চাইলে এভাবেও টেস্ট খেলা যায়!
অফসাইড উন্মুক্ত করে রেখেছিলেন মিরাজ। কিন্তু যে পরিকল্পনায় ফিল্ডিং সাজিয়েছিলেন সেভাবে পারেননি বল ফেলতে। তার অফস্টাম্পের বাইরের শর্ট বল পেছনের পায়ে ভর করে ড্রাইভে চার মারেন নিউ জিল্যান্ডের ব্যাটসম্যান গ্লেন ফিলিপস। দিনের প্রথম চার ব্যাট থেকে।
কিউই ক্রিকেটার গত পরশু শেষ বিকেলে চার মেরে রানের খাতা খুলেছিলেন। পরশু মানে পরশু! গতকাল পুরো দিন গিলে খেয়েছে বেরসিক বৃষ্টি। আজ সকালে বৃষ্টি হলেও তেমন ভোগাতে পারেনি। কিন্তু ভুগিয়েছে মাঠ। পাক্কা একদিন পর সূর্যের দেখা মিলে। মাঠ ভেজা থাকায় বৃষ্টি থামার পর খেলা শুরু করা যায়নি। সূর্য যখন মধ্যগগনে, দুপুর ১২টায় তখন মিরপুরে প্রথম বল মাঠে গড়ায়।
নিউ জিল্যান্ডের স্কোর তখন ৫৫/৫। সেখান থেকে ১১০ মিনিটের লড়াই শেষে অতিথিদের রান ১৮০/১০। বাংলাদেশের বিপক্ষে তাদের লিড ৮ রানের। যার কৃতিত্ব ওই ফিলিপসের। ৭২ বলে ৮৭ রানের ঝকঝকে ইনিংসে ডানহাতি ব্যাটসম্যান নিজের দ্বিতীয় টেস্ট রাঙিয়েছেন দারুণভাবে। ১২০.৮৩ স্ট্রাইক রেটে সাজানো ইনিংসটি খেলে ফিলিপস বুঝিয়ে দিয়েছেন, টেস্ট ক্রিকেটটাও চাইলে এভাবে খেলা যায়।
বলা হয়, টেস্ট ক্রিকেট ধৈর্য্যের খেলা। টেস্ট ক্রিকেট শান্তদের খেলা। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিতে পরিস্থিতি এমন যে, টেস্ট ক্রিকেট হয়ে গেছে যেমন খুশি তেমন সাজোর মতো। উইকেট, কন্ডিশন বিবেচনায় পাল্টাতে হয় খেলার ধরণ। কখনো তা প্রবল আক্রমণাত্মক, কখনো তা শান্ত স্থির। কখনো তা মারমার কাটকাট। কখনো তা বলের পর বল ঠেকিয়ে যাওয়া। ফিলিপসের আজকের ৮৭ রানের ইনিংসটি আক্রমণাত্মক, মারমার কাটকাট, আগ্রাসী মনোভাবের ভিতের ওপর দাঁড়ানো।
তার সহজাত ব্যাটিংয়ের ধরণই এমন। কম বল খেলে দ্রুত রান তোলা। উইকেটের চারিপাশে চার-ছয়ে পসরা সাজানো। কুইক ব্যাটস্পিডে প্রতি আক্রমণে যাওয়া পছন্দ তার। মিরপুরের ২২ গজে যেমন চাহিদা ছিল, তেমন যোগানই দিয়েছেন তিনি। উইকেটে যতক্ষণ ফিলিপস ছিলেন ততক্ষণ ছড়িয়েছেন মুগ্ধতা। এমন উইকেটে সময় নিয়ে থিতু হওয়া কঠিন। আবার রান না তুলে টিকে থাকাও কঠিন। প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হয়ে, বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে রান তুলে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায়। সেই কাজটাই ফিলিপস করেছেন অনায়েসে। শরীরের জোর আছেই। সঙ্গে ক্রিকেটের ব্যাকরণ মেনে সব শট। তাতেই তার রান ছুটেছে ঝড়ো গতিতে।
তাইজুল, মিরাজ, নাঈমদের লেন্থ বল ড্রাইভ করেছেন অনায়েসে। স্পিনের বিরুদ্ধে বল সীমানার বাইরেও পাঠিয়েছেন দৃষ্টিনন্দন শটে। কোনো জড়তা যেমন ছিল না, ঠিক তেমনি মিশে ছিল দায়িত্ববোধ। দলকে লিড দেওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা। ফিলিপস সেই কাজটা ভালোভাবে করেছেন। কিন্তু তিন অঙ্ক ছুঁয়ে দেখা হয়নি তার। পেসার শরিফুল ইসলামের রিভার্স সুইংয়ে বড় শট খেলতে গিয়ে টাইমিং মিস করেন। বল তার ব্যাটে চুমু খেয়ে যায় উইকেটের পেছনে সোহানের নির্ভার গ্লাভসে। দলীয় ