ব্যাটিং ব্যর্থতায় ভরাডুবি
নিজেদের দুর্গম দূর্গ শের-ই বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ১০ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে শেষ টেস্ট হেরে সিরিজও হারল বাংলাদেশ। এই হারের মুল কারণ— বাংলাদেশ দলের টপ ও লোয়ার অর্ডারের ব্যাটিং ব্যর্থতা। প্রথম ইনিংসে ২৪ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর মুশফিক লিটনের রূপকথার ব্যাটিং বাংলাদেশকে ম্যাচে রেখেছিল। বাংলাদেশের ৩৬৫ রানের ইনিংসে মুশফিক (১৭৫*) এবং লিটন (১৪১) ছাড়া বাকি ৩ জন মিলে করেছিলেন ৪৯ রান, ৬ জন শূন্য রানে আউট।
একই উইকেটে পুরো দল ভালো ব্যাটিং করায় ৫০৬ রান করে প্রথম ইনিংসে ১৪১ রান লিড নেয় শ্রীলঙ্কা। দ্বিতীয় ইনিংসে ফের ব্যাটিং ধসে ২৩ রানে নেই বাংলাদেশের শুরুর ৪ উইকেট। লিটন-সাকিবের প্রচেষ্টায় ইনিংস পরাজয়ের গ্লানি রক্ষা হলো। কিন্তু শেষ ৫ উইকেটে দল করলো মাত্র ১৩ রান, তাতে ম্যাচ জিততে মাত্র ২৯ রানের প্রয়োজন হয় শ্রীলঙ্কার। ৩ ওভারেই টার্গেট পুরো করে ১০ উইকেটে জয় পায় শ্রীলঙ্কা। সাঙ্গ হলো সিরিজ। ২৪ম দ্বিপাক্ষিক টেস্ট সিরিজে এটি শ্রীলঙ্কার ১৮ম জয়। বাংলাদেশ জিতেছে মাত্র ১টি।
অথচ বাংলাদেশ এই সিরিজে আকাশ জয়ের স্বপ্ন দেখেছিল। আশা ছিল ওদের দেশে অস্থিরতা, অপেক্ষাকৃত নবীন, স্বল্প অভিজ্ঞ বোলিং শক্তির অতিথি দলটিকে বাগে পাওয়া গেছে। এবার সিরিজ জিতবে বাংলাদেশ। তবে টেস্ট ক্রিকেটে দুই দলের পারস্পরিক অবস্থান, সাম্প্রতিক টেস্ট ফর্ম ও ক্রিকেট সংস্কৃতিতে অনেক এগিয়ে থাকা শ্রীলঙ্কাই হেসেছে শেষ হাসি।
বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট দলের বিপর্যয় নিয়ে আদৌ পোস্টমর্টেম করেছে বলে মনে হয় না। প্রতিটি সিরিজ শেষে সাফল্য ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করার সংস্কৃতি নেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে।
তবে তুখোড় অলরাউন্ডার সাকিবের (কোভিড সংক্রমণ, শেষ মুহূর্তে সেরে উঠা) দলে ফেরা, বেশ কিছু দিন পর তামিম, সাকিব, মুশফিককে একসাথে পাওয়া স্বস্তির কারণ ছিল। কিন্তু ইনজুরির কারণে তাসকিন, মিরাজ ছিটকে পড়ায় পূর্ণ শক্তির বোলিং পেলো না বাংলাদেশ। প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংস খেলে ছিটকে গেলো শরিফুল আর নাঈম। সংকুচিত হয়ে গেলো বিকল্প।
চট্টগ্রামের অনুর্বর উইকেটে প্রথম টেস্টে বেশ কিছু সময় জুড়ে খেলা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও ভালো খেলে ম্যাচ ড্র করে অতিথি দল। তবে লক্ষণীয় ছিল একই উইকেটে বাংলাদেশ স্পিনাররা রাজত্ব করলেও শ্রীলঙ্কার পেসারদের আনাড়ীর মতো খেলেছে বাংলাদেশ। বিশেষত কাসুন রাজিথাকে, যে কিনা কনকাশন বদলি হয়ে খেলেছিল। তামিম, মুশফিক, লিটনের ব্যাটিং, নাঈম, সাকিব, তাইজুলের বোলিং স্বস্তির কারণ ছিল, অর্জন ছিল অতোটুকুই।
ঢাকা টেস্টে এবাদত ফিরলো, মোসাদ্দেককে নেয়া হলো ব্যাটসম্যান কাম বাড়তি স্পিনার হিসাবে। বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে মিরপুরে টেস্ট ম্যাচে স্পিন খোঁয়াড় বানিয়ে বড়ো দলগুলো থেকেও জয় ছিনিয়ে নিয়েছে। তাই অনেকেই স্বপ্ন দেখলেন। অনেক আলোচনার উইকেট অনেকদিন পর চরিত্র পাল্টেছে মনে হলো। বাংলাদেশ টস জিতে ব্যাটিং নিয়েই বড়ো ধাক্কা। রাজিথা, আসিথা ঝড়ে ৭ ওভারের মাঝেই ২৪ রানে জয়, তামিম, শান্ত, মুমিনুল, সাকিবের উইকেট কর্পূরের মতো উড়ে গেলো।
জয়, তামিম, সাকিব শূন্য রানে, শান্ত ৮ আর মুমিনুল আউট মাত্র ৯ রান করে। মনে হলো আতঙ্কগ্রস্ত কিছু মানুষ অজানা শঙ্কায় কাঁপছিল। প্রলয়ের ভস্মস্তূপে অতিমানবিক ব্যাটিং করেছেন মুশফিক-লিটন জুটি। ওদের ষষ্ঠ উইকেট পার্টনারশিপ ২৫ রানের কমে ৫ উইকেট হারানো কোনো দলের জন্য নতুন রেকর্ড। আগের রেকর্ডটিও ১৯৫৯ সালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ওয়ালিস মাথায়াস আর সুজাউদ্দিন করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিপক্ষে ম্যাটিং উইকেটে। বাংলাদেশের ৩৬৫ রানের ৩১৬ রান এসেছে লিটন মুশফিকের ব্যাট থেকে। বাকি ৯ জন এবং অতিরিক্ত থেকে ৪৯।
একই উইকেটে শ্রীলঙ্কা গোটা দল (ম্যাথিউস ১৪৫, চান্দিমাল ১২৪, করুণারত্নে ৮০, ধনঞ্জয় ডি সিলভা ৫৮, অসাদা ফার্নান্দো ৫৭) টেস্টসুলভ চমৎকার ব্যাটিং করে জয়ের ভিত গড়লো। বাংলাদেশের বোলিং সীমিত হয়ে পড়েছিল তিনজনে। আরও খোলাসা করে বললে সাকিব-এবাদত দুইজনে। সাকিবের আরেকবার ৫ উইকেট শিকার (কয়েকটি ছিল স্মরণে রাখার মতো), ইবাদতের দখলে ৪ টি।
১৪১ রানে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে আবারও মড়ক লাগলো। ২৩ রান উঠতেই নাই ৪ উইকেট। তামিম টেস্ট ক্যারিয়ার প্রথমবারের মতো উভয় ইনিংসে জোড়া শূন্য। মুমিনুল, শান্ত ও জয় ১৫ ফের ব্যর্থ। পুরো দল গভীর গিরি খাতের কিনারে। ডুবন্ত মানুষ খড়কুটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। তেমনি কেউ কেউ ভরসা করছিল মুশফিক-লিটন আবারও রক্ষা করবেন। বার বার সেটা কি হয়? মুশফিক শেষ দিন সকালে আউট হলেও লড়াই করেছিলেন সাকিব-লিটন। ফলে ইনিংস হার এড়ানো গেলেও ম্যাচ বাঁচাতে পারেনি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ক্রমাগত টেস্ট পরাজয়ে এটি প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশের সামগ্রিক ক্রিকেট বর্তমান টেস্ট খেলার জন্য আজও প্রস্তুত হয়নি। যে কথা স্যার গর্ডন গ্রীনিজ সেই ১৯৯৯ সালে বলেছিলেন। ৫ দিনের প্রতিযোগিতামূলক টেস্ট ক্রিকেট খেলার মানসিকতাই নেই, কাকে দায়ী করবে ক্রিকেট অনুরাগীরা?
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্রিকেট বিশ্লেষক।
ঢাকা/আমিনুল