বিশ্বকাপে নেই তামিম
ফিটনেসের দোহাই নাকি আড়ালে অন্য ‘খেলা’
ক্রীড়া প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম
বিশ্বকাপ দলে যারা আছেন তাদের হাতে জার্সি তুলে দিয়ে স্কোয়াড ঘোষণায় ভিন্নতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। নিশ্চিতভাবেই অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের হাতে প্রথম জার্সি উঠেছে। হাসি মুখে সাকিব সেই জার্সি গ্রহণ করে বলেছেন, ‘আমি সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশকে বিশ্বকাপে পঞ্চমবারের মতো প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছি।’
২০০৭ সালে সাকিব বিশ্বকাপের ট্রেনে উঠেছিলেন। ‘পু ঝিক ঝিক’ আওয়াজে সেই ট্রেন ছুটে চলে ২০১১, ২০১৫, ২০১৯ স্টেশন পেরিয়ে ২০২৩-এর ঠিকানায় এসে পৌঁছেছে। একই ট্রেন ধরেছিলেন তামিম ইকবাল। সাকিবের মতো আগের তিন গন্তব্য অতিক্রম করেছেন একই ছন্দে। কিন্তু ২০২৩ এ এসে লাইনচু্যত হয়ে গেলেন! সমান্তরাল লাইনে মুশফিকুর রহিম আছেন সাকিবের সঙ্গী হয়ে।
পঞ্চম বিশ্বকাপ খেলার অপেক্ষায় থাকা তামিম নেই ভারত বিশ্বকাপে। যার নেতৃত্বে আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগে দুর্দান্ত খেলে সরাসরি বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেছিল বাংলাদেশ, সেই তিনিই নেই ১৫ জনের স্কোয়াডে। অথচ গত মাস তিনেক আগেও তাকে নিয়েই যত স্বপ্ন দেখা হয়েছিল। কিন্তু চোট, ফিটনেস এবং তার অবসর কাণ্ডে সব ওলটপালট।
তামিম লাম্বার ফোর ও লাম্বার ফাইভের সংযুক্ত ডিস্কে দুটি ইনজেকশন নিয়েছিলেন গত আগস্টে। এরপর ফিরে এসে বিশ্বকাপে খেলার লড়াই চালাচ্ছিলেন বাঁহাতি ওপেনার। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৯০ মিনিট ক্রিজে থেকে ৪৪ রান করেছিলেন। ব্যাটিংয়ে আত্মবিশ্বাস পেলেও ফিটনেসে অস্বস্তি ছিল তার। তাতেইসব ওলটপালট। ফিটনেসের কারণেই তামিম বাদ পড়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু।
মঙ্গলবার নির্বাচক প্যানেলের সংবাদ সম্মেলন হয়েছে মিনিট পনেরর মতো। পুরো সংবাদ সম্মেলন জুড়েই ছিলেন তামিম। দেশসেরা ওপেনারকে নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠেও যেতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। তবে তামিমকে নিয়ে খুব বেশি কথা বলেননি। সব কথায় ঘুরে ফিরে এসেছে তার ফিটনেস।
বিশ্বকাপের সফর বেশ লম্বা। বাংলাদেশ নয় ম্যাচ খেলবে ছয় ভেনু্যতে। লম্বা সময়ের এই বিশ্বকাপে মনযোগ ধরে রাখা, ফিটনেস ঠিক রাখা কঠিন কাজ। বর্তমানে তামিমের যে ফিটনেস তাতে তার টিকে থাকা কঠিন হয়ে যেত। গুঞ্জন ছড়িয়েছিল, তামিম নিজেও পাঁচ ম্যাচের বেশি খেলতে রাজি ছিলেন না। সাকিব এমন কথা শোনার পর আনফিট তামিমকে বিশ্বকাপে নিতে চাননি!
এমন কথা উড়িয়ে দিয়েছেন প্রধান নির্বাচকও, ‘আমরা এ ধরণের জিনিস জানি না। মিডিয়ায় অনেক কিছু দেখেছি কিন্তু এ ধরণের কোনো তথ্য আমাদের কাছে ছিল না।’ তবে তামিমকে দলে না রাখার প্রক্রিয়াতে সাকিব যুক্ত ছিলেন তা নিশ্চিত করেছেন তিনি, ‘তামিমের বিষয়ে মেডিকেল টিমের সঙ্গে আমাদের যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে, টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যেখানে টিম ম্যানেজমেন্টের মধ্যে অধিনায় আছে, হেড কোচ আছে, সবার সঙ্গে আলোচনা করা হয়। তারপর স্কোয়াড প্রস্তুত করা হয়।’
তামিমকে নিয়ে সামগ্রিক বাস্তবতাও তুলে ধরলেন প্রধান নির্বাচক, ‘তামিম ৫টা ম্যাচ খেলবে বা অন্য কিছু কোনো তথ্য ছিল না। কিছু কিছু ইনজুরি আছে যেগুলো নিয়ে আপনি ঝুঁকি নিতে পারেন না। একটা খেলোয়াড়কে দলে নিয়েছি সে যেয়েই ইনজুরিতে পড়ে গেছে তখন কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট বেকায়দায় পড়ে যায়। এটাও কিন্তু একটা রিক্স। তো এসব চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নিউ জিল্যান্ড সিরিজে প্রথম ও দ্বিতীয় ম্যাচ খেলেছে এরপর কিন্তু তৃতীয় ম্যাচে ওকে বিশ্রাম দিতে হয়েছে। দ্বিতীয় ম্যাচে পুরোপুরি ফিল্ডি-ব্যাটিং করেছিল তারপর ওর কিন্ত একটু পেইন আসছিল।’
কিন্তু ফিটনেসের আড়ালে আরো কিছু ঘটনাও আছে যেগুলো তামিমকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করেছিল বলে জানা গেছে। বিশ্বকাপে সব ম্যাচ তামিমকে খেলানো হবে না এমন সিদ্ধান্ত তাকে জানিয়েছিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান। যা একদমই ভালোভাবে নেননি তামিম। তার কথা, দলের পরিকল্পনা জানাবেন হয় কোচ, নয়তো অধিনায়ক। সেসব নিয়ে কারণও ব্যাখ্যা করবেন। সেখানে বিসিবি সভাপতিকে দিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত জানানো তার কাছে স্রেফ অপেশাদারিত্ব।
সঙ্গে বিসিবি সভাপতি জুড়ে দিয়েছিলেন ৭ অক্টোবর ধর্মশালায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে না খেলার শর্ত। প্রথমে না খেলানোর কথা বলার পর তামিম কড়া প্রতিক্রিয়া দেখালে পরে মিডল অর্ডারে খেলানোর প্রস্তাব আসে। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগেই এতো শর্ত, এতো দেনদরবার মানতে পারেননি তামিম। সোজাসাপ্টা সভাপতি জানিয়ে দেন তাকে বিশ্বকাপ দলে না রাখতে।
বিশ্বকাপ দলে তামিমকে রাখা না রাখার এমন দোলাচালের আড়ালে অন্য ‘খেলা’-ও চলেছে। অবসর কাণ্ডে নাজমুল হাসান পাপনকে বেকায়দায় ফেলা, মাশরাফির মধ্যস্ততায় যার সমাধান হয়েছিল। যা বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসানের জন্য বিব্রতকর ছিল। এছাড়া কোচ হাথুরুসিংহের এক নীতি এবং সাকিব ও তামিমের ‘ইগোর’ লড়াই। যা তামিমের বিশ্বকাপের অন্তর্ভুক্ততে প্রভাব রেখেছে।
শুধু তামিম-ই নয়, অগ্রজ নাফিস ইকবালের ওপরও সেই ঝড় এসেছে। টিম অপারেশন্স ম্যানেজার হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাওয়া নাফিসকে বিশ্বকাপে চাননি সাকিব। বহর থেকে তার নাম কেটে ফেলায় নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডে চলাকালীন ড্রেসিংরুম ত্যাগ করে বাসায় ফিরে যান জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটারও। এসব নিয়ে এখন কথা বলার মানুষও কম।
ঢাকা/ইয়াসিন