শচীনের রাজ্যের ঘাসজুড়ে ‘ম্যাড ম্যাক্স’র অমরত্ব
আরিফুল হক বিজয় || রাইজিংবিডি.কম
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ের ‘নর্থ স্ট্যান্ড’ নামের একটা গ্যালারি আছে। স্টেডিয়ামের সবচেয়ে নয়েজ গ্যালারি। মাঝ দিয়েই বয়ে গেছে ড্রেসিংরুমের পথ। সিঁড়ির দুই পাশে কাটাতারের নিচ্ছিদ্র বেষ্টনী। এই নর্থ স্ট্যান্ডের কথা মাথায় এলেই সর্বপ্রথম ধরা দেন শচীন। ক্যারিয়ারের শেষ দিন, পুরো নর্থ স্ট্যান্ড হুমড়ি খেয়ে পড়লো ‘ক্রিকেট ঈশ্বরকে’ ছুঁয়ে দেখার আশায়। সেই নর্থ স্ট্যান্ড গতকাল উপচে পড়লো এক অস্ট্রেলিয়ানের ওপর। তিনি গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।
ওয়াংখেড়ের এই গ্যালারি খুব সহজেই কাউকে ছুঁয়ে দেখতে চায় না। কেবল কীর্তিমানরাই স্পর্শ পান। তবে কি ম্যাক্সওয়েল তেমন কিছুই করে ফেলছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে একটু থমকে যেতে হয়। যা করছেন সেটার উত্তর সমকালে দেয়া তো সম্ভব নয়-ই। মহাকালে খোদাই করে রেখে দিলেও অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়, অভাবনীয় মনে হবে।
শেষ চার নিশ্চিতের ম্যাচ। ম্যাক্সওয়েল যখন নামলেন, অজিদের চার উইকেট নেই। আফগান কামানের তোপে উড়ে গেছে অজিদের টপ অর্ডার। ড্রেসিংরুমে বসে চিন্তামগ্ন ডেভিড ওয়ার্নার, মিচেল মার্শ, ট্রাভিস হেড ও জস ইংলিস। খানিকবাদে আরও তিনজন একই পথ ধরলেন। ক্রিজে ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গী কামিন্স। কট্টর অজি দর্শকরাও একহাত নিতে প্রস্তুত। ভূজালির চেয়েও তীক্ষ্ণ এদের কথার বাণ!
ইনিংসের ২০তম ওভার। নুর আহমেদকে সুইপ করতে গিয়ে বলটা ফাইন লেগে ঠেলে দিলেন ম্যাক্সওয়েল। এক্সট্রা বাউন্স, চলে গেল শর্ট ফাইন লেগে। কিন্তু মুজিব উর রহমান ‘দ্য বিগ শো’-কে তালুবন্দি করতে পারলেন না। মূলত আটকে রাখার সাধ্য ছিল না। নিয়তির লিখনই বোধহয় ছিল এই। মহাকাব্য লিখতে গিয়ে কিংবদন্তিরাও থমকে গেছেন, কিন্তু থেমে থাকেননি। ভুল শুধরে উপহার দিয়েছেন ইতিহাসের অক্ষয় সৃষ্টি। ম্যাক্সওয়েলও সুযোগ পেয়ে ক্ষনিকের এই ভুলটুকু শুধরে জায়গা করে নিলেন অমরত্বে।
শুধু কি অংকের হিসেবে ঐ তিনটে সংখ্যাতেই অমরত্বের সীমাবদ্ধতা? তাহলে রোহিত শর্মা থেকে শুরু করে হালের শুভমান গিলও যে ভাগ বসানোর দাবিদার। কিন্তু এদেরকে ছাড়িয়ে বহুদূর চলে গেছেন অজি সাম্রাজ্যের ‘ম্যাড ম্যাক্স’। যা করলেন, ঐ পাগলামোটুকু স্রেফ পাগল ছাড়া কেউ করবে না। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েও হাসতে হাসতে বিজয়ীর বেশে মাঠ থেকে বের হওয়া। এরকমটা সর্বশেষ কবে দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব? ক্রিকবাজ তো হালের কাউকেই খুঁজে পেলো না, তারা চলে গেছেন মহাবীর আলেকজান্ডার, চেঙ্গিস খান, জুলিয়াস সিজার পর্যন্ত!
নাভিন উল হকের জোঁড়া আঘাতের পর আজমতউল্লাহ ওমরজাইয়ের টানা দুই উইকেট। মাঝে রশিদ খান এসে দেখিয়ে গেলেন নিজের ক্ষমতা। ৯১ রানে ৭ উইকেট নেই। অস্ট্রেলিয়া দেড়শ পেরোবে, এমনটা বাজি ধরারও লোক তখন শূন্যের কোটায়। কিন্তু বাজিটা ধরেছিলেন একজন, অজি কমান্ডার কামিন্স। বাজির ঘোঁড়া অপরপ্রান্তে থাকা ম্যাক্সওয়েল। সেই আশায় একপ্রান্ত আগলে একের পর এক বল ডিফেন্স করে গেলেন কামিন্স। যা দেখিয়েছেন, রাহুল দ্রাবিড়ও বোধহয় নিজের ‘দ্য ওয়াল’ খ্যাতিটা নির্দ্বিধায় তুলে দিতেন ক্যাপ্টেন অস্ট্রেলিয়ার হাতে!
কামিন্সের সুস্থ-সবল শরীর যখন একপ্রান্তে ‘চীনের প্রাচীর’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যপ্রান্তে তখন ক্র্যাম্প জর্জরিত শরীর নিয়ে সপাঁটে সাই সাই করে তলোয়ার চালাচ্ছেন ম্যাক্সি। কিংবা গদাও বলা যায়। কিন্তু কতক্ষণ? অসহ্য যন্ত্রণা কাবু করে ফেলেছিল, বাম পা অসাড়! তাতে কি? সবটুকু শক্তি এনে ভর করলেন হাতে। ফুটওয়ার্ক ছুঁড়ে ফেললেন ব্যাটিং অভিধান থেকে। কব্জির মোচড়ে চললো ব্যাট সুইংয়ের অনুপম প্রদর্শনী। সুইপ, রিভার্স সুইপ, শর্ট আর্ম জ্যাব; কিছুই বাদ রাখলেন না 'ম্যাড ম্যাক্স'।
ওয়াংখেড়ে মানেই শচীন। কোহলির কীর্তির দিনেও সমগ্র ওয়াংখেড়ের ঘাসও যেন ‘শচীন… শচীন’ চ্যান্টে উন্মাতাল হয়ে ওঠে। সেই রাজ্যে বিস্ময়কর সৃষ্টিতে মখমল বিছানো নর্থ স্ট্যান্ডের সিঁড়ি পেরিয়ে হাসতে হাসতে অদৃশ্য হয়ে যান ম্যাক্সওয়েল। রেখে যান অমরত্বের সকল আয়োজন। তাসমানের ঢেউ আছড়ে পড়ে গঙ্গার তীরে, আরব সাগরের উপকূলে। রক্ত-মাংসের মানবীয় আখ্যান ভুলে সমকাল পেরিয়ে ম্যাক্সওয়েলের নাম খোদাই হয়ে থাকে ক্রিকেট মহাকাব্যের মহাকালে। যেখানে কীর্তি ও কীর্তিমান চিরঞ্জীব।
ঢাকা/আমিনুল