ঢাকা     রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৯ ১৪৩১

শেন ওয়ার্ন: আনন্দ-বিতর্কের উপভোগ্য ইনিংস!

এম. এম. কায়সার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৭, ৫ মার্চ ২০২২   আপডেট: ১৩:৩৮, ৫ মার্চ ২০২২
শেন ওয়ার্ন: আনন্দ-বিতর্কের উপভোগ্য ইনিংস!

শেন ওয়ার্ন (ফাইল ফটো)

‘‘রড মার্শের মৃত্যু সংবাদ শুনে ভীষণ দুঃখ পেলাম। আমাদের এই খেলায় তিনি ছিলেন লিজেন্ড। তরুণ-তরুণীদের জন্য ছিলেন দারুণ প্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্ব। ক্রিকেট নিয়ে রড ছিলেন ভীষণ যত্নবান। বিশেষ করে অস্ট্রেলীয় এবং ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারদের তিনি অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। রড এবং তার পরিবারের জন্য ভালবাসা এবং ভালবাসা। শান্তিতে ঘুমাও সতীর্থ।’’

৪ মার্চ সকালে অস্ট্রেলীয় গ্রেট রস মার্শের মৃত্যুর পর তার স্বদেশী আরেক গ্রেট শেন ওয়ার্ন এই শোকগাঁথা লিখে টুইট করেন।

কে জানতো সেদিনই সন্ধ্যায় খোদ শেন ওয়ার্নের জন্য বিশ্বকে শোকগাঁথা লিখতে হবে! হলোও তাই। এদিন গোটা বিশ্বের ক্রিকেট আনন্দকে স্তদ্ধ করে দিলো শেন ওয়ার্নের আকস্মিক মৃত্যুর খবর। মার্শকে শান্তিতে ঘুমানোর বার্তা দিয়ে নিজেও চলে গেলেন চিরঘুমে। তাও মাত্র ঘণ্টা কয়েকের ব্যবধানে।

ক্রিকেটের রহস্যময় চরিত্র শেন ওয়ার্ন তার শেষের জন্যও এমন রহস্য জমিয়ে রাখবেন- কে ভেবেছিল?

রড মার্শ স্ট্রোক করার পর লম্বা সময় আইসিইউতে ছিলেন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কাটছিল তার। শারীরিক পরিস্থিতি জানাচ্ছিল তার ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যেন তার মৃত্যু সংবাদের জন্য সবাই একধরনের প্রস্তুত হয়েই ছিল। ৪ মার্চের সকালে অ্যাডিলেডের হাসপাতালে মারা যান মার্শ।

থাইল্যান্ডে বসে মার্শের মৃত্যু সংবাদ শুনে নিজের অফিসিয়াল টুইটে শেন ওয়ার্ন শোকগাঁথা লিখেন। সেটাই শেন ওয়ার্নের বর্ণময় জীবনের শেষ টুইট। নিজ ভিলায় হার্ট অ্যাটাক হয় তার। সেই লড়াইয়ে জিততে পারেননি ওয়ার্ন। চিকিৎসকদের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও জীবন ফিরেনি তার। 

ক্রিকেট দুনিয়ার বর্ণময় চরিত্রের একজন ছিলেন ওয়ার্ন। ঠিক যাকে বলে ব্লাডি জিনিয়াস। পুরোটা তাই! ৯০ দশকের শুরু থেকে লেগ স্পিনের শৈল্পিকতাকে নতুন এক মাত্রা দিয়েছিলেন এই স্পিনার। বল তার হাতে যেন কথা বলতো। অফস্পিন, লেগস্পিন, গুগলি, স্ট্রেইটার, ফ্লিপারের সমন্বয়ে ক্যারিয়ারের ১৫ বছরের পুরোটা সময় জুড়ে লেগস্পিনকে আক্রমণের নতুন সংজ্ঞা দিয়েছিলেন ওয়ার্নি। 

বোলিং ক্যারিশমার সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। ব্যাটসম্যানের মানসিক অবস্থা পড়ে সেই অনুযায়ী রণক্ষেত্র সাজানো। ঝুঁকি নেওয়ার সাহস। জয়ের দুরন্ত ইচ্ছাশক্তি। গো ফর কিল-এই ছকে লড়াই জেতার জপ। এবং সর্বোপরি উপভোগের মন্ত্র আওড়ে জীবন কাটানো এসব কিছুরই অন্য নাম ছিল শেন কিথ ওয়ার্ন। 

