ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

মুম্বাই ক্রিকেটের ‘হিমুর’ খোঁজে!

ইয়াসিন হাসান, মুম্বাই থেকে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৫১, ১৪ নভেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১০:২৭, ১৫ নভেম্বর ২০২৩
মুম্বাই ক্রিকেটের ‘হিমুর’ খোঁজে!

‘ওকে, আমি মেলাবো হিমুর সঙ্গে। হুট করে দেখা মিলে। মায়া ধরিয়ে দেয়। ফুরুৎ করে উড়ে যায়।’ খুব মায়াভরা কণ্ঠে বলছিলেন ভারতীয় এক সাংবাদিক। তার সঙ্গে ভারতের ক্রিকেটের বিস্ময়বালক বিনোদ কাম্বলির দেখা হয়েছিল গত ১৮ জুলাই। হোয়াটসঅ্যাপে দুজনের সঙ্গে শেষ কথা সেদিনই।

এ কথা, সে কথা, কত কথা দুজনের। কিন্তু, ওই সাংবাদিক ঘুণাক্ষরেও ধারণা করতে পারেননি, ওই রাতের পর আবার কাম্বলি হাওয়া হয়ে যাবেন। এর পর থেকে ওই নম্বরটাও অফ। হোয়াটসঅ্যাপও অনলাইন হয় না। 

তার মুখেই শুনুন বাকিটা, ‘এটা তার রোজকার অভ্যাস। রোজকার মানে রোজকার। কয়েক মাস খুব বিরক্ত করবে আপনাকে। মনে হবে, তখন তাকে ছেড়ে বাঁচি অবস্থা। কিন্তু, হুট করে যখন চলে যাবে, তার শূন্যতায় ভারী হয়ে যাবে চারপাশ। ও আমার কাছে স্রেফ হিমু।’ 

বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ সৃষ্ট কাল্পনিক চরিত্র হিমু মূলত একজন বেকার লোক; যিনি আচরণে বেখেয়ালি, জীবনযাপনে ছন্নছাড়া ও বৈষয়িক ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। 

ভারতের ক্রিকেটের ব্যাটিং ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকারের বন্ধু বিনোদ কাম্বলি। দুজন একই সঙ্গে লাইমলাইটে আসায় যখনই শচীনের নাম ওঠে তখন কাম্বলিকেও স্মরণ করা হয়। আবার যখন কাম্বলির নাম ওঠে শচীনের কথা মনে করা হয়।

ভারতীয় ক্রিকেটে রূপকথার অংশ হয়ে থাকা ৬৬৪ রানের অনন্য জুটি এসেছিল এই দুজনের ব্যাট থেকে। স্কুল ক্রিকেটে তাদের সেই জুটি এখনও মানুষকে মুগ্ধ করে। শচীন অপরাজিত ছিলেন ৩২৬ রানে। আর কাম্বলির ব্যাট থেকে আসে ৩৪৯ রানে। স্কুল ক্রিকেটের পথ মাড়িয়ে তারা দুজনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসেন। 

অনেকেই বলেন, ক্যারিয়ারের ‍শুরুর দিকে অনেক ক্ষেত্রেই শচীন টেন্ডুলকারের চেয়ে এগিয়েই ছিলেন কাম্বলি। কিন্তু, তিনি যা হতে পারতেন, তার দ্বারা যা সম্ভব হতো, তার ধারে-কাছেও যাননি। আর টেন্ডুলকার প্রতিভার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছেন পরিশ্রমকে। ফলাফল তো সবার সামনেই স্পষ্ট। 

শচীনের চেয়ে তিন বছর পর টেস্ট অভিষেক হয়েছিল কাম্বলির। ২১ বছর ৩২ দিনে বিনোদ কাম্বলি ভারতের সর্বকনিষ্ঠ এবং ক্রিকেট বিশ্বের তৃতীয় কনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মুম্বাইতেই সেই রেকর্ড গড়েন কাম্বলি। তিন দশক ধরে যে রেকর্ডটি এখন অক্ষত। 

শুধু এটাই নয়, কাম্বলির আরেকটি কীর্তিও এখন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ১৯৯৪ সালে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে ১ হাজার রানের মাইলফলক পেরিয়েছিলেন। মাত্র ১৪ ইনিংস লেগেছিল তার, যা স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের চেয়ে এক ইনিংস বেশি। অথচ এক বছরের মধ্যে ভারত হারিয়ে ফেলে টেস্ট ক্রিকেটের ধ্রুবতারাকে। ১৭ টেস্টে ৫৪ গড় ও চার সেঞ্চুরি, যেখানে রয়েছে দুটি ডাবল সেঞ্চুরি। এমন একজন কেন আড়ালে চলে যাবেন, আজও উত্তর খুঁজে পায় না কেউ। 

তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, বিশৃঙ্খলতার মাঝে বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়ে জীবনের সব এলোমেলো করে ফেলেন বিনোদ কাম্বলি। রাতারাতি পাওয়া সেই স্টারডমের মাঝে তাল সামলাতে পারেননি। মাঠের বাইরের জীবনটা ছিল বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। মাদক আর নারীতে বুঁদ হয়ে ছিলেন। ক্যারিয়ার শেষ করে অনেক কিছু করারই চেষ্টা করেছিলেন কাম্বলি। বলিউড, টেলিভিশন, রাজনীতি – কোনো কিছুই বাদ ছিল না। 

টেন্ডুলকার যার বন্ধু, তার এত অর্থাভাব থাকে কী করে? উত্তর মিলেছে এমন, ‘টেন্ডুলকার কত করবে ওর জন্য। যখন যা চেয়েছে, তা-ই পেয়েছে। বন্ধু শচীন কখনোর তার হাল ছাড়েনি। টেন্ডুলকারের মিডলসেক্স গ্লোবাল একাডেমির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ২০১৮ ও ২০২২ সালে। কিন্তু, কোনোবারই দায়িত্ব শেষ করতে পারেননি। শেষবার দায়িত্ব ছেড়েছেন কাউকে কিছু না বলে। পরে টেন্ডুলকার জানতে পারেন, শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের একাডেমি হওয়ায় কাম্বলি দায়িত্ব পালন করতে চাচ্ছেন না। এমন কথা শুনে টেন্ডুলকার গাড়িরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই গাড়িতে করে কিছুদিন যাতাযাত করেছিলেন। কিন্তু, পরে আবার তার দায়িত্ব ইউটার্ন।’

শেষ কয়েক বছরে প্রচণ্ড অর্থাভাব তাকে বেশ পোড়াচ্ছে। মুম্বাই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের কাছে চাকরির আবদেনও করেছিলেন। কিন্তু, পাননি। ভারতের হয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ টেস্ট ক্রিকেট খেলার কারণে মাসে ৩০ হাজার রুপি পেনশন পান। সেটাই নাকি বর্তমানে কাম্বলির একমাত্র অর্জন।

সংসার জীবনে কাম্বলি খুব খুশি হতে পারেননি। বিয়ে করেছেন দুটি। ক্যারিয়ার গোছানোর সময়ই নিয়োলা লুইসকে বিয়ে করেন। কিন্তু, চার বছর একসঙ্গে থাকার পর তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরবর্তীতে ফ্যাশন মডেল অ্যান্ড্রিয়া হেয়াটিকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে রয়েছে এক ছেলে ও মেয়ে। প্রায়ই স্ত্রী ও তার মধ্যে ঝগড়া, মারামারি হয়, যা থানা পর্যন্ত চলে যায়। এসব নিয়ে বিব্রত হতে হয় তাদের পরিবারকেও। 

শেষমেশ তবুও জানতে চাওয়া এখন কোথায় আছে কাম্বলি? কী করছে? শিবাজী পার্কে বিকেলে হাঁটতে আসে না? দূরে দাঁড়িয়ে ক্রিকেট খেলা দেখে না? উত্তর মেলে, না। খোঁজ করতে করতে পাওয়া যায় এক নাম, মার্কাস কুটো। শচীন টেন্ডুলকার ও বিনোদ কাম্বলির বন্ধু মার্কাস কুটো। ফোন নম্বর পেয়ে রিং বাজতেই কথার ঝাঁপি খুলে দেন মার্কাস। ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়াতে কাজ করা মার্কাস বিনোদ কাম্বলিকে নিয়ে এক আকাশ অভিমান ঝাড়লেও শচীনকে নিয়ে করলেন গর্ব—দুজন দুই মেরুতে। অথচ তাদের মিলিয়েছিল ক্রিকেট নামের একটা ধর্ম। বলতে পারবেন তারা কেন দুই পথে গেল? 

দুজনের প্রতিভা একই ছিল। সামর্থ্যে ঊনিশ-বিশ পার্থক্য। অথচ আজ কাম্বলি কোথায়, আজ টেন্ডুলকার কোথায়! দুজনের পথ আলাদা করেছে তাদের পরিবেশ, সঙ্গ, মানসিকতা। শচীন সব সময়ই ভদ্র। ভালো পরিবার, ভালো পরিবেশে বড় হয়েছে। ভাই-বোনদের দেখেছে পরিষ্কার জীবন করতে। কাম্বলিকে নষ্ট করেছে তার সঙ্গ। যেমন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মিশেছে, ঠিক তেমনই হয়েছে।’ 

কাম্বলি কোথায় আছে, সেটা তার অজানা নয়। কিন্তু, কাউকে বলতে চান না, ইতস্তত বোধ করেন। শঙ্কায় ভোগেন—‘ও এখন পুনর্বাসন কেন্দ্রে। চিকিৎসা নিচ্ছে। কেন নিচ্ছে, সেটা নিশ্চয়ই বলতে হবে না। প্রায়ই তাকে নিতে হয়। নিরুপায় হয়ে নিতে হয়। খুব শঙ্কায় ভুগতে হয় ওকে নিয়ে। কখন কী হয়ে যায়। ফিরে এসে আবার কী করে। ওর এই অবস্থা দেখতে কেউ পছন্দ করে না। কিন্তু, ওকে নিয়ে কেউ ঝুঁকিও নিতে চায় না। আমরা তো চাই ও বাচুঁক, আনন্দ করুক। পরিবার নিয়ে থাকুক। কিন্তু, কাম্বলি একবার যা বলেছে, সেটা করে ছেড়েছে। ইশ ও যদি মনোযোগ দিয়ে শুধু ক্রিকেট খেলত।’ 

মার্কাস কুটুর গলা ভারী হয়ে আসে। বন্ধু এমন অবস্থা মানতে পারেন না মার্কাস। মানতে পারেন না টেন্ডুলকারও। তাই তো পুনর্বাসন কেন্দ্রের খরচটাও অজান্তে দিয়ে আসেন। নিখোঁজ কাম্বলির খোঁজ মেলে। মুম্বাইয়ের শিবাজি পার্ক কিংবা ওয়াংখেড়ের সবুজ ঘাসে নয়, এমন জায়গায় যেখানে যেতে হলে জীবনের সব হিসেব-নিকেশ বাতিল করতে হবে। হতে হবে জীবনযাপনে ছন্নছাড়া। 

মুম্বাই/রিয়াদ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়