মেসি-রোনালদোর আলো আঁধারির বছর
করোনাভাইরাসের কারণে গত বছর ফুটবল ছিল চুপিসারে। কিন্তু এবার রেকর্ড সংখ্যক ম্যাচ হয়েছে। ২০২১ সালে ঘটেছে নানা সাফল্য-ব্যর্থতা আর পাওয়া না পাওয়ার ঘটনা, তৈরি হয়েছে অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। বর্ষপরিক্রমায় তেমন কিছু মুহূর্ত আর ঘটনা ফিরে দেখা যাক!
আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকা ও মেসির আক্ষেপ মোচন
লিওনেল মেসির ফুটবল জীবনের একমাত্র আক্ষেপ ছিল জাতীয় দলের জার্সিতে একটি ট্রফি জেতা। টানা দুটি কোপা আমেরিকা ও একটি বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠলেও যা ঘোচেনি। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
রিও ডি জেনেইরোর মারাকানায় গত ১০ জুলাই দিনটি আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় হয়ে থাকবে, মেসির জীবনেও। ২২ মিনিটে রদ্রিগো ডি পলের শট আয়ত্তে নিয়ে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার দারুণ এক গোল। বাদবাকি সময় এই স্কোর ধরে রেখে মেসির আজীবন লালিত স্বপ্ন পূরণ। ২৮ বছর পর আর্জেন্টিনার প্রথম মেজর ট্রফি, আর আকাশি নীল জার্সিতে মেসির প্রথম। জীবনের সেরা অর্জনে তিনি শুধু নেতৃত্ব দিয়েই ক্ষান্ত হননি, দলের সবগুলো গোলে তার একারই অবদান ছিল ৬০ শতাংশ। চার গোল করেছেন, করিয়েছেন ৫টি। গোল্ডেন বুটও জিতেছেন মেসি।
কোকের বোতল সরিয়ে আলোচনায় রোনালদো
হাঙ্গেরির বিপক্ষে ইউরোতে পর্তুগালের প্রথম ম্যাচের আগের সংবাদ সম্মেলনে ঢুকে সামনে রাখা কোকাকোলার বোতল সরিয়ে সাংবাদিকদের পানির বোতল দেখিয়ে বলেন, ‘পানি খান।’ ওই ঘটনা শোরগোল ফেলেছিল পুরো ইউরোজুড়ে। কোকাকোলার তো ৩৪ হাজার কোটি টাকার লোকসান গুনতে হয়েছিল। স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে কঠিন খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা পর্তুগাল অধিনায়ককে অনুসরণ করে আরো কয়েকজন সামনে থাকা কোক ও বিয়ারের বোতল সরিয়ে আলোচনায় আসেন। তবে রোনালদোর এই কাণ্ড কারো কাছে ভালো লেগেছে, আবার কেউ কেউ বলেছেন বাড়াবাড়ি।
ইতালির পুনরুত্থান
২০১৮ সালের ফিফা বিশ্বকাপেই জায়গা হয়নি ইতালির। ইউরোপিয়ান ফুটবলে তাদের অবনমন ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু রবার্তো মানচিনির হাত ধরে ফিনিক্স পাখির মতো তাদের পুনরুত্থান হয়। লন্ডনে ১১ জুলাই স্বাগতিক ইংল্যান্ডের ‘কামিং টু হোমের’ স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে ৫৩ বছরে প্রথম ইউরো জেতে ইতালি এবং আন্তর্জাতিক ফুটবলে টানা সবচেয়ে বেশি ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়ে তারা।
মেসির বার্সেলোনা বিচ্ছেদ
আর্জেন্টিনার জার্সিতে অপ্রাপ্তির অবসান ঘটিয়ে এক মাস না যেতেই বিচ্ছেদের কান্না কাঁদতে হলো মেসিকে।
৬ আগস্ট এক বিবৃতি দিয়ে বার্সেলোনা জানিয়ে দেয়, মেসির সঙ্গে ১৭ বছরের সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে আর্থিক জটিলতার কারণে। ব্যস, ফ্রি ট্রান্সফারে চোখের জলে বিদায় জানাতে হলো হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা দেওয়া ক্লাবকে, যেখানে ১০টি লা লিগা ও চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের অবিস্মরণীয় স্মৃতি।
বার্সেলোনার অগুণতি রেকর্ডের মালিক মেসি যোগ দেন প্যারিস সেন্ট জার্মেইতে। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফ্রান্সে পা রাখেন তিনি। কিন্তু নতুন ক্লাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি এখনো। ১৬ ম্যাচে পিএসজিতে গোল করেছেন ৯টি।
ঘরে ফিরলেন রোনালদো
মেসির ঘরছাড়ার বিষাদের মধ্যে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ঘরে ফেরেন। ১২ বছর পর পুরো ইউরোপকে চমকে দিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফেরা নিশ্চিত করেন পর্তুগিজ উইঙ্গার।
চমক বলার কারণ! জুভেন্টাস যে রোনালদো ছাড়ছেন, সেটা পাকা হওয়ার পর থেকে কেবল ম্যানসিটির নামই তার পরবর্তী গন্তব্য হিসেবে শোনা যাচ্ছিল। গুঞ্জন ছিল, পেপ গার্দিওলার ক্লাবের সঙ্গে চুক্তিতে সম্মতিও দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু না, দলবদলের বাজার বন্ধ হওয়ার দিন কয়েক আগে জুভেন্টাস থেকে ব্যাগবোচকা নিয়ে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে পা রাখলেন রোনালদো।