শুরুটা সব না। শেষটাই আসল। কীভাবে আপনি শুরু করলেন সেটা কোনো কাজে আসবে না যদি আপনি পারফেক্ট ফিনিসিং টেনে ম্যাচটা শেষ না করতে পারেন। শেন ওয়ার্নের ক্রিকেট ক্যারিয়ার চিরায়িত সেই শিক্ষার উদাহরণ। ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে ভারতের বিরুদ্ধে সিডনিকে নিজের অভিষেক টেস্টটা দুঃসহ কাটে ওয়ার্নের। ড্র হওয়া সেই ম্যাচে ৪৫ ওভার বল করে ওয়ার্ন ১৫০ রান খরচায় পান মাত্র ১ উইকেট। শুরুর সেই ব্যর্থতায় ভেঙ্গে পড়েননি বলেই ওয়ার্ন টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ৭০৮ উইকেট নিয়ে। 

মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের মিউজিয়ামে ওয়ার্নের একটা স্লাইড শো দেখেছিলাম ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের সময়। নিজের ক্যারিয়ার প্রসঙ্গে ওয়ার্ন বলছিলেন, সিডনিতে নিজের অভিষেক টেস্টে সেই ব্যর্থতায় আমি মুষড়ে পড়িনি। বরং জ্বলে উঠেছিলাম। সাফল্যের জন্য আমি প্রচণ্ড তেতে ছিলাম। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যেভাবেই হোক আমাকে সেরাদের মধ্যে থাকতেই হবে। হয়তোবা শুরুর সেই টেস্টে ব্যর্থ না হলে আমার মধ্যে সাফল্যের খিদে তৈরি হতো না। 

ক্রিকেট মাঠে ওয়ার্ন যে কোনো স্পিনারের আরাধ্য-আদর্শ। কিন্তু মাঠের বাইরে? সম্ভবত একদম না। মাঠের ম্যাচ উইনার এই স্পিন জাদুকরের ব্যক্তিগত জীবনাচারণ এবং প্রতিনিয়ত বিতর্ক তৈরির লম্বা ফর্দ, তাকে ক্রিকেটের ‘প্লেবয়’ বানিয়ে দেয়।

ফুটবলের ম্যারাডোনার সঙ্গে ক্রিকেটের শেন ওয়ার্নের জীবন দর্শনে দারুণ মিল। আমার জীবন আমি আমার মতো করেই উপভোগ করবো- এমন মন্ত্রে সকাল-বিকাল, সন্ধ্যা-রাত কেটেছে ওয়ার্নের। আর তাই যিনি আগের বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে ম্যাচসেরা হয়েছেন সেই তিনিই আবার পরের বিশ্বকাপে মাদকের খপ্পরে পড়ে বহিস্কৃত হয়েছেন। অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচারের জন্য ট্যাবলয়েডের পাতায় রগরগে কাহিনী হয়েছে তাকে নিয়ে। ক্রিকেট জুয়াড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় জরিমানা গুনতে হয়েছে।

খেলার মাঠে অবিস্মরণীয় সব সাফল্য পেয়েছেন। আনন্দ নিয়েছেন, বিলিয়েছেন। ক্রিকেট থেকে অবসরের পর ধারাভাষ্যেও মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন ওয়ার্নি। কিন্তু ৯টা-৫টা ধরাবাঁধা অফিসের নিয়মে আটকে থাকার জীবন যে ওয়ার্নের নয়। তাই ধারাভাষ্য কক্ষে সময় দেওয়ার চেয়ে তাসের টেবিলেই তার মজা ও জমা বেশি!

বল ডেলিভারির ঠিক আগ মুহূর্তটা ছিল ক্রিকেটীয় এক অলস সৌন্দর্য্যে ছটা। অনেকের মতো দৌড়ে নয়, আলসে ভঙ্গি কয়েক পা হেঁটে বোলিং সীমান্তে এসে পৌঁছান। কব্জির মোচড়ে বলকে দিয়ে যেন কথা বলান। ঠিক যা করতে চেয়েছেন বল বুঝি তার সেই নির্দেশই মানে। পুরো যেন ওজের জাদুকর! 

ওয়েলডান ওয়ার্নি; আপনি ছিলেন ক্রিকেটের উপভোগ্য-আনন্দময় চরিত্র।

ঢাকা/সনি


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়