লাল সবুজের বিবর্ণ বিশ্বকাপে হলুদ উৎসব
সাইফুল ইসলাম রিয়াদ, দুবাই থেকে || রাইজিংবিডি.কম
বাংলাদেশ সময় রাত ১টা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল শেষ হয়েছে প্রায় দুই ঘণ্টা। এখনো মাঠ ছেড়ে যায়নি চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল। যে মাঠ তাদের বিশ্বসেরার তকমা এনে দিয়েছে সেই মায়াবী মাঠ কী সহজে ছেড়ে যাওয়া যায়! অজিরাও যায়নি।
দুবাই স্টেডিয়াম প্রাঙ্গনে তখন চ্যাম্পিয়নদের বরণ করার জন্য চ্যাম্পিয়ন লেখা একটা গেট সাজানো হয়েছে। মাঝে রেড কার্পেট। দুই পাশে হলুদ জামা পরিহিত একদল তরুণী। আছে ঢোল-বাজনার ব্যবস্থাও। অ্যারন ফিঞ্চের দল টিম হোটেলের উদ্দেশ্যে বেরোতেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তাদের উষ্ণ অভ্যার্থনা জানানো হয়।
এর আগে ৫ বার ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী মাইটি অস্ট্রেলিয়ার প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয় বলে কথা। টি-টোয়েন্টিতে এর আগে কখনো ট্রফি ছোঁয়ার সৌভাগ্য হয়নি। এবার সুযোগ পেয়েই আর হাতাছাড়া করেনি অস্ট্রেলিয়া। কর্তৃত্ব দেখিয়ে তাদেরই প্রতিবেশি নিউ জিল্যান্ডকে ৮ উইকেটে উড়িয়ে প্রথমবার সংক্ষিপ্ত সংস্করণে বিশ্বসেরা হওয়ার স্বাদ পায় ক্যাঙ্গারুর দল।
গত ১৭ অক্টোবর মাসকটে ওমান-পাপুয়া নিউগিনির ম্যাচ দিয়ে শুরু হওয়া ২৮ দিনের এই বিশ্বকাপ শেষ হয় গতকাল ১৪ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ড ম্যাচ দিয়ে। স্বাগতিক দলের ১০ উইকেটে জয় দিয়ে শুরু আর শেষ হয় অস্ট্রেলিয়ার হলুদ উৎসবে। ৪৫ ম্যাচের এই জমজামট আসরে ব্যাটসম্যানরা যেমন রাজত্ব করেছেন, তেমনি বোলাররাও ছড়ি ঘুরিয়েছেন। চার-ছক্কার ফুলঝুরি, সেঞ্চুরি, হ্যাটট্রিক কিংবা ৫ উইকেট সবই দেখেছে বিশ্ববাসী।
সুপার টুয়েলভ থেকে এক প্রকার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সেমিফাইনালে উঠেছে অস্ট্রেলিয়া। গ্রুপ টু-তে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে স্রেফ রানরেটে এগিয়ে নিশ্চিত করেছিল শেষ চার। এরপর অস্ট্রেলিয়া দেখিয়েছে তাদের আভিজাত্য। বড় মঞ্চে এলে যে তারা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে তার প্রমাণ দিয়েছেন আরও একবার। অথচ সাম্প্রতিক সাফল্যসহ সবকিছু মিলিয়ে কেন উইলিয়ামসনের হাতে বিশ্বকাপের ট্রফি উঠুক এটি চেয়েছিলেন অনেকে।
ক্রিকেটের ঋষি উইলিয়ামসন ব্যাট হাতে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে। লাভ হয়নি। ভাগ্যদেবী যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন কিউইদের থেকে। এক সময় শুধু সেমিফাইনালে হারা নিউ জিল্যান্ড সবশেষ আইসিসির চারটি বিশ্বকাপের তিনটিতেই ফাইনালে হেরেছে। মাঝে একমাত্র ২০১৬ সালের বিশ্বকাপে ফাইনালের দেখা পায়নি নিউ জিল্যান্ড। আসলে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের দাপটে টিকতে পারেননি কিউই বোলাররা।
এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি চমক দেখিয়েছে পাকিস্তান। বিশেষ করে প্রথম ম্যাচেই ভারতকে ১০ উইকেটে হারিয়ে যেন বার্তা দিতে চেয়েছিল বাবর আজমের দল। একমাত্র দল হিসেবে সুপার টুয়েলভের ৫টি ম্যাচেই জিতে পাকিস্তান। সেমিফাইনালেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তারা ফেভারিট ছিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পেরে ওঠেনি তারা। বিদায় নিতে হয় সেমিফাইনাল থেকেই। ব্যাটিং গভীরতার জন্য এবার আলোচিত দল ছিল ইংল্যান্ড। সেভাবেই এগোচ্ছিল ফাইনালের পথে। কিন্তু সেমিফাইনালে নিউ জিল্যান্ডের কাছে হার মানতে হয় জেসন রয়-জস বাটলারদের।
আইপিএল খেলে অন্যতম ফেভারিট হিসেবে বিশ্বকাপ খেলতে এসে হতাশ করেছে ভারত। প্রথম ম্যাচেই প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের কাছে ১০ উইকেটে হার। এমন হারে ভূত দেখার মতো চমকে যাওয়া বিরাট কোহলিরা পরের ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষেও জিততে পারেননি। এই দুই হারে ভারতের এপিটাপ লেখা হয়ে যায়। চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে খেলতে এসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের নামের সুবিচার করতে পারেনি। ক্রিস গেইলদের পারফরম্যান্স ছিল সাদামাটা। ৫ ম্যাচে তাদের একমাত্র জয় বাংলাদেশের বিপক্ষে।
