইকেটের বিরল জয় পেয়ে যায় কলকাতা।
দলের কোচ ব্রেন্ডন ম্যাককালাম যার মাঝে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ছায়া খুঁজে পাচ্ছেন। আর পার্থিব প্যাটেল যুবরাজ সিংকে দেখছেন তার মাঝে। কতটা স্বাচ্ছন্দে ব্যাটিং করছেন তা প্রমাণ পাওয়া যায় কলকাতা অধিনায়ক এউইন মরগ্যানের বক্তব্যে, ‘মনে হচ্ছে যেন প্রস্তুতি ম্যাচ খেলছে সে।’
কী দারুণ স্ট্রোক ভেঙ্কটেশের ব্যাটে। ব্যাটকে যেন জাদুর কাঠি বানিয়ে একের পর এক বল আছড়ে ফেলছেন বাউন্ডারির এপাড়-ওপাড়। যে ক্রিকেটকে প্রচুর ভালোবাসেন, সেই ক্রিকেট তো তার প্রতিদান এভাবেই দিবে। কতটা ভালোবাসেন, সেই গল্প না হয় শোনাই যাক।
ভালোবাসার শুরুটা হয়েছে মায়ের জোরাজুরিতে, ‘সত্যি কথা বলি, আমি খেলা শুরু করেছিলাম মায়ের জোরাজুরিতে। সারাক্ষণ ঘরে বসে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে থাকা পছন্দ করতেন না। বলতেন যাও মাঠে গিয়ে শক্তি কিছুটা খরচ করে এসো।’ একসময় প্রেমে পড়ে গেলেন ক্রিকেটের, তাই বলে কি পাঠ্যপুস্তকও ছেড়েছিলেন! উহু, পড়াশোনা আর ক্রিকেট দুই নৌকায় পা রেখে তরতর করে এগিয়ে গেছেন স্বাচ্ছন্দে। তার জন্য নতুন প্রবাদ- যে পড়াশোনা ভালো করে, সে ক্রিকেটও ভালো খেলে।
বয়স যখন ঊনিশের কাছে, তখন ক্রিকেট নিয়ে এক ধরনের ভালো লাগা তৈরি হয় ভেঙ্কটেশের। বি.কম ডিগ্রির জন্য ভর্তি হন, পাশাপাশি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি (সিএ) ডিগ্রিটাও নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। ২০১৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করার পর জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলো। সিএ ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিলে ছাড়তে হবে খেলা, অন্তত কিছুদিনের জন্য ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হবে।
ততদিনে মধ্য প্রদেশ সিনিয়র টিমের সঙ্গে টি-টোয়েন্টি ও ৫০ ওভারের ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে গেছে। রাজ্যের অনূর্ধ্ব-২৩ দলের অধিনায়ক। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক সময়ের ব্যাপার মাত্র। কী করবেন? শুনলেন মনের কথা, ‘আমি সিএ না করার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং অর্থনীতিতে এমবিএ করতে চাইলাম। অনেক প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েছি, স্কোরও ভালো ছিল। একটা ভালো কলেজেও ভর্তি হলাম। আমার ফ্যাকাল্টি ক্রিকেট পছন্দ করত, এটা ছিল আমার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার। তারা দেখল যে আমি ভালো করছিলাম, তাই ক্লাসে উপস্থিতির ব্যাপারে তারা ছাড় দিলো, এমনকি নোট তৈরি করা ও পরীক্ষাতেও।’
ট্রেনিং কিংবা ক্লাস থাকলে আগেরটাকেই বেছে নিতেন ভেঙ্কটেশ। কারণ তার পড়াশোনা আয়ত্ত করা ছিল ডাল-ভাতের মতো ব্যাপার, ‘আমার উপলব্ধি শক্তি অনেক ভালো ছিল। যখন পড়াশোনা করতাম, তখন খুব মনোযোগ দিয়ে করতাম। খেলার ব্যাপারেও তাই। কম উপস্থিতি হলেও তারা আমাকে ছাড় দিয়েছে, ইন্টার্নশিপও করেছিলাম।’
পড়াশোনা শেষ না হতেই এবার এলো চাকরির প্রস্তাব। যে-সে চাকরি নয়, ‘বিগ ফোর’ অ্যাকাউন্টিং ফার্ম থেকে প্রস্তুাব পেলেন ২০১৮ সালে, যার সদর দপ্তর বেঙ্গালুরুতে। বিশাল অঙ্কের বেতন। কী করবেন এখন! শহর ছাড়লে ক্রিকেট আর খেলা হবে না। জীবনের প্ল্যান বি বেছে নিলেন, ‘আমি জানতাম যে এই প্রস্তাব গ্রহণ করব না। কারণ শহর ছেড়ে যেতে হতো, তাতে করে ক্রিকেটও শেষ হতো। আমাদের সবার জীবনে কোনো না কোনো সময় প্ল্যান বির প্রয়োজন হয়, তাই না?’
