ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২১ ১৪৩১

১১ মিটার দৌড়ে ১১ কিলোগ্রামের ট্রফি জয়

ক্রীড়া প্রতিবেদক, আহমেদাবাদ থেকে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৪, ২০ নভেম্বর ২০২৩   আপডেট: ০৯:৪৫, ২০ নভেম্বর ২০২৩
১১ মিটার দৌড়ে ১১ কিলোগ্রামের ট্রফি জয়

কথায় আছে না, ক্যাচেস উইন ম্যাচেস। অস্ট্রেলিয়ার জন্য এই প্রবাদটাই সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বকাপ ফাইনালের মঞ্চে অবিশ্বাস্য এক ক্যাচ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া নিজেদের ঘরে তুলেছে শিরোপা। সেই ক্যাচের নায়ক ত্রাভিস হেড। রোহিত শর্মার ক্যাচ নিয়ে ম্যাচের মোড়টাই ঘুরিয়ে দিয়েছেন উড়ন্ত এই ফিল্ডার।

শুধু ক্যাচই নয়, নরেন্দ্র মোদী ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আজকের দিনটাই ছিল হেডের। রোহিতের অবিশ্বাস্য ক্যাচ নিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার পর ব্যাটিং নেমে ১২০ বলে ১৩৭ রানের ইনিংস খেলেন। তাতে ভারতের দেওয়া ২৪০ রানের লক্ষ্য অস্ট্রেলিয়া ছুঁয়ে ফেলে অতি সহজে। ভারতের হার, অস্ট্রেলিয়ার জয়ের পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে একটি ছবিই সবার চোখে ধরা দিচ্ছে, ম্যাক্সওয়েলের বলে রোহিতের আউট। যে সাফল্যের রূপকার দুর্দান্ত হেড।   

টস হেরে ব্যাটিং করতে নেমে রোহিতের ব্যাটিংয়ে তখন উড়ছে ভারত। পুল শটে ছক্কা মেরেছেন। কাভার ড্রাইভে পেয়েছেন চার। এগিয়ে এসে বোলারের মাথার ওপর দিয়েও মেরেছেন ছক্কা-চার। স্পিনারকে কাট করে বল পাঠিয়েছেন সীমানায়। ৯.৩ ওভারে ভারতের রান ১ উইকেটে ৭৬। রোহিতের রান ৩০ বলে ৪৭। হিটম্যান ৪ চার ও ৩ ছক্কায় তখন উড়ছেন। দলের ৬২ শতাংশ রান আসে তার ব্যাট থেকে। যেখানে তার স্ট্রাইক রেট ছিল ১৫১, সঙ্গীর ৫৭! 
 
অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচে ফিরে আসার জন্য তাকে ফেরানোর দরকার ছিল। ম্যাক্সওয়েলকে বোলিংয়ে এনে বাজিটা ধরেছিলেন কামিন্স। জিতেও যান অজি দলপতি। ১৭ রানের খরচায় কাঙ্খিত উইকেটও পেয়ে যায় অজিরা। তার পুরো কৃতিত্ব হেডের। ম্যাক্সওয়েলকে উড়াতে গিয়ে টাইমিংয়ে গড়বড় করেন রোহিত। বল যায় ডিপ কভারে। হেড তখন পয়েন্টে ফিল্ডিংয়ে। দৌড়ে বলের পেছন ছুটেন। ১১ মিটার দৌড়ে পৌঁছান বলের নিচে। 

এ সময়ে এক মুহূর্তের জন্য বল চোখের আড়াল করেননি। ঝাঁপিয়ে প্রথমে দুই হাতে বল তালুবন্দি করতে চেয়েছিলেন। পরে শুধু বাঁহাত এগিয়ে বল মুঠোয় জমিয়ে নেন। ভারসাম্য ঠিক রাখতে এবং বল যেন বেরিয়ে না যায় সেজন্য ফলো থ্রুতে কনুই নামিয়ে নিজেকে সঁপে দেন মাঠের মখমলের ঘাসে। ব্যস! তাতেই অস্ট্রেলিয়া পেয়ে যায় ভারতীয় অধিনায়কের উইকেট। ম্যাচ ভারতের থেকে চলে আসে অস্ট্রেলিয়ার হাতের মুঠোয়।

অনেকেই হেডের এই ক্যাচের সঙ্গে ১৯৮৩ সালে কপিল দেবের নেওয়া ভিভ রিচার্ডের ক্যাচের মিল খুঁজে পাচ্ছে। লর্ডসে ভিভ রিচার্ডস শর্ট বলে মিড উইকেটে ক্যাচ তুলেছিলেন ৩৩ রানে। কপিল দেব শর্ট মিড উইকেটে ফিল্ডিংয়ে ছিলেন। দৌড়ে প্রায় ১৫ গজ পেছনে গিয়ে বল দুই হাতের তালুতে জমান। হেডের নেওয়া ক্যাচটি আরো কঠিন, পরিস্থিতি বিবেচনায় বড়।  

রোহিতের ব্যাট যেভাবে ছুটছিল তাকে থামানোর প্রয়োজন ছিল। তখন পুরো গ্যালারিও ‘ভারত-ভারত’ চিৎকারে মেতে উঠেছিল। উল্লাস চলছিল গ্যালারিতে থাকা ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শকের। যখনই হেড ওই ক্যাচ নিলেন গোটা গ্যালারিও নিশ্চুপ। ভারতের অধিনায়কের উইকেট এতোটাই মহামূল্যবান ছিল ফাইনালের মঞ্চে। বিশ্বকাপে ৫৯৭ রান করে রোহিত থামেন সেখানেই। 

বিশ্বকাপে ইনজুরি নিয়ে এসেছিলেন হেড। পাঁচ ম্যাচ ড্রেসিংরুমে বসে থাকার পর ষষ্ঠ ম্যাচে মাঠে নেমেই করেন ৫৯ বলে সেঞ্চুরি। নিউ জিল্যান্ডকে হারানোর নায়ক। এরপর সেমি-ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুই উইকেটের সঙ্গে ৪৮ বলে ৬২ রানের নজরকাড়া ইনিংসে আবার ম্যাচ সেরা। ফাইনালের গল্পটা তো একেবারে তরতাজা। ১১ মিটার দৌড়ে যে ক্যাচ নিয়েছেন তাতেই মিলেছে ১১ কিলোগ্রামের ট্রফি। যে ট্রফির জন্য শেষ ৪৭ দিন মহারণে নেমেছিল দশ দল। শেষ হাসিটা হেসেছে হেডের অস্ট্রেলিয়া।

ম্যাচ শেষে ওই ক্যাচ নিয়ে হেড বলেছেন, ‘রোহিত খুব সম্ভবত এই দুনিয়ার সবচেয়ে আনলাকি কেউ। ক্যাচটা সত্যিই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা ফিল্ডিং নিয়ে প্রচুর কাজ করেছি এটা প্রকাশ পেয়েছে মাঠে।’ 

ম্যাচ শেষে ম্যাচ বিশ্লেষণে সুনীল গাভাস্কার বলেছেন,‘নিশ্চিতভাবেই ওই ক্যাচটা ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। হেডকে কৃতিত্ব দিতে হবে। গুড রানিং ক্যাচ। তবে রোহিত ওই সময়ে শটটা না খেললেও পারতো। আগের দুই বলে ছক্কা চার চলে এসেছিল।’

সঞ্জয় মাঞ্জারেকারের কণ্ঠেও ছিল এক সুর, ‘হেড দুর্দান্ত ক্যাচ নিয়েছে। রোহিত তখন অল অ্যাটাকেও। ওই সময়ে সুযোগ আসবে জানা ছিল। কিন্তু ক্যাচটা কঠিন ছিল। যেভাকে পেছনে ফিরে দৌড়ে গিয়ে বল ওর হাতে জমিয়েছে…অবিশ্বাস্য।’ 

অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিংয়ে এমন রুদ্ররূপ দেখা মিলেছে সেমি-ফাইনাল থেকে। সেদিনও বৃত্তের ভেতরে ও সীমানায় দারুণ সব ফিল্ডিংয়ে ম্যাচ নিজেদের নাগালে রেখেছিল। গতকালও আহমেদাবাদে সেই একই কাজের পুনরাবৃত্তি। অধিনায়ক প্যাট কামিন্স সেই কথাই বললেন, ‘শেষ সপ্তাহে এটা (ফিল্ডিং) শুরু হয়েছিল। ছেলেরা ছিল দুর্দান্ত। আমাদের দলে বেশিরভাগের বয়স হয়েছে। কিন্তু মাঠে নেমে নিজেদের সেরাটা নিংড়ে দিয়েছে।’

শুরুর কথাতেই শেষ করা যায়। ক্যাচেস উইন ম্যাচেস। শুধু ম্যাচেস নয়। ক্যাচেস উইন এভরিথিং।

আহমেদাবাদ/ইয়াসিন/বিজয়

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়