এদিকে শ্রীলঙ্কা দল জয় পেয়েছে দুটিতে। দল হিসেবে তারা তাদের অবশ্য এর চেয়ে বেশি পাওয়ার কথাও নয়। তবে সবচেয়ে বেশি দুঃখ নিয়ে যদি কোনো দল বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় তাহলে সেটি দক্ষিণ আফ্রিকা। চারটি ম্যাচ জিতেও স্রেফ রানরেটের ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে তারা সেমিফাইনালে উঠতে পারেনি।
দল হিসেবে আফগানিস্তান প্রত্যাশিত ফলই করেছে। দুটি ম্যাচ জিতেছে, আর হেরেছে বড় দলগুলোর বিপক্ষে।
প্রথমবারের মতো এবারের বিশ্বকাপ খেলেছে পাপুয়া নিউগিনি ও নামিবিয়া। প্রথম রাউন্ডের দুই গ্রুপ থেকে একটি ম্যাচও জেতেনি পাপুয়া নিউগিনি ও নেদারল্যান্ড। দুই গ্রুপ থেকে শ্রীলঙ্কা-নামিবিয়া ও বাংলাদেশ-স্কটল্যান্ড সুপার টুয়েলভে উঠে আসে। আর সুপার টুয়েলভে বাংলাদেশ-স্কটল্যান্ড কোনো ম্যাচেই জয় পায়নি।
মাসকটে স্কটিশদের বিপক্ষে হেরে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ শুরু হয়েছিল। এরপর সুপার টুয়েলভে এসে প্রত্যেকটি ম্যাচেই হেরেছে লাল সবুজের দল। শ্রীলংকা-ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়েছিল আর ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে স্রেফ উড়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডকে ঘরের মাঠে উড়িয়ে টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ে ষষ্ঠ স্থানে থেকে বিশ্বকাপে এসেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। মাঠের পারফরম্যান্সের চেয়েও মাঠের বাইরের বিষয়ে মনোযোগ বেশি ছিল ক্রিকেটারদের। ইনজুরির কারণে একাদশ মেলানো কষ্ট হয়ে গিয়েছিল টিম ম্যানেজম্যান্টের জন্য। সবকিছু মিলিয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের একমাত্র অর্জন র্যাঙ্কিংয়ে আট নম্বরে থেকে পরের বিশ্বকাপে সরাসরি কোয়ালিফাই করা।
একটু পরিসংখ্যানে চোখ বুলানো যাক। এই বিশ্বকাপে একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান জস বাটালার। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন এই বিস্ফোরক ব্যাটসম্যান। হ্যাট্ট্রিক করেছেন ওয়ানিন্দউ হাসারাঙ্গা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আর কাগিসো রাবাদা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ৮ ম্যাচ খেলে সবচেয়ে বেশি ১৬টি উইকেট হাসারাঙ্গার। ৬ ম্যাচ খেলে সবচেয়ে বেশি ৩০৩ রান বাবর আজমের। অ্যাডাম জাম্পা বাংলাদেশের বিপক্ষে ও মুজিবুর রহমান স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৫ উইকেট করে নিয়েছিলেন।
টি-টোয়েন্টি মানেই যে চার-ছক্কা কিংবা ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেট নয়, তা দেখা গেছে এই বিশ্বকাপে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত, পরিবেশ-ম্যাচের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াসহ যারা দক্ষতা দেখাতে পেরেছিলেন, তারাই শেষ হাসি হেসেছেন।
ভারতের আয়োজনে এ বছরের বিশ্বকাপ হয়েছে ওমান ও আরব আমিরাতে। করোনাকালিন প্রথম বিশ্বকাপের আসরকে এক কথায় বললে বলা যায়, ‘কাছে থেকেও দূরে।’
ক্রিকেটার-ক্রিকেট মাঠ সংশ্লিষ্ট সকলেই ছিলেন জৈব সুরক্ষা বলয়ের চার দেয়ালে বন্দি। কাউকেই যেন ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সরাসরি থাকার ব্যবস্থা করেছিল আইসিসি। তবে করোনা নেগেটিভ সনদ দেখিয়ে। উপমহাদেশের দলগুলোর খেলাতে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। একমাত্র আবুধাবিতে করোনা নেগেটিভ সনদ দেখিয়ে দর্শকদের ঢুকতে হয়েছে স্টেডিয়ামে।
করোনাকালিন এই বিশ্বকাপে কোনো ক্রিকেটার আক্রান্ত হননি এই ভাইরাসে। এটি এক প্রকার স্বস্তির ছিল।
ঢাকা/আমিনুল