টি-টোয়েন্টি সিরিজে হার: ‘আসকে আমার মন ভালো নেই!’
সিরিজের ফল: জিম্বাবুয়ে ২, বাংলাদেশ ১।
আপনি কি অবাক হয়েছেন, হতাশ হয়েছেন? হতে পারেন! তবে একজন কিন্তু মোটেও অবাক হননি; খালেদ মাহমুদ সুজন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের টিম ডিরেক্টর। তিনি তো সফর শুরুর আগেই বলে গিয়েছিলেন, টি-টোয়েন্টি সিরিজ ৩-০ তে হারলেও তিনি হতাশ হবেন না।
তার তো বরং একটু খুশিই হওয়ার কথা। সিরিজে একটা ম্যাচ তো অন্তত বাংলাদেশ জিতেছে!
দল যখন সিরিজে খেলতে যাওয়ার আগে এমন ‘হারের আশা’ (!) শুনিয়ে যায়, তখন প্রশ্নটা উঠতেই পারে- দলটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছে নাকি টাইম পাস করতে বেরিয়েছে!
জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে এমন অনেক প্রশ্ন এবং পরিকল্পনাহীনতা ও সিদ্ধান্তের দৈন্যতাই প্রমাণ চিহ্ন রেখে গেল।
একটা সিরিজ যখন আপনি খেলতে যাবেন তখন সেই সিরিজের জন্য একটি প্লেয়ার পুল থাকে। প্ল্যান ‘এ’, ‘বি’ থাকে। এই সিরিজে সেইসবের কোনোকিছুই ছিল কি? একটি ব্যাকআপ প্ল্যান যেকোনও বড় কাজের আগে করে রাখতে হয়। এই সিরিজে অধিনায়কত্ব নিয়ে যে নাটুকেপনা দেখা গেলো তাতেই এটা পরিষ্কার, অমন কোনও ব্যাকআপ প্ল্যান করাই হয়নি।
যা ছিল তার নাম প্ল্যান জেড; জিরো!
আপনি একটা সিরিজে খেলতে যাচ্ছেন হঠাৎ করে নতুন একজনকে অধিনায়ক করে। কিন্তু সেই অধিনায়ক ইনজুরিতে পড়লে অথবা কোন কারণে ম্যাচে খেলতে না পারলে তার জায়গায় কে অধিনায়কত্ব করবেন- সেই পরিকল্পনা কেন আগেভাগে করবেন না। ম্যাচের আগের দিন কেন দলে অধিনায়ক হাতড়ে খুঁজতে হবে?
সামনের সময়ের চিন্তা করে টি-টোয়েন্টির অধিনায়ক হিসেবে সোহানকে শুধুমাত্র এই সিরিজের জন্য অধিনায়ক করে দেওয়া হলো। বলছেন আপনি, চিন্তাটা সামনের সময়ের জন্য। কিন্তু অধিনায়ক ঠিক করছেন শুধুমাত্র তিন ম্যাচের জন্য! তাও আবার যাকে অধিনায়কত্ব দিলেন তিনি বিসিবি’র সঙ্গে কোন ফরম্যাটের চুক্তিতেই নেই। চুক্তির বাইরে থাকা একজনকে হঠাৎ আপনি অধিনায়ক বানিয়ে দিলেন। চুক্তির বাইরে থাকার অর্থ হলো, তিনি এতদিন আপনার কোনও পরিকল্পনায়-ই ছিলেন না।
সোহানকে অধিনায়কত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি নিয়েছেন। এখানে তার যেমন কোনও কৃতিত্ব নেই। ঠিক তেমনি কোনও দোষও নেই। লিটন দাস টেস্ট দলের সহ-অধিনায়ক। এই সিরিজ শুরুর আগে টি-টোয়েন্টির অধিনায়ক হিসেবে তার কথা কি বিসিবি চিন্তায় নিয়েছিল? সম্ভবত নিয়েছিল। কিন্তু বিসিবির হঠাৎ মনে হলো, অধিনায়কত্ব করলে লিটন দাসের ব্যাটিংয়ে মনোযোগের খামতি হবে!
যেন ভাবখানা এমন যে, দুনিয়ার আর কোনও ব্যাটসম্যান অধিনায়কত্ব করছেন না! বাবর আজম, বেন স্টোকস, রোহিত শর্মারা তো এই দুনিয়ার বাইরের কেউ নন। লিটন দাসের মধ্যে নেতৃত্বের ছায়া দেখতে পেয়েছে বলেই তো বিসিবি তাকে টেস্টে সহ-অধিনায়ক করেছে। তো যিনি টেস্টে এই দায়িত্বে থাকতে পারেন, সেই তিনি কেন টি-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব সামাল দিতে পারবেন না?
একটা গ্রুপ অব লিডারশিপ কোয়ালিটির ক্রিকেটার দলে থাকতে সিরিজের শেষ ম্যাচে কেন অধিনায়ক খুঁজতে চোঙ্গা হাতে নামতে হবে?
মোসাদ্দেক আগের দিন পাঁচ উইকেট পেয়েছেন বলেই হঠাৎ মনে হলো, আরে এই তো পারফর্মার পেয়ে গেছি! এই তো বেশ ক্যাপ্টেন পেয়ে গেলাম! কিন্তু এই মোসাদ্দেকই যে হাত ধরে আগের ম্যাচটা হারিয়ে দিয়ে এলেন সেই অঙ্ক কি কষেছিল টিম ম্যানেজমেন্ট? গুরুত্বপূর্ণ সময় ফ্রি-হিট মিস। ১০ বলে মোটে ১৩ রান। যার টি-টোয়েন্টির ব্যাটিং উপযুক্ততা নিয়ে প্রশ্ন স্পষ্টত দৃশ্যমান। এই ফরমেটে ব্যাট হাতে যিনি নিজেই দ্বিধাগ্রস্ত। তাকেই বলা নেই কওয়া নেই শেষ ম্যাচে অধিনায়ক বানিয়ে দেওয়া হল?
প্রশ্ন হলো শেষ ম্যাচে কি অধিনায়কত্ব করার জন্য টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে আর কোনও অপশন ছিল না?
উত্তর হলো ছিল, লিটন দাস ছিলেন।
বলা হচ্ছে, লিটন দাসের কাছে নাকি অধিনায়কত্বের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক ম্যাচের জন্য তিনি অধিনায়কত্ব নিতে চাননি। এটা তো হতেই পারে না। দলীয় খেলায় আপনার নিজের পছন্দকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। দলের চিন্তাটা আগে করতেই হবে। দল যখন অভূতপূর্ব সঙ্কটে তখন লিটন দাস সেই সমস্যার সমাধান না করে নিজের কোনও চয়েজ দিতে পারেন না। তাকে বলা উচিত ছিল, এটা দলের সিদ্ধান্ত। চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার দলের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য। তিনি এখানে কোনও অতিথি বা অপরিহার্য কিছু নন। দলের একজন সদস্য মাত্র। আর যদি নিজের পছন্দের ব্যাপারে লিটন দাস অনড় থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে ক্রিকেটারদের ওপর দলের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।
এটি একটি আউট ল’ দল!
সিরিজ শুরুর আগে বিসিবি বললো, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে। অথচ সেই বিশ্রাম ভেঙে তাকে শেষ ম্যাচে ফিরিয়েও আনা হলো। বিশ্রাম দেওয়ার সময় বিসিবি কখনোই বলেনি যে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে বাদ বা তাকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কখনোই বলেনি, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অধিনায়কত্ব অধ্যায় সমাপ্ত। তাহলে সেই মাহমুদউল্লাহকে আপনি যখন দুই ম্যাচ পরেই সিরিজের মাঝপথে আবার দলে ফেরালেন, তাহলে কেন তাকে অধিনায়ক হিসেবে আনা হলো না? অথচ দল তখন অধিনায়কত্ব সঙ্কটেও বটে!
শুধু বিশ্রাম কেন, অবসর ভেঙেও একজন ক্রিকেটার দলে ফিরে আসেন। কিন্তু বিশ্রাম থেকে যখন একজন নিয়মিত অধিনায়ক ক্রিকেট মাঠে ফিরেন তখন এটাই স্বাভাবিক যে অধিনায়কত্বও তারই থাকছে, যদি না তাকে আপনি আগে সরিয়ে দিয়ে থাকেন। সিরিজের শেষ ম্যাচে মোসাদ্দেককে অধিনায়ক করা এবং মাহমুদউল্লাহকে সাধারণ সদস্য হিসেবে দলে ফিরিয়ে আনা একটি বিষয়-ই প্রমাণ করে যে, টিম ম্যানেজমেন্ট চেয়েছে কোনমতে এই ম্যাচটা পার করে দেওয়া যায় কিনা?
একটা দল যখন এমন চিন্তা নিয়ে কোনমতে উতরে যেতে চায় তাতে প্রমাণ মেলে যে এখানে চিন্তার এবং পরিকল্পনার দৈন্যতা রয়েছে। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের একটা বিখ্যাত মন্তব্য দিয়ে লেখাটা শেষ করি- ‘আপনি যদি পরিকল্পনা করতে ব্যর্থ হন তবে আপনি ব্যর্থ হওয়ার জন্যই পরিকল্পনা করেন।’
এই প্রশ্নটাই রইল খালেদ মাহমুদের কাছে। উত্তরও সম্ভবত ওটাই- ‘আসকে আমার মন ভালো নেই!’
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, রাইজিংবিডি ও ক্রিকেট বিশ্লেষক।
ঢাকা/এনএইচ