ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

অতিমানবীয় বিরাট সেঞ্চুরির শৃঙ্গে

ইয়াসিন হাসান, মুম্বাই থেকে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০৮, ১৫ নভেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৯:২৬, ১৫ নভেম্বর ২০২৩
অতিমানবীয় বিরাট সেঞ্চুরির শৃঙ্গে

এ যেন শচীনের ময়দানে বিরাট কোহলির মাস্তানি! নয় তো কি? 

যে ওয়াংখেড়েতে কেবল শচীন…শচীন…শচীন ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে, যে ওয়াংখেড়ের প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি কোণায় কেবল শচীনের জয়গান। যেখানে প্রতিটি ঘাস, হাওয়া তার নামে সুর ধরে…সেখানে আজ অন্য সুর! পালা বদলের হাওয়া! রেকর্ড ছাড়িয়ে নতুন অর্জনের অধ্যায়ের সূচনা। সমকাল ছাড়িয়ে মহাকালের পথে পা বাড়ানো একজনের অতিমানবীয় কীর্তি কথন।

সেই রক্তে মাংশে গড়া মানুষটা আর কেউ নন, স্বয়ং বিরাট কোহলি। নীল সমুদ্রে বিরাট জয়গান গাইয়ে ভারতের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ধ্রুবতারা নিজেকে নিয়ে গেলেন অনন্য এক উচ্চতায়। যেখানে পৌঁছাতে কেবল তপশ্যারই প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় এক আকাশ স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ছুঁতে অক্লান্ত পরিশ্রম, নিবেদনের গল্প। নিজেকে ভেঙে কঠিন ইস্পাত দৃঢ় মনোবলের তৈরি করা লম্বা সফরের।

ওয়ানডে ক্রিকেটে রেকর্ড পঞ্চাশতম সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন বিরাট। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়াংখেড়েতে এক নম্বর সেমিফাইনাল ম্যাচে ১১৩ বলে ১১৭ রান করেন ভারতের রান মেশিন। ৪৯তম সেঞ্চুরি তুলে কিছুদিন আগে আইডল টেন্ডুলকারকে ছুঁয়েছিলেন। আজ তাকে ছাড়িয়ে খুললেন নতুন এক ক্লাব। যেখানে কোহলিই প্রথম। সেঞ্চুরির ফিফটি। অতিমানবীয়, অসামান্য, অসাধারণ। ওয়ানডে ক্রিকেট কখনো এমন কিছুর চিন্তা করেছিল? ৪ হাজার ৭০৩ নম্বর ওয়ানডে এমন কিছুর সাক্ষী হলো।

৫৯ বলে ফিফটি। ১০৬ বলে সেঞ্চুরি। লোকি ফার্গুসনের বল ফাইন লেগে পাঠিয়ে ভো দৌড় বিরাটের। ২ রান নেবেন কল করেছেন শুরুতেই। ফিরে ক্রিজের মাঝপথেই ব্যাট উচিয়ে তার উদযাপন শুরু হয়ে যায়। এরপর শূন্যে লাফিয়ে গগনবিদারী এক চিৎকারে বুনো উল্লাসে ভারতের মাস্টারক্লাসের।  

দৌড়ে ক্লান্ত বিরাট ঠিক সেখানেই বসে পড়লেন যেখানে চোখ মেলে দেখা যায় ব্যাটিং ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকারকে। হেলমেট, গ্লাভস খুলে মাথা নামিয়ে দুইবার কুর্নিশ করলেন। বাহ! নিজের হিরো, ক্রিকেটের আদর্শকে ছাড়িয়ে যাওয়ার দিনে তাকে সম্মান জানাতে একটু ভুল করলেন না। বড় ক্রিকেটারের সঙ্গে বড় ক্রিকেটার্শ এভাবেই হয়।

গ্যালারিতে থাকা টেন্ডুলকারের মুখেও তখন চওড়া হাসি। করতালির পর হাত নাড়িয়ে যেন বুঝিয়ে দিয়েছেন, তোমার দ্বারা সম্ভব হয়েছে।  তার পাশেই বিসিসিআইয়ের সেক্রেটারি জয় শাহ। ক্যামেরা খুঁজে নেয় স্ত্রী আনুশকা শর্মাকে। তিন উড়ন্ত চুমু ছুঁড়ে দিয়ে বিরাটকে ভাসান উষ্ণতায়। এদিন ড্রেসিংরুমের পাশাপাশি বিরাট গ্যালারিতে পাশে পেলেন সতীর্থদেরও। ইনজুরিতে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়া হার্দিক পান্ডিয়া জার্সি গায়ে জড়িয়ে গ্যালারিতে ছিলেন। লেগ স্পিনার যুজবেন্দ্র চাহালও ছিলেন ঠিক তার নাগালে। 

এছাড়া একঝাঁক বলিউড সুপারস্টার। মুকেশ আম্বানির ছেলে আকাশ আম্বানির ছেলের সঙ্গে তখন দাঁড়িয়ে বিরাটকে অভিনন্দন জানান ফুটবলের কিংবদন্তি ডেভিড বেকহ্যাম। ইউনিসেফের একটি প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি ভারত-নিউ জিল্যান্ডের ম্যাচ গ্যালারিতে বসে দেখছেন ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক। এছাড়া শ্রদ্ধা কাপুর, শহীদ কাপুর, কিয়ারা আদভানি, শ্রীদ্ধার্থ, জন আব্রাহামকেও দেখা যায় দাঁড়িয়ে করতালিতে বিরাটের অর্জনকে মহিমান্বিত করে তুলতে।

ফেরার সময় হেলমেট খুলে শূন্যে তাকিয়ে, ব্যাট উচুঁ করে কিছু একটা বলতে দেখা গেল বিরাটকে। প্রিয় বাবাকে এদিন নিশ্চয়ই খুব অনুভব করছেন। বাবা চেয়েছিলেন বলেই তো বিরাট ছুটে গিয়েছিলেন মাঠে। সেই মাঠ থেকেই আজ শচীনের ময়দানে শচীনকে ছাড়িয়ে সেঞ্চুরির শৃঙ্গে বিরাট। দূর আকাশে তারা হয়ে বাবা দেখছেন ছেলের কীর্তি। 

ড্রেসিংরুমে ফিরে অধিনায়ক রোহিত শর্মার অভিনন্দন পেয়েছেন সবার হাতে। দুজন হাতে হাত মিলিয়েছেন। বিরাটের পিঠ চাপড়, মাথায় হাত বুলিয়ে নেতা রোহিত বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই মাইলফলক, এই অর্জন ছুঁয়ে যাচ্ছে গোটা দলকে।

এদিন শুধু টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরির রেকর্ডকেই ছাড়িয়ে যাননি বিরাট। ৭১১ রান তুলে এক আসরে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন। টেন্ডুলকার ২০০৩ সালে ১১ ইনিংসে ৬৭৩ রান করেছিলেন। কোহলি এক ইনিংস কম খেলেই ছাড়িয়ে যান ক্রিকেট আদর্শকে। 

ভারতের ইনিংস শেষে প্রোডাকশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিরাট বলেন, ‘আসলে আমি এখন শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছি। দ্য গ্রেট ম্যান (শচীন টেন্ডুলকার) আমাকে মাত্রই অভিনন্দন জানালো। এটা স্বপ্নের মতো। টু গুড টু বি ট্রু। শচীন (পাজি) আজ এই স্ট্যান্ডে বসে আমার সেঞ্চুরি দেখেছে। আমার জন্য অনুভূতি প্রকাশ করা সত্যিই খুব কঠিন। আমার জীবনের পার্টনার, আবার হিরো সবাই এখানে বসা। সঙ্গে ওয়াংখেড়ের দর্শকরা তো আছেই। আমি অভিভূত।’

টেন্ডুলকার টুইটারের পাশাপাশি প্রোডাকশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘প্রথম আমি তাকে যেভাবে দেখেছিলাম। দলের সতীর্থরা ওর সঙ্গে মজা করেছিল। বলেছিল, আমার পা ছুঁয়ে সালাম করতে। এটা নাকি সংস্কৃতি। সেদিন খুব মজা পেয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সে আমার হৃদয় ছুঁয়ে ফেলে তার প্যাশন ও স্কিল দিয়ে। আমি খুবই আনন্দিত যে সেদিনের ছোট ছেলেটাই আজ বিরাট কীর্তি গড়লো। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে একজন ভারতীয় এই রেকর্ডটা ভেঙেছে। সেটাও এরকম এক মঞ্চে- বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। সঙ্গে আমার মাঠে। অসাধারণ।’

চারিদিকে প্রশংসার বাক্যে ভাসছেন বিরাট। সবচেয়ে বড় প্রশংসাটা বিরাট কিছুদিন আগে হয়তো নিজে করেছিলেন। যেদিন বলেছিলেন, ‘আমি চাই শীর্ষে যেতে। এজন্য যা কিছুর প্রয়োজন সব করবো।’ বিরাট দেখিয়ে দিয়েছেন মনের জোর থাকলে কতটা পথ পাড়ি দেওয়া যায়। ক্রিকেট মহাকাব্যে স্বর্ণাক্ষরে নিজের নাম তুলে বিরাট যেন হয়ে উঠলেন অতিমানবীয়।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়