আন্তর্জাতিক গোলে এক নম্বরে রোনালদো
দুই বছরের চুক্তি করলে তখনো ম্যানইউর জার্সি গায়ে দেওয়া হয়নি। তার আগেই এক অনন্য রেকর্ড গড়ে ফেললেন রোনালদো। ইরানের ফুটবল কিংবদন্তি আলী দাইয়িকে পেছনে ফেলে হয়ে গেলেন আন্তর্জাতিক ফুটবলের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
সেপ্টেম্বরের প্রথম দিন কাতার বিশ্বকাপের বাছাইয়ে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জোড়া গোল করেন রোনালদো। ৩৬ বছর বয়সী ফরোয়ার্ডের গোলসংখ্যা দাঁড়ায় ১১১টি। তার স্বীকৃতিতে পান গিনেজ বিশ্ব রেকর্ডের সনদপত্রও।
কোয়ারেন্টাইন বিতর্কে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচ বাতিল
কাতার বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচে ব্রাজিলের মাঠে নেমেছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু খেলা শুরুর পাঁচ মিনিট যেতেই ব্রাজিলিয়ান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের হাতাহাতি বাকবিতণ্ডায় বাতিল হয় ম্যাচ। ব্রাজিলের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের দাবি, কোয়ারেন্টাইন শর্ত না মেনে আর্জেন্টিনার চার ফুটবলার মাঠে নেমেছে। এরই জের ধরে আর মাঠে খেলা গড়ায়নি
কোলনে টিউমার, হাসপাতালে পেলে
রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে গিয়ে কোলনে টিউমার ধরা পড়ে পেলের। হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ব্রাজিলের কিংবদন্তিকে। সফলভাবে টিউমার অপসারণ করা হলেও মাসখানেক ধরে সাও পাওলোর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আইসিইউতে তার যাওয়ার বিষয়টি গভীর উদ্বেগে ফেলেছিল ভক্তদের।
তবে পেলে ও তার মেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভক্তদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগে চিন্তামুক্ত রাখেন। দীর্ঘ এক মাস পর বাসায় ফিরে যান তিনবারের বিশ্বকাপ জয়ী ব্রাজিল অধিনায়ক।
মেসির ব্যালন ডি’অর
উড়ছিলেন রবার্ট লেভানডোভস্কি। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার জার্সিতে কোপা আমেরিকা জিতে ব্যালন ডি’অরের দৌড়ে ফেভারিট ছিলেন মেসি। আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের শিরোপা খরা ঘোচানোয় দারুণ নেতৃত্ব দেওয়ার স্বীকৃতি পান তিনি। পোলিশ স্ট্রাইকারকে ৩৩ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে সপ্তম ব্যালন ডি’অর জেতেন ৩৪ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাঁচটি ব্যালন ডি’অর জেতা রোনালদোর সঙ্গে ব্যবধান দুয়ে বাড়ান মেসি। পর্তুগিজ তারকা তো সেরা তিনেই ছিলেন না। মেসি সোনালি বলটি হাতে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি জানি না এটা আমার জীবনের সেরা বছর ছিল কি না, আমার ক্যারিয়ার তো লম্বা। কিন্তু অনেক কঠিন সময় আর সমালোচনার পর আর্জেন্টিনার সঙ্গে শিরোপা জেতা ছিল বিশেষ কিছু।’
খাদের কিনারায় ইতালি-পর্তুগাল
ইউরোপের দুই জায়ান্ট ইতালি ও পর্তুগালকে কাতার বিশ্বকাপের টিকিট পেতে এবার দুর্ভাগ্যজনকভাবে খেলতে হচ্ছে প্লে অফ। কিন্তু প্লে অফের ড্র এমন সমীকরণে ফেলে দিয়েছে যে, হয় পর্তুগাল নয়তো ইতালি পাবে মূল পর্বের টিকিট। মানে ২০২২ সালে যে কোনো এক দল যাবে কাতারে। মানে এই প্রথমবার রোনালদোর বিশ্বকাপ খেলা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। নতুন বছরের প্লে অফ জিততে না পারলে হয়তো অবসরই নিয়ে নিবেন, এমন গুঞ্জনে জোরেশোরে বাতাস লেগেছে।
আগুয়েরোর অবসর
মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই ফুটবলকে বিদায় বলতে হলো আর্জেন্টিনা তারকা সার্জিও আগুয়েরোকে। বার্সেলোনার হয়ে গত ৩০ অক্টোবর ম্যাচ খেলার সময় বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে যান। ধরা পড়ে হৃদরোগ।
প্রাথমিকভাবে তিন মাসের জন্য মাঠের বাইরে ছিটকে গেলেও সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে আগুয়েরো জানিয়ে দেন, নিজের সেরাটা আর দেওয়া সম্ভব নয় কখনো। তাই ফুটবলকে চিরদিনের জন্য বিদায় বলে দেন।
ঢাকা/ফাহিম