‘পেস ব্রিগেড’র সোনালী সময়
ইয়াসিন হাসান, চট্টগ্রাম থেকে || রাইজিংবিডি.কম
‘পেস লাইক ফায়ার’— এ কথা বললেই নিশ্চিতভাবে মনে পড়বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস আক্রমণের কথা। অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিংয়ের সঙ্গে ম্যালকম মার্শাল এসে ক্যারিবিয়ান পেস আক্রমণকে করে তুলেছিলেন আগুন। সেই আগুন নেভানোর কাজ করতে গিয়ে ব্যাটসম্যানের কতশত পরীক্ষা দিতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
এরপর নানা সময়ে নানান দলে অনেক আক্রমণে এসে পেসাররা মুগ্ধ করেছেন। পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, আকিভ জাভেদের সঙ্গে শোয়েব আক্তার ছিলেন দুর্ধর্ষ। বর্তমান সময়ে নিউ জিল্যান্ডের নেইল ওয়াগনার, টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্ট, কাইল জেমিসনরা গতিময়, বৈচিত্র্যময় বোলিংয়ের ধারা ধরে রেখেছেন। ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রড, জেমস অ্যান্ডারসন, মার্ক উডের সঙ্গে রয়েছেন জোফরা আর্চার।
গতির এই লড়াইয়ে বর্তমান সময়ে যদি নতুন কোনও নাম তুলতে হয় তাহলে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে চলা তাসকিন আহমেদ, ইবাদত হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান ও হাসান মাহমুদদের নাম আসবে। বড্ড বাড়াবাড়ি, অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে— কিন্তু বাংলাদেশের এ পেস চতুষ্টয়ও এখন গতির লড়াইয়ে সোনালী দিন কাটাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যেকোনও বড় দলের বিপক্ষে লড়াইয়ের সামর্থ্য রাখে এই ‘পেস ব্রিগেড’।
যে আক্রমণে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নিজেকে ভেঙে গড়ে তোলা তাসকিন আহমেদ। মোস্তাফিজ পিছিয়ে পড়ে আবার ফিরে এসেছেন। সঙ্গে ইবাদত লাল বলের পর নিজের কারিশমা দেখিয়েছেন সাদা বলে। তাদের সঙ্গে তারুণ্যের প্রতীক হয়ে আসা হাসান মাহমুদ চেরি অন দ্য টপ।
শুধু বোলিংয়ে তারা মুগ্ধ করছেন না। নিজেদের পরিপক্বতা, কথার সৌন্দর্য, ভাবনার গভীরতা, প্রতিপক্ষকে মূল্যায়ন, নিজেদের যত্ন, কাজের পরিধি নির্ণয়, আগ্রাসী মনোভাব, হারার আগে না হারার মানসিকতায় তারা অনন্য হয়ে উঠেছেন। দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ে তেমন জোর ছিল না। কিন্তু তাসকিন, হাসান মাহমুদদের এই বিগ্রেড বাংলাদেশকে সাফল্যে ভাসাচ্ছেন। সঙ্গে প্রতিপক্ষের সমীহ আদায় নিতে পেরেছেন।
পেসারদের আইডল হয়ে উঠা তাসকিন আহমেদ এমন কিছুর অপেক্ষাতেই ছিলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন আমরা বিশ্বের শীর্ষ দল হব, সেই প্রক্রিয়া অনুযায়ী আমরা ক্রিকেট খেলছি এবং এগোচ্ছি। আস্তে আস্তে মাঠেও দৃশ্যমান হচ্ছে। যদি এইভাবে ধারাবাহিকতা থাকে, সামনে অনেক বড় বড় ইভেন্ট আছে, ওসবেও প্রতিফলন পড়বে ইন শা আল্লাহ।’
নিজেদের পরিবর্তন নিয়েও তাসকিন খোলাখুলি কথা বলেছেন, ‘পরিপক্বতা মিসিং ছিল বলেই ওখান থেকে শিখে ভালো কিছু দেখাতে পারছি। সামনে আরও ভালো কিছু দেখাব। ক্রমে আমরা প্রক্রিয়া অনুযায়ী উন্নতি করছি, এটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ভুলগুলো বার বার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কি না, এটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ভুলগুলো কিন্তু কমে আসছে যেকোনও ফরম্যাটে। তার মানে আমরা ভুল থেকে শিখছি, প্রক্রিয়াটা দারুণ যাচ্ছে এবং আমরাও শিখতে আগ্রহী।’
নিজেদের স্বপ্নের সীমানা পেরিয়ে যেতে চান এ পেসার, ‘সবাই সবার দিক থেকে চেষ্টা করছে। ইউনিট হিসেবে যদি সবাই বিশ্বমানের বোলার থাকি, এই ইউনিটকে সামলাতে কিন্তু অন্যদের সমস্যাই হবে। বড় বড় দলে কিন্তু একটা নয়, চার-পাঁচটা বিশ্বমানের ফাস্ট বোলার থাকে। আমরাও চাচ্ছি, আমাদেরও এরকম হোক। যেহেতু আমরা সবাই পরিবারের অংশ, ফাস্ট বোলাররা ভাইয়ের মতো। সবাই সবার ভালো চাই এবং সবশেষ দুই-আড়াই বছরে উন্নতিও চোখে পড়ছে।’
‘এখনও আমাদের পরের ধাপে যাওয়া বাকি। আমি মনে করি আমরা সঠিক পথে আছি। মানসিকতা ভালো। যদি এই প্রক্রিয়ায় থাকি, আমাদের এই স্বপ্নও পূরণ হবে যে; আমরা সবাই বিশ্বমানের হব।’
‘‘(হাসান মাহমুদ) আরও ভালো করুক, ১০ উইকেট করে নিক আমি চাই। আমি তো আগেই বললাম, আমরা ৫ জনই ভাই। সবাই যত ভালো করবে, প্রতিপক্ষরা তত চাপ অনুভব করবে। আপনি যেটা বললেন, ওরা আমার প্রতিদ্বন্দ্বী কি না… ‘না’, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আমি নিজে। আমি চাইব সবাই মিলে ভালো করতে। তাহলে বিশ্ব ক্রিকেটে একটা বার্তা যাবে যে বাংলাদেশের ফাস্ট বোলাররা উঠে আসছে। ও (হাসান) ১০ উইকেট নিলেও আমার কোনও ক্ষতি নেই, উন্নতি নেই। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আমি, আমার সেরা রেকর্ডটা ভেঙে বার বার ভালো করতে চাই। সবাই ভালো করতে চাই, দোয়া করুন।’’— এক নাগাড়ে বলছিলেন তাসকিন।
নির্ভরতার প্রতীক হয়ে বড় মঞ্চে নিজেদের কারিশমা দেখিয়ে যাচ্ছেন এই পেস বিগ্রেডরা। সাফল্যের হাসির পর আবার ব্যর্থতা ঝেঁকে বসবে। সেজন্যও তারা প্রস্তুত আছেন। তবে এই চক্র থেকে কীভাবে উন্নতি করা যায়, সেই পথ চেনা হয়ে গেছে তাদের। এজন্য সামনের কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতেও ভয় নেই তাদের।
চট্টগ্রাম/এনএইচ