অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটে উল্কা পতন
পর পর দুই দিনে চিরদিনের জন্য প্যাভিলিয়নে ফিরলেন কিংবদন্তি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার রডনি মার্শ এবং শেন কিথ ওয়ার্ন। অস্ট্রেলিয়াকে বিশ্ব ক্রিকেটে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দুই প্রজন্মের এই দুই মহাতারকার অবদান চিরদিনের জন্য ধ্রুবতারা হয়েই জ্বলবে।
লিলি টমসনের তুখোড় বোলিংয়ের তুঙ্গ সময়ে মার্শ উইকেটের পিছনে ছিলেন সতর্ক শিকারি। ব্যাট করতেন ধূমকেতুর গতিতে। ওয়ার্নকে সর্বযুগের সেরা স্পিন বোলারদের সারিতে বিবেচনা করে গোটা বিশ্ব। মৃত্যু অনিবার্য। কার কখন কিভাবে মৃত্যু হবে জানেন একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তা। কিছু কিছু মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হয়। মার্শ এবং ওয়ার্নের সঙ্গে দেখা হয়েছে কথা হয়েছে। দুজনার ক্রিকেট নিয়ে লিখেছি। দুজনই অটোগ্রাফে করা আত্মজীবনী উপহার দিয়েছেন। ওয়ার্নের চ্যারিটিতে কাজ করেছি। অস্ট্রেলিয়ান হিসাবে, ক্রিকেটের ভক্ত অনুরাগী হিসাবে দুইজনার জীবন অবসানে ব্যথিত মর্মাহত।
মনে আছে শেন ওয়ার্নকে সামনা-সামনি দেখার সুযোগ হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া দলের বাংলাদেশ সফরের সময়। আমার দুটো ছেলেই (শুভ্র, অভ্র) কিশোর বয়স থেকেই ক্রিকেট খেলতো। শুভ্র দক্ষিণ আফ্রিকা আর অভ্র ছিল অস্ট্রেলিয়া সমর্থক। একদিন শেন ওয়ার্নকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম। অভ্র আমার সাথে ছিল। ও ওয়ার্নের লেগ স্পিন গ্রিপ দেখিয়েছিল। অভ্র যতটুকু ক্রিকেট খেলছে ওয়ার্নের দেখানো গ্রিপ অনুসরণ করে গুগলি, ফ্লিপারসহ লেগ স্পিন করতে পারতো।
কাল রাতে অভ্র আমাকে যখন ওয়ার্নের মহাপ্রয়াণের কথা এসএমএস করে জানালো তারপর থেকেই কিছু স্মৃতি চোখে ভাসছিল। কাল শুভ্রর সঙ্গে বসে পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচ উপভোগ করার সময় আমরা ওয়ার্নকে বার বার স্মরণ করেছি ধারাভাষ্যকার হিসাবে। ক্রিকেটের মহানায়ক হওয়ার পাশাপাশি ওয়ার্ন ধারাভাষ্যকার হিসাবেও ছিলেন শীর্ষস্থানীয়।
কোন বলটি এযাবৎ শতাব্দীর সেরা নির্ধারিত হয়ে আছে। তবু বলবো আবার দেখুন। ওয়ার্নের তিনটি বল— মাইক গাটিংকে করা লেগ স্ট্যাম্পের বাইরের লেগ স্পিন, বাসিত আলীকে করা একই ধরণের বল অথবা রিচি রিচার্ডসনকে করা সোজা বলটি। যুগ যুগ ধরে অনেক ক্ষণজন্মা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ক্রীড়াঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং করবেন। খেলার জন্য প্রখ্যাত, কিছু কারণে বিতর্কিত ওয়ার্নকে আমার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং ইংলিশ ফুটবলের বিস্ময় মানব জর্জ বেস্টের মতোই মনে হতো।
দুই বছর আগে ১১ নভেম্বর ইস্টল্যান্ড শপিং সেন্টারে প্রয়াত রড মার্শ এসেছিলেন তার সদ্য প্রকাশিত আত্মজীবনী প্রকাশনা উৎসবে। আমন্ত্রিত ছিলাম। পরিচয় হলো। কিছু কথার পর আমার ক্রিকেট অনুরাগ দেখে মুগ্ধ হয়ে অটোগ্রাফ করা আত্মজীবনী উপহার পেয়েছিলাম। যতদূর মনে পড়ছে বইটি আমি অনুজপ্রতিম আমিনুল ইসলাম বুলবুলের প্রতিভাবান ক্রিকেটার ছেলে মাহ্দী ইসলামকে দিয়েছি।
আব্দুল কাদির আর তারপর শেন ওয়ার্নের হাত ধরে বিশ্ব ক্রিকেটের হারিয়ে যেতে থাকা লেগ স্পিন জেগে উঠে। ওয়ার্ন নিজে রিচি বিনো আর ক্লারি গ্রিমেটকে অনুপ্রেরণা বলতেন। আব্দুল কাদির থেকেও শিখেছেন কিছু কৌশল। খেলা ছেড়ে ধারাভাষ্যকে বেঁচে নিয়েছিলেন। শেষ দেখা হয়েছিল ২০২২ আশেজ সিরিজের প্রথম খেলা উপলক্ষে গাবাতে। আমি, ছেলে শুভ্র আর নাতি জুহাইয়ের একসঙ্গে থাকায় কমেন্ট্রি বক্সের কাছে বিশেষ আসন পেয়েছিলাম। চিনতে পেরেছিল ওয়ার্ন। মেলবোর্ন থাকার সময় কয়েকবার ওয়ার্ন ট্রাস্টের বারবেকিউতে দেখা হয়েছে, বক্সিং ডে টেস্টে প্রায় প্রতিবছর এমসিসি প্যাভিলিয়নে হয়ে খেলা হতো।
নানা কারণে বর্ণালি ক্রিকেট জীবনটা ৫২ বছরে কিছুটা আগেই অবসান হলো। আর কখনো ভরাট গলার ক্রিকেট ধারাবিবরণী শোনা হবে না। এমসিসি স্পোর্টস জাদুঘরে ওয়ার্নের থ্রিডি শো দেখতে কষ্ট লাগবে। মনে পরে ২০১৫ বিশ্বকাপের সময় দর্শনার্থীরা কৃত্রিমভাবে ওয়ার্নের ৬টি বল খেলার সুযোগ পেতো।
সকাল থেকেই এবিসি টেলিভশন ওয়ার্কে নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বতারকাদের স্মৃতিচারণ দেখাচ্ছে। মার্শ, ওয়ার্নের প্রয়াণে বিশ্ব ক্রিকেটের দুই মহীরুহ অস্ত গেলেন।
লেখক: খ্যাতিমান ক্রীড়ালেখক ও প্রকৌশলী।
ঢাকা/আমিনুল