দশে দশ ভারত: রাজসিংহাসনে বসার অপেক্ষা
ইয়াসিন হাসান, আহমেদাবাদ থেকে || রাইজিংবিডি.কম
পরীক্ষার খাতায় দশে দশ নম্বর পেলে আর কিছু চাওয়ার থাকে না। শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব তার জন্য প্রস্তুত থাকে। চারিদিকে বয়ে যায় আনন্দ। হাওয়ায় ভাসতে থাকে স্তুতি।
বিশ্বকাপে ভারত যেভাবে পারফর্ম করছে, দাপট দেখিয়েছে, প্রতিপক্ষকে নিয়ে ছেলেখেলায় মেতে উঠেছে তাতে তাদের নামের পাশে দশে দশ থাকবে সেটা স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই। বিশ্বকাপের রিপোর্ট কার্ডে একমাত্র তারাই পেয়েছে দশে দশ।
কিন্তু রাজসিংহাসনে বসার পরীক্ষটা হচ্ছে এগার নম্বরে! শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিততে প্রয়োজন আরও এক জয়। শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে হলে আরও এক জয় চাই নীল জার্সিধারীদের। তাহলেই না পরীক্ষার খাতায় মিলবে গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস।
নিউ জিল্যান্ডকে ৭০ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে ফাইনালের টিকিট পেয়েছে ভারত। প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। ভারতের কি তাতে কিছু আসে যায়? সৌজন্যতার খাতিরে উত্তরটা হয়তো আসবে, সম্মান নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই টিম ইন্ডিয়া ধরা ছোঁয়ার বাইরে। শিরোপা পুনরুদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর। ১২ বছর পর ফাইনালে উঠে সেই রেশ নিশ্চিতভাবেই টিকিয়ে রাখতে চাইবে রোহিত শর্মারা।
কোন পথে হেঁটে ভারতের এই জয়ের উৎসব চলছে? কোন কোন বক্সে টিক পড়ায় ভারত এতোটা অপ্রতিরোধ্য? জানার চেষ্টায় যেসব বেরিয়ে এসেছে তা হলো-
এক: ব্যাটিংয়ে প্রথম পাঁচ জনের ফিয়ারলেস অ্যাপ্রোচ
দুই: মোহাম্মদ সামির সংযোজন
তিন: কিপিংয়ে বাজপাখি লোকেশ রাহুল
চার: ফিল্ডিং মাস্টারক্লাস
পাঁচ: গতিতে আপোষহীন, স্পিনে বিষ
ছয়: হোম অ্যাডভানটেজের পুরো ব্যবহার
সাত: রাহুল দ্রাবিড়ের ধৈর্য্য ধরে চলো নীতি
আট: দলীয় একতা।
অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি দিক সমানতালে এগিয়ে যাওয়ায় ভারত এখনও অপরাজিত। ব্যাটিংয়ের কথাই ধরা যাক, দশ ম্যাচে পাঁচ ইনিংসে প্রথমে আগে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছে ভারত। যেখানে চারটিতেই তাদের রান তিন‘শ-এর বেশি। সবচেয়ে বেশি ৪ উইকেটে ৪১০। সবচেয়ে কম ৫ উইকেটে ৩২৬। আগে ব্যাট করে কেবল একবারই ২২৯ রান করেছে। সেই ম্যাচটিও তারা জিতেছিল হেসে-খেলে বোলারদের নৈপূণ্যে। এছাড়া রান তাড়াতেও তারা অপ্রতিরোধ্য। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ২৭৪ করে জিতেছে। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই’শর বেশি রান তাড়া করেছে অনায়েসে। কোনোবারই তাদের জয় পেতে তেমন বেগ পেতে হয়নি।
ব্যাটিংয়ে এই দুর্দান্ত পথ চলার বড় কারণ প্রথম পাঁচজনের ফিয়ারলেস ব্যাটিং। রোহিত শর্মা, শুভমান গিল, বিরাট কোহলি, শ্রেয়াস আইয়ার ও লোকেশ রাহুল যেভাবে দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখাচ্ছেন ২২ গজে তাতে প্রতিদিনই কেউ না কেউ পুড়ছে। ইনিংসের শুরুতে আগ্রাসী ক্রিকেটের সুর বেঁধে দেন রোহিত। উইকেটের পরোয়া না করে চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে দলের স্কোর বাড়িয়ে নেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর তার কোনো তিন অঙ্কের ইনিংস নেই। চাইলে সেঞ্চুরির করতে পারতেন। কিন্তু দলের প্রয়োজনে বিধংসী শুরু এনে দেওয়ার লক্ষ্যে বাড়তি ঝুঁকি নিচ্ছেন। তাতেই মিলছে সফলতা। কখনো আউট হচ্ছেন। কিন্তু তা গায়ে মাখছে না দল। এছাড়া শুভমান গিল, কোহলি, শ্রেয়াস ও রাহুলের রান ছুট তো রয়েছে। এদের মধ্যে কেবল গিলই সেঞ্চুরি পাননি। বাকিরা কেউ একটি, কেউ একাধিক সেঞ্চুরি পেয়ে ভারতকে রান উৎসবে ভাসাচ্ছেন।
ব্যাটিংয়ে প্রথম পাঁচজন যেমন ফিয়ারলেস। বোলিংয়ে মোহাম্মদ সামি সেই কাজটাই করে যাচ্ছেন। শুরুর চার ম্যাচে দর্শক হয়ে ছিলেন ড্রেসিংরুমে। হার্দিক পান্ডিয়ার ইনজুরিতে তার ভাগ্য ফেরে। কম্বিনেশনের কারণে শার্দুল দলের বাইরে যান সামি ঢুকে পড়েন দলে। মাঠে নেমেই ৫ উইকেট। সেমিফাইনালে ইতিহাস গড়ে তার শিকার ৭। মাঝে সেই একই ছন্দে বোলিং করে গেছেন। সব মিলিয়ে ৬ ম্যাচে ২৩ উইকেট নিয়ে বোলিংয়ে টোন সেট করে দিয়েছেন এই পেসার।
উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে লোকেশ রাহুল যেভাবে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছেন তা নিশ্চিতভাবেই চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। দুর্দান্ত সব ক্যাচ নিয়ে ম্যাচের মোমেনটাম সেট করে দিচ্ছেন রাহুল। ব্যাটিংয়ে তার আগ্রাসী মনোভাবের কথা সবারই জানা। কিন্তু কিপিংয়ে এতোটা সাবলীল, এতোটা সরল তা চোখে পড়েছে এই বিশ্বকাপ মঞ্চে। দুই পাশে দারুণ সব ডাইভ দিয়ে যেভাবে ক্যাচ নিচ্ছেন তাতে তাকে বাজপাখির তকমা দেওয়াটাও যেন কম।
শুধু রাহুল নয়, ভারতের ফিল্ডিং হচ্ছে মাস্টারক্লাস। ফিল্ডিং কোচ রামাকৃষ্ণানান শিরধার প্রতি ম্যাচে সেরা ফিল্ডার বেছে নিতে একটি করে মেডেল দিচ্ছেন। প্রায় প্রতি ম্যাচেই নতুন কোনো মুখ পাচ্ছেন সেই মেডেল। গ্রাউন্ড ফিল্ডিং জোর দিয়ে কিভাবে রান আটকানো যায় তা খুব ভালোভাবে দেখিয়েছে তারা। জমাট ফিল্ডিংয়ের কারণে প্রতিপক্ষকে বাড়তি চাপে রাখা যায়। সেই চিত্র তাদের ফিল্ডিংয়ে মিলেছে।
ভারতের পেসাররা এই বিশ্বকাপে যেভাবে দাপট দেখিয়েছে তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। গতিতে একটুও আপোষ করেননি সামি, সিরাজ, বুমরাহ। ৬ পেসার ১০ ম্যাচে নিয়েছে ৬২ উইকেট। যেখানে তাদের বোলিং গড় অবিশ্বাস্য, ১৯.২৫। আর ইকোনমি ৫.০৩। সর্বোচ্চ ৫ উইকেট আছে ৩টি। ৩টিই নিয়েছেন সামি। পেসারদের এমন ঝলমলে পারফরম্যান্সে ভারতের জয়ের পথ যে মসৃণ হয়ে যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখছে না।
সঙ্গে স্পিনাররাও কম যাননি। ১০ ম্যাচে তাদের শিকার ৩৩ উইকেট। দুই বিভাগে সম্মলিত এই প্রচেষ্টাতেই ভারত বিশ্বজয়ের থেকে মাত্র এক পা দূরে।
ঘরের মাঠে খেলা। ভারত সেই সুবিধা নেবে না তা কী করে হয়। বিশ্বকাপে একমাত্র দল ভারত যারা প্রথম পর্বে নয় ম্যাচ নয়টি শহরে খেলেছে। বাড়তি ভ্রমণ করা লাগলেও নিজেদের পছন্দমতো উইকেটে স্বাগতিক দর্শকদের সামনে তারা খেলতে পেরেছে। কোন মাঠে কোন সুবিধা তা খুব ভালোভাবেই তাদের জানা। সেভাবেই তারা সুবিধা নিয়েছে। সেমিফাইনালে তারা সতেজ উইকেটের পরিবর্তে ব্যবহৃত উইকেটে খেলেছে। শেষ মুহূর্তে পরিবর্তন করেছে পিচ। যা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলেও আইসিসি জানিয়েছে, আইন অনুযায়ী পিচ পরিবর্তন হয়েছে। তাই খুব বেশি কিছু বলারও নেই।
ভারতের কোচ রাহুল দ্রাবিড় ক্যারিয়ার জীবন থেকেই ধীরে চলো নীতিতে বিশ্বাসী। কোচিংয়েও সেই প্রতিফলন মিলেছে। সাদামাটা চলাফেরা আর শান্ত স্থির হয়ে নেওয়া প্রতিটি সিদ্ধান্ত যেন তার পক্ষে আসছে প্রতিনিয়ত। রিশাভ পান্তের জায়গায় ভারত মিডল অর্ডারে কাউকেই থিতু করতে পারছিল না। সেখানে লোকেশ রাহুলকে খেলিয়ে তার থেকে সর্বোচ্চটা আদায় করে নেওয়ার কৃতিত্বটা দ্রাবিড়ের। সঙ্গে পেস অলরাউন্ডার হার্দিককে হারানোর পরও যেভাবে তারা মিডল ও লেট অর্ডারে থিতু হয়েছেন তা প্রশংসার দাবিদার। সামিকে দলে ফেরানো। তার পারফরম্যান্সে উৎকর্ষতা ছড়ানো সবই যেন দ্রাবিড়ের শান্ত মাথার সেরা বুদ্ধি।
২০০৭ বিশ্বকাপ তার খেলোয়াড়ী জীবনের শেষ বিশ্বকাপ। খেলোয়াড় হয়ে শিরোপা পাননি। কোচ হয়ে সেই আক্ষেপ দূর করার পথে দ্য ওয়াল।
এই দলের সাফল্যের পেছনে বড় কারণ দলীয় একতা। মাহেন্দ্র সিং ধোনি ভারতের অধিনায়ক থাকাকালীন বলেছিলেন, ‘কখনো আপনি জিতবেন, কখনো হারবেন। কিন্তু সাফল্যের পাশাপাশি আপনি যদি হারটাও ভাগাভাগি করে নিতে পারেন তাহলে সফলতা পেতে সময় লাগবে না।’
রোহিত শর্মারা মাঠের ক্রিকেটে সেই একতাই দেখিয়েছেন। মাঠের বাইরেও তাই। রোহিত বিরাটের দ্বন্দের কথা জানে না কে? কিন্তু মাঠে তাদের দেখলে বোঝা যায় মাঠের বাইরে তারা কেউ কারো সঙ্গে কথাটাও বলে না? অথচ মাঠে দুজন দুজনকে প্রশংসায় ভাসান শব্দের যাদুতে।
মাঠের বাইরে নিজেদেরকে চাঙ্গা রাখতে ভারত নানা অ্যাক্টিভিটিজে জড়িয়েছিল। বিশ্বকাপের মাঝপথে তারা নিজেরা মেতে উঠেছিলেন 'গোপন' এক ফ্যাশন শোতে। দিওয়ালির উৎসব পালন করেছে পরিবার নিয়ে। যেখানে তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কের গভীরতা ফুটে ওঠে। সঙ্গে এক হওয়ার ছবি। নিজেদের চাঙা রাখতে ও সম্পর্ক দৃঢ় করতে এসব ভালো বলেই জানিয়েছিলেন রোহিত, 'ভালো ও আরামদায়ক পরিবেশ রাখতে চাচ্ছি আমরা। সেটা করতে যা যা করার দরকার, সেটা আমরা করে যাচ্ছি। চাপ থাকবেই। যখন আপনি মাঠে নেমে যাবেন, এটা অনেকটা ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে যায়। তবে তার আগে মাঠের বাইরে আমরা চেষ্টা করি ভালো পরিবেশ সৃষ্টি করতে।’
ফাইনাল হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। যেখানে দর্শক থাকবে ১ লাখ ৩০ হাজারের মতো। ভারতের নীল উৎসব থামাতে পারবে তো কেউ? নাকি রোহিত অ্যান্ড কোং অপরাজিত বিশ্বচ্যাম্পিয়নের গৌরব অর্জন করবে? ১৯ নভেম্বর পাওয়া যাবে সেই উত্তর।
আহমেদাবাদ/ইয়াসিন/আমিনুল