ঢাকা     শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৯ ১৪৩১

নশ্বর পৃথিবীতে অবিনশ্বর পেলে

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৭, ৩০ ডিসেম্বর ২০২২   আপডেট: ১৬:৩৯, ৩০ ডিসেম্বর ২০২২
নশ্বর পৃথিবীতে অবিনশ্বর পেলে

ডেভিড গোল্ডব্লাটের কথাটা কি মনে আছে? ‘দ্য বল ইজ রাউন্ড: এ গ্লোবাল হিস্ট্রি অব ফুটবল অ্যান্ড দ্য গেম অব আওয়ার লাইভস’-এর লেখক ডেভিড গোল্ডব্লাট। তিনি লিখেছিলেন, ‘পেলে এমন একজন যার দ্বারা ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করা হয়।’ 

মানে দাঁড়াচ্ছে পেলে নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন যেখানে তিনি অতুলনীয়, অনুপম, অদ্বিতীয়। পরে যারা এসেছেন, সামনেও আসবেন তারা কেবলই সমতুল‌্য! তিনি কেবল ব্রাজিলের একজন দেবতা ছিলেন না, প্রথম সত্যিকারের বিশ্ব ফুটবল তারকা ছিলেন। এই অসাধারণ খেলার ওপর যারা দেবত্ব আরোপ করেছেন তাদের রূপকারও তিনি। এ নিয়ে ইয়োহান ক্রুয়েফের কথাটা নিশ্চয়ই কানে বাজছে, ‘পেলে একমাত্র খেলোয়াড় যে যুক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেছে।’ 

রোমাঞ্চকর চর্মগোলক নিয়ে দুপায়ের নিরুপম ছোঁয়ায় বিশ্বকে বুঁদ করে রাখার যে ঐশ্বরিক কর্তৃত্ব, মাঠের এপার-ওপার অপার্থিব সৃষ্টিশীলতা, প্রতিপক্ষের দুর্গ ভেঙে গোলমুখে তার ক্ষিপ্র দৌড় পৃথিবীতে আঁকা সুন্দরতম ছবিগুলোর প্রতিচ্ছবি। যে ছবি আবেগে ভাসায়, ভালোবাসার জন্ম দেয়। মুগ্ধ করে প্রতিটি ক্ষণ, মুহূর্ত। শিল্পীর তুলির আঁচড়ে ক‌্যানভাসে আঁকা সেই চরিত্রটিই শেষ যাত্রায় পা বাড়ালেন। পৃথিবীর মায়া ত‌্যাগ করলেন। যেখানে তার অপেক্ষায় গারিঞ্চা, সক্রেটিস। কিংবা প্রতিদ্বন্দী দেশের দিয়েগো ম‌্যারাডোনা।

আরো পড়ুন:

বলা হয়ে থাকে, পেলের পর তার খুব নিকটে যেতে পেরেছিলেন কেবল আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ম‌্যারাডোনা। এখন সেই জায়গায় নিশ্চিতভাবে এই শতাব্দির লিওনেল মেসিও ঢুকে গেছেন। তাদের তিনজনকে এক আসনে বসালেও কোনও আপত্তি থাকবে না! যদিও নানা মুনির নানা মত তো থাকবেই! ম‌্যারাডোনা পরপারে পা বাড়িয়েছেন ২০২০ সালে। পেলে এ বছর। 

জীবদ্দশায় ম‌্যারাডোনোর চিরকালীন আক্ষেপ ছিল, পেলের থেকে একটি পাস না পাওয়ার! মানে একই জার্সিতে না খেলার। এক টিভি শোতে সেই আক্ষেপের কথা জানিয়ে ম‌্যারাডোনা পেলের হাতে বল তুলে দিয়েছিলেন। ভাগ‌্যবান সেই বল নিয়ে দুজনের হেডে হেডে ঠোকাঠুকির চিত্র হার মানায় মোনালিসার চিত্রকর্মকেও! দুজনের মুষ্টিবদ্ধ চার হাত এক হয়ে একে অপরের আলিঙ্গনের দৃশ‌্যটি আবার জানান দেয়, ‘ফুটবল শুধুমাত্র কোনও খেলা নয়, এটা জীবন’, যা বলেছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। 

৮২-তে থেমেছেন পেলে। ক‌্যানসার আর শরীরে নানাবিধ রোগ বাসা বাঁধায় শেষ লড়াইটায় আর জিততে পারেননি। ম‌্যারাডোনার মৃত্যুর পর পেলে বলেছিলেন, `আশা করি স্বর্গে একদিন আমরা একসঙ্গে ফুটবল খেলতে পারবো।’ দুজনের পথ মিলে গেল দুই বছর একমাস তিন দিন পর। এবার নিশ্চয়ই পেলের পাসটা পাবেন ম‌্যারাডোনা। ড্রিবলিং করে বাঁপায়ে গোলটাও দেবেন ষাটে পৃথিবী ছাড়া ম‌্যারাডোনা। তাদের আনন্দাশ্রুতে পৃথিবী ভিজে গেলে নিশ্চয়ই ফুটবল জিতে যাবে।   

ঊনবিংশ শতাব্দীর ফুটবল মানেই পেলে আর ম‌্যারাডোনা। তাদের আগে-পারে অনেকেই বিশ্বকে তাক লাগিয়েছেন, ভক্তদের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। কিন্তু লাতিন আমেরিকার এই দুই মহা নায়ক নিজেদের আলাদা করেছেন অনন‌্য গুনে, মহিমায়, শ্রেষ্ঠত্বে, বৈভব আর আভিজাত‌্যে। গোলাকার সেই বল ছিল তাদের পোষ মানা সৈনিক। যা চাইতেন, যেভাবে চাইতেন সেভাবেই যেন কথা শুনতো। প্রতিপক্ষকে দুমড়েমুচড়ে দিতো। তাতে ইতিহাসের অক্ষয় কালিয়ে বারবার লেখা হয়ে যেত পেলে-ম‌্যারাডোনার নাম। 
 
তাদের জন্ম ভিন্ন সময়ে। ভিন্ন ক্লাব এবং দেশের জার্সিতে খেলেছেন। দুজন ছিলেন পারফেক্ট নাম্বার টেন। দুজন জাতীয় দলের হয়ে প্রায় সমান (পেলে ৯০, ম্যারাডোনা ৯১) ম্যাচ খেলেছেন। দুজনেই ক্যারিয়ার জুড়ে একই সংখ্যক শিরোপা জেতেন। পেলে কেবল এগিয়ে বিশ্বকাপের মুকুট জয়ে। একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ (১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০) জিতেছিলেন ব্রাজিলের কালো মানিক। 

‘তর্কসাপেক্ষে’ সর্বকালের সেরা, পেলেকে নিয়েও কথাটা বলা হয়। ম‌্যারাডোনাও তা স্বীকার করেছেন একাধিকবার। একবার যেমন বলেছিলেন, ‘ম্যারাডোনা হচ্ছে ম্যারাডোনা, আর পেলে ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি একজন সাধারণ খেলোয়াড়... আমি পেলেকে অনুকরণ করার চেষ্টা করি না। সবাই জানে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ।’

দুজনের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক পাওয়া যায় পেলের কণ্ঠেও, ‘আশা করছি, স্বর্গে আমরা একসঙ্গে ফুটবল খেলবো। গোল না করেও আমি মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে উদযাপন করবো। কারণ তোমাকে যে আলিঙ্গন করবো।’

হাজারেরও বেশি গোল, শোকেস ভর্তি শিরোপা, দিস্তার পর দিস্তায় তার স্তুতি; সব আজ থমকে গেলো ব্রাজিলে। তবে পেলে রেখে গেছেন তার অর্জন, দিয়ে গেছেন জীবন দর্শন। মানুষের হৃদয়ে চিরকালীন যেন থাকতে পারেন সেজন‌্য ১৯৯৯ সালে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সব বাচ্চারা যারা ফুটবলার হতে চায়, তারা পেলের মতো হতে চায়। তাদেরকে কেবল ফুটবলার হওয়াই নয়, বরং কীভাবে একজন মানুষ হতে হয় সেটা দেখানোও আমার ওপর বেশ বড় দায়িত্ব।’ আর ১৯৭৭ সালে ফুটবল ও জীবনকে মিলিয়েছিলেন এভাবে, ‘পৃথিবীর উপরে হওয়া সবকিছুই একটি খেলা। পাসের মতো ব্যাপার। আমরা সবাই একসময় মারা যাবো। সবার অবস্থাই একইরকম হবে, তাই না?’

মৃত্যু অমোঘ জেনেও নায়কেরা এমন কীর্তি রেখে যান যা চিরকাল অমর হয়ে থাকে। মহাকাল অবধি পৃথিবীও তাদের মনে রাখে। নশ্বর পৃথিবীতে অবিনশ্বর তাদের কীর্তি, শ্রেষ্ঠত্ব। ষোল আউন্সের বলে নিজেকে চিনিয়ে যাওয়া পেলে তাদেরই একজন। 

ঢাকা/ফাহিম

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়