চাকরি হাতছাড়া করার সিদ্ধান্ত খুবই কঠিন ছিল। কিন্তু প্রথম শ্রেণিতে তার স্বপ্নের অভিষেক হয় ওই বছরের ডিসেম্বরে, রঞ্জি ট্রফিতে মধ্য প্রদেশের হয়ে। ২০১৫ সাল থেকে ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকা ভেঙ্কটেশের সুসময় আসে ২০২০-২১ মৌসুমে। সাদা বলের ক্রিকেটে দুর্দান্ত। সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে পাঁচ ইনিংসে ৭৫.৬৬ গড় ও ১৪৯.৩৪ স্ট্রাইক রেটে পাঁচ ইনিংসে ২২৭ রান করে দলের শীর্ষ ব্যাটসম্যান। এরপর এলো তিন দিনের প্রতিযোগিতা, বিজয় হাজারে ট্রফিতে পাঞ্জাবের বিপক্ষে ১৪৬ বলে ১৯৮ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলে মধ্য প্রদেশকে এনে দেন ৩ উইকেটে ৪০২ রানের সংগ্রহ। পাঁচ ম্যাচে করেন ২৭৩ রান।
এমন ইনিংস খেলা ভেঙ্কটেশ নজর এড়ায়নি। কলকাতা নাইট রাইডার্সের স্কাউটিং টিম এই বছরের আইপিএল নিলামের আগে ইন্দোর থেকে তাকে ট্রায়ালের জন্য মুম্বাইতে ডাকে এবং সই করে। দলের অ্যানালিস্ট এআর শ্রীকান্ত বলছিলেন, ‘তার যা দেখেছি আমাদের পছন্দ হয়েছে। সে একজন ব্যাটসম্যান, টপ অর্ডারে ব্যাট করতে পারে এবং প্রয়োজনে লোয়ার অর্ডারও সামলাতে পারে। এটা বিশেষ অ্যাডভান্টেজ যোগ করেছে এবং মিডিয়াম পেসে বলও করতে পারে।’
নজর কাড়লেও আইপিএলে তাকে বসে থাকতে হয়েছে ভারত পর্বে। বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি, জানান মধ্য প্রদেশের কোচ চন্দ্রকান্ত পন্ডিত, ‘আমাকে ফোন করেছিল। একাদশের বাইরে বসে থেকে বিরক্ত লাগছিল তার। আমি বলেছিলাম বাইরে বসে থেকেও অনেক কিছু শেখা যায়। সুযোগের জন্য অপেক্ষা করো।’
সুযোগ এলো আমিরাত পর্বে। এখন ভেঙ্কটেশ নাম সবার মুখে মুখে। নিজেকে কতদূর দেখতে চান ২৬ বছর বয়সী এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। না এসবে বিশ্বাসী নন তিনি, তার পথ যে অন্য। ভেঙ্কটেশের জীবন দর্শন কী, জানেন? তামিল ব্লকবাস্টার পাদায়াপ্পায় তার প্রিয় অভিনেতা রজনীকান্তের একটি পাঞ্চলাইন, ‘ইয়েন ভাঝি, থানি ভাঝি’। বাংলা অর্থ ‘আমার পথ সবার চেয়ে আলাদা।’
‘এই সংলাপ আমার জীবনেরও পাঞ্চলাইন। এটা চমৎকার এক সফর, আশা করি যে সফরে আরও অনেক শিখব এবং ভালো অভিজ্ঞতা হবে।’- অনিশ্চিত যাত্রা, তবুও কতটা আত্মবিশ্বাসী ভেঙ্কটেশ!
ঢাকা/ফাহিম