ভারতের শক্তি দেখলো বাংলাদেশ
ইয়াসিন হাসান, পুনে থেকে || রাইজিংবিডি.কম
রোজ যা করতেন আজও তাই করলেন। ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে ব্যাট হাতে ছুটলেন ২২ গজে। উইকেট দেখে পরবর্তীতে পেছনে দাঁড়িয়ে শ্যাডো প্র্যাকটিস। কয়েকটি কাট। কয়েকটি পুল। কয়েকটি ড্রাইভ। পুনের মহারাষ্ট্র ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সাকিব আল হাসানের ওই প্রস্তুতি দেখে কেউ কি ধারণা করছিল একটু পর আর তিনি টস করতে নামবেন না?
স্টার স্পোর্টস, টি স্পোর্টস বা যারাই বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছিলেন প্রত্যেকে বলেছেন, ‘সাকিব রেডি টু গো।’
কিন্তু দুপুর দেড়টায় টসের একটু আগে সহ-অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত যখন সাদা কাগজ (পড়ুন টিম শিট) নিয়ে মাঠে পা রাখেন প্রত্যেকের চোখ ছানাবড়া! ঊরুর চোটে ভোগা সাকিব তাহলে খেলছেন না ভারতের বিপক্ষে। দ্বিতীয় স্ক্যানের রিপোর্ট দেখে টিম ম্যানেজমন্টে তাকে সরিয়ে নিলো কিনা তা জানার জন্য একাধিক দায়িত্বশীলের সঙ্গে চেষ্টা করেও জানা যায়নি। অথচ ভারতের হার্দিক পান্ডিয়া তিন বল করার পর পায়ে টান লেগে যখন মাঠ ছেড়ে উঠে যান তখন ভারতীয় দল সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেয়, ‘হার্দিক স্ক্যান করাতে গেছে। আজ তাকে ফিল্ডিংয়ে পাওয়া যাবে না।’
সাকিবের অনুপস্থিতিতে ম্যাচের এফিটাপ লিখা হয়ে যায়। ভারতের শক্তি দেখলো বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে নিজেদের তৃতীয় পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ পেল ৭ উইকেটে। চার ম্যাচে চারটি জিতে ভারত এখন রীতিমত উড়ছে। অথচ এই ম্যাচের ভাগ্য লিখার সুযোগও পেয়েছিল বাংলাদেশ। শান্ত টস জিতে ব্যাটিং নিলে বাংলাদেশ বিনা উইকেটে ৯৩ রান করে। লিটন ও তানজিদের আগ্রাসী ব্যাটিং পুনের উইকেটের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তিন’শ নকিং অ্যাট দ্য ডোর।
কিন্তু এরপর যা হলো তাতে মান রক্ষা হয়নি একটুও। বাংলাদেশ ৮ উইকেট হারিয়ে কেবল ২৫৬ রান করে। জবাবে ভারত ব্যাটিংয়ে আরেকটি সুন্দর দিন কাটিয়ে ম্যাচ জিতে নেয় ৫১ বল হাতে রেখে।
সাকিবের এই ম্যাচে অনুপস্থিতি রহস্যময় ছিল নাকি বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে আচমকরা রং পাল্টানো সেটা নিয়ে বিরাট তর্ক-বিতর্ক থাকতে পারে। কেননা যে উদ্বোধনী জুটি ছিল ‘বোনাস’ তারাই আজ উড়ন্ত সূচনা এনে দিয়েছিল। এরপর প্রয়োজন ছিল চোখে-চোখ রেখে লড়াই করা। প্রতি আক্রমণে যেতে না পারুক অন্তত বল টু বল খেলে স্কোর বাড়ানো। কিন্তু মিডল অর্ডার যা করলো তা ভারতীয় সিরিয়ালের পুনর্জন্মের ক্লাইমেক্সকেও হার মানাবে!
১৫ ওভারে ৯৪ রানে এক উইকেট হারানোর পর ৪০ ওভার যেতে রান ৫ উইকেটে ১৮৯! পরের ৯৫ রান হয়েছে ২৫ ওভারে। যেখানে ডট বল ৮৮টি। অথচ উইকেট বদলায়নি, ভারতের বোলিংও আহামরি কিছু ছিল না। হার্দিক পান্ডিয়া তিন বল করার পর চোটে মাঠ ছাড়েন। কিন্তু ডট বল আর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই ডেকে আনে বাংলাদেশ। শান্ত, তাওহীদ ও মিরাজ মিলে ৬৫ বলে করেছেন ২৭ রান। ভালো শুরুর পর ফিফটি পাওয়া লিটনও চাপে পড়ে মন্থর গতিতে এগিয়ে যান। এরপর উড়াধুরা এগিয়ে এসে খেলতে গিয়ে নিজের উইকেট বিলিয়ে আসেন ৬৬ রানে।
বাংলাদেশের ভরসা ছিল মুশফিকুর রহিম আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। দুজন চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বড় কিছু হয়নি। মুশফিক ৩৮ রানে পয়েন্টে জাদেজার উড়ন্ত ক্যাচে পরিণত হন। এই ইনিংস খেলার পথে দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে হাজার রানের মাইলফলক ছাড়িয়ে যান। আর মাহমুদউল্লাহ টানা দুই ম্যাচে লোয়ার অর্ডারে অবদান রেখে ফেরেন ৪৬ রানে। বুমরাহর আনপ্লেয়েবল ডেলিভারিতে বোল্ড হওয়ার আগে ৩৬ বলে ৩টি করে চার ও ছক্কায় সাজান ইনিংসটি।
এর আগে পুনেতে ছিল তানজিদ শো। আক্রমণাত্মক, আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে ভারতের বোলারদের কড়া জবাব দেন। বুমরাহর বাউন্সারে যেভাবে বল গ্যালারিতে পাঠিয়েছেন তাতে মনে হচ্ছিল ২০০৭ সালের তামিম ইকবালকে ফিরিয়ে এনেছেন। এরপর শার্দুলকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে যে কয়েকবার সফল হয়েছে সে কয়েকবারই মনে করিয়েছেন তামিমকে। পার্থক্য কেবল তামিম নিজের প্রথম বিশ্বকাপের ম্যাচেই ভারতের বিপক্ষে নিজের কারিশমা দেখিয়েছিলেন। তানজিদের সময় লাগল চার ম্যাচ। অদ্ভুত হচ্ছে দুজনই থেমেছেন ৫১ রানে! পার্থক্য হচ্ছে সেদিন তামিমের ঝড়ো ফিফটির পর সাকিব ও মুশফিকের দায়িত্বশীল ইনিংসে বাংলাদেশ অঘটন ঘটিয়েছিল। আজ ভারতের শক্তি দেখেই কুপোকাত।
আগের ম্যাচে লিটন গোল্ডেন ডাক পাওয়ায় চাপে ছিলেন। পুনেতে তার থেকে বড় কিছুর অপেক্ষায় ছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। ক্রিজে কঠিন সময় কাটিয়ে ৬৬ রান তুললেও সেখানেই থেমে যায় তার ইনিংস। অস্তমিত হয় বাংলাদেশের ইনিংস বড় হওয়ার সম্ভাবনা। রানপ্রসবা এই উইকেটে এতো কম রান করে জেতেনি কেউ। সর্বনিম্ন ২৮৩ রান করে ৪৩ রানে জয়ের রেকর্ড ওয়েস্ট ইন্ডিজের। যে ম্যাচে কোহলি সেঞ্চুরি করেও দলকে জেতাতে পারেননি। তবে আজ ক্যারিয়ারের ৪৮তম সেঞ্চুরি তুলে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন কিং কোহলি।
তার এই ধ্রুপদী ব্যাটিংয়ের সুর বেঁধে দিয়েছিলেন দুই ওপেনার রোহিত শর্মা ও শুভমান গিল। প্রতি আক্রমণে গিয়ে দুজন ৭৬ বলে ৮৮ রানের জুটি গড়েন। ৭ চার ও ২ ছক্কায় ৪৮ রান করা রোহিতকে ফিরিয়ে এই জুটি ভাঙেন তাসকিনের পরিবর্তে একাদশে আসা হাসান মাহমুদ। ব্যাক টু ব্যাক ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে সীমানায় ক্যাচ দেন হিট ম্যাচ। গিল অবশ্য ভুল করেননি। বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ফিফটি তুলে দেন দ্যুতি ছড়িয়ে। ৫৩ রানে তাকে থামান মিরাজ। তিনে নামা কোহলি উইকেটে গিয়েই পান দুটি ফ্রি হিট। স্ট্রেইট ব্যাটে প্রথমটি চারের পর একই শটে দ্বিতীয়টি ছক্কা উড়ান। এরপর আর তাকে থামানো যায়নি। সুন্দর ব্যাটিংয়ে ছড়ান মুগ্ধতা। তাতে চোখ সরানোর উপক্রম ছিল না। বুঁদ হয়ে থাকতে হয় সুন্দর এক মাস্টারক্লাসের।
তার সেঞ্চুরির জন্য ভারতের জয়ের অপেক্ষা বাড়ছিল। ৪২তম ওভারে নাসুম যখন বল হাতে নেন তখন ভারতের জয়ের জন্য দরকার ছিল ২ রান। সেঞ্চুরি থেকে কোহলি দূরে ছিলেন ৩ রানে। প্রথম বল ওয়াইড হলেও আম্পায়ার ওয়াইড কল করেননি। দ্বিতীয় বল এগিয়ে এসে খেলতে গিয়ে টাইমিং মেলাতে পারেননি কোহলি। তৃতীয় বলেই আসে মাহেন্দ্রক্ষণ। বাঁহাতি স্পিনারকে এগিয়ে এসে ছক্কা উড়ান ডিপ মিড উইকেট দিয়ে। ৯৭ বলে ৬ চার ও ৪ ছক্কায় সাজানো ইনিংসটির জন্য ম্যাচসেরার পুরস্কার উঠেছে তার হাতেই। রাহুলের ব্যাট থেকে আসে অপরাজিত ৩৪ রান।
শুরুর ১৫ ওভার ছাড়া এই ম্যাচে বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের আরেকটি হার। সেমিফাইনাল খেলার লক্ষ্য থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যেতে শুরু করেছে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।
ঢাকা/আমিনুল