ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

মায়ের বিশ্বাস ও কনকাসান সাব থেকে যেভাবে বিশ্বজয়ী লাবুশেন

ক্রীড়া প্রতিবেদক, আহমেদাবাদ থেকে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৬, ২০ নভেম্বর ২০২৩   আপডেট: ০৮:৫১, ২০ নভেম্বর ২০২৩
মায়ের বিশ্বাস ও কনকাসান সাব থেকে যেভাবে বিশ্বজয়ী লাবুশেন

জীবনের মোড় কখন, কোনভাবে ঘুরে যাবে তা কেউ কি আগাম আন্দাজ করতে পারে? সম্ভব নয় আন্দাজ করা। কিন্তু পৃথিবীতে যে মানুষগুলো সবচেয়ে আপন, তাদের বিশ্বাসের একটা আলাদা জোর থাকে। যে জোরে অনেক অসাধ্য সাধন করা যায়। অনেক অজেয়কে জয় করা যায়। তাতে জীবন একেবারেই পাল্টে যায়। প্রজাপতির ডানায় শত রঙ ছিটিয়ে জীবনের ক্যানভাস সাজিয়ে দেয়। 

মার্নাস লাবুশেনের জীবনে ঠিক এমনই কিছু ঘটেছে। তিন মাস আগেও তার পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কোনো গতিপথ ছিল না। অস্ট্রেলিয়া দলে তার জায়গা পেন্ডুলামের দুলছিল। তিন মাস পর সেই লাবুশেনের মাথায়ই বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। রোববার ভারতকে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া জিতেছে বিশ্বকাপের ষষ্ঠ শিরোপা। ফাইনালে লাবুশানের অপরাজিত ৫৮ রানের ইনিংসটি ছিল অসাধারণ। হেড সেঞ্চুরি করে দলকে জেতালেও লাবুশান ছিলেন আনসাং হিরো। জীবন ঠিক এভাবেই রং পাল্টায়।

লাবুশানের এই গল্পের পেছনে রয়েছে তার মায়ের বিশ্বাসের জোর। যে বিশ্বাসের জোরে অকল্পনীয় অনেক ঘটনা ঘটে গেছে লাবুশানের জীবনে। একাধিক খেলোয়াড়ের চোট, নির্বাচকদের আস্থা এবং সবশেষে তার পারফরম্যান্স; সব মিলিয়ে তিন মাসে তার সফর ছিল নানা উথান-পতন। সেই গল্পই শোনা যাক।

গত ৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লুমফন্টেনে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা মুখোমুখি। কাগিসো রাবাদার শর্ট বল ক্যামেরুন গ্রিনের মাথায় আঘাত করলে ক্রিজ ছেড়ে উঠে যান। ২২৩ রানের লক্ষ্য তাড়ায় অস্ট্রেলিয়া তখন ব্যাটিংয়ে ধুকছে। মাথায় আঘাত পাওয়ার পর ব্যাটসম্যান ব্যাটিংয়ে নামতে না পারলে কনকাসন সাব নামানোর আইন রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়া মার্নাস লাবুশেনকে আটে পাঠায় ম্যাচ বাঁচাতে। কিন্তু ডানহাতি ব্যাটসম্যানের ভাবনা ছিল ভিন্ন। ২২ গজে নেমে প্রতি আক্রমণে গিয়ে ও লেজের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন। লাবুশানে যখন মাঠে যান তখন অস্ট্রেলিয়া জয়ের থেকে ১৫১ রান দূরে। সেখানে থেকে একা ৮০ রান করে এবং অষ্টম উইকেটে অ্যাস্টন আগারের সঙ্গে ১১২ রানের জুটি গড়ে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন। 

কনকাসন সাব হয়ে লাবুশেন এর আগেও এমন কিছু করেছেন। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম কনকাসন সাব হয়েছিলেন তিনি। অ্যাশেজে লর্ডসে স্টিভেন স্মিথ মাথায় আঘাত পেলে লাবুশেন মাঠে গিয়ে ফিফটি করে নিজের সামর্থ্যের বার্তা দিয়ে রাখেন। কিন্তু ঘটনা সেটাও নয়। ম্যাচ শেষে লাবুশেন জানান, ম্যাচের আগের দিন তার মা তাকে জানান, প্রথম ম্যাচটা তুমি খেলবে। কিন্তু লাবুশেন মাকে জানিয়ে দেন, ‘না আমি কাল দলে নেই।’ জবাবে তার মা আরো বলেন, ‘দেখবে তুমি খেলবে। এজন্য প্রস্তুত থাকো।’ পরদিনই গ্রিনের কনকাসন সাবে লাবুশেন মাঠে নেমে ৮০ রানের ইনিংস খেলে দলকে জেতান। পরের ম্যাচে তার ব্যাট থেকে আসে আরেকটি ১২৪ রানের ইনিংস। মায়ের সেই বিশ্বাসেই রঙিন জার্সিতে থিতু হয়ে যান লাবুশেন। 

তবে তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তেমনটা নয়। দলে কারো ইনজুরি বা অন্য কোনো পরিস্থিতি তৈরি না হলে লাবুশেনকে তার জায়গা ছাড়তে হতো। যেমন বিশ্বকাপের ১৮ জনের প্রাথমিক স্কোয়াডে তাকে রাখেনি জর্জ বেইলির নির্বাচক প্যানেল। ২৫.৮০ গড় ও ৭৭.৯৮ স্ট্রাইকরেটের একজন ব্যাটসম্যানকে নেওয়া উচিত মনে করেননি তারা। 

কিন্তু তিন মাস পর সেই লাবুশেন অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয়ের পার্শ্বনায়ক। হেডের সঙ্গে ১৯২ রানের জুটি গড়েন। তাতে ৪৭ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর অস্ট্রেলিয়া জয় পায় অনায়াসে, ৪২ বল হাতে রেখে। ১১০ বলে তার সাজানো ৫৮ রানের ইনিংসটি ম্যাচ জয়ের সমান কৃতিত্বের। বিশ্বকাপ দলে তার জায়গা হতো না যদি অ্যাস্টন আগার ইনজুরি এবং পারিবারিক কারণে ছিটকে না যেতেন। 

দক্ষিণ আফ্রিকাতেও লাবুশেনকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল না। স্টিভেন স্মিথ চোটে পড়লে একেবারে শেষ পর্যায়ে দলের সঙ্গে বিমানে চড়েন এ ব্যাটার। সেখান থেকে শুরু হয় তার নতুন যাত্রা। এ নিয়ে ফক্স স্পোর্টসকে লাবুশেন তখন বলেছিলেন, ‘আমার কোন সন্দেহ নেই যে আমি এখন অস্ট্রেলিয়ার জন্য সেই মিডল অর্ডারে ব্যাট করার জন্য সঠিক ব্যক্তি।’

বিশ্বকাপ স্কোয়াডে আগারের জায়গায় তার সুযোগ মিললেও একাদশে রাখা হবে কিনা সেই নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু তার কী ভাগ্য…প্রথম ম্যাচের আগে মার্কস স্টয়নিস ইনজুরিতে পড়লে চেন্নাইয়ে ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে সুযোগ হয় তার। আবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার খেলা হতো না যদি গ্লেন ম্যাক্সওয়েল গলফ কার্ট থেকে পড়ে ব্যথা না পেতেন। 

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেমি-ফাইনালে তাকে খেলানো নিয়ে দ্বিধায় ছিল দল। স্টয়নিস নাকি লাবুশেন, কাকে খেলানো যায় সেটা নিয়েই ছিল যত জল্পনা। স্টয়নিসকে খেলালে বাড়তি বোলার পাওয়া যাবে এই ভাবনা ছিল। কিন্তু শেষমেশ লাবুশেনকেই বেছে নেয় নির্বাচকরা এবং ফাইনালেও তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ফাইনালের আগে শনিবার রাত ১০.১০ মিনিটের পর নির্বাচকদের থেকে তিনি জানতে পারেন, প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালের একাদশে থাকছেন। পরের গল্পটা তো একেবারেই তরতাজা। সবার হৃদয়ে গাঁথা। 

নানা পথ, অলি গলি ঘুরে এমন সাফল্যমন্ডিত অধ্যায় তার জীবনে যুক্ত হবে লাবুশেন কল্পনাও করতে পারেননি। ভাগ্যকে বিশ্বাস করা এই বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার নিজের সাফল্যের কৃতিত্ব দিলেন স্রষ্টাকে, ‘আমি যা অর্জন করেছি তা অবিশ্বাস্য। এটি আমার সর্বকালের সেরা অর্জন হয়ে থাকবে। আমরা জানতাম যদি আমরা আমাদের সেরা ক্রিকেট খেলতে পারি তাহলে সুযোগ থাকবে। আপনারা জানেন, আমি কথা দিয়ে কথা রাখার মানুষ। আমি সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করি। যেভাবে আমার জীবনে সবকিছু হচ্ছে তা এক কথায় অকল্পনীয়। অসাধারণ। আমি আসলে বলার কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।’

হলুদ জার্সিতে প্রত্যাশামাফিক পারফরম্যান্স না করায় হাল ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবছিলেন লাবুশেন, ‘যতবার আমি চিন্তা করেছি, আমি শেষ…আসলে শেষ রাতেও এমন ভাবনা এসেছিল। যখন রাত ১০টা ১০ পর্যন্ত আমি কোনো ডাক পাইনি যে আমি কাল (ফাইনাল) খেলব। মনে হয়েছিল আমাকে বাদ হয়েছে হয়তো। কিন্তু আমি খুবই খুশি যে আমার ওপর তারা বিশ্বাস রাখতে পেরেছে। তিন মাস আগেও আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়ানডে দলে ছিলাম না। পরবর্তীতে যুক্ত হই। সেখান থেকে টানা ১৯ ম্যাচ খেলা সত্যিই আমার জন্য অলৌকিক ঘটনা। আমি সৃষ্টিকর্তাকে এজন্য ধন্যবাদ জানাই।’

স্মিথের কনকাসন সাব হয়ে সাদা পোশাকের অস্ট্রেলিয়া দলে ঢুকে লাবুশেন বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন। এ বছরই দলের হয়ে অ্যাশেজ জিতেছেন। হয়েছেন টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের চ্যাম্পিয়ন। এবার ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপাও পেয়ে গেলেন। নিজের সামর্থ্য ও অক্লান্ত পরিশ্রমের সঙ্গে ভাগ্য কিছুটা সহায়ক হলে চ্যাম্পিয়নের গৌরবও অর্জন করা যায় তা লাবুশেনকে দেখলেই বোঝা যায়। 

আহমেদাবাদ/ইয়াসিন/বিজয়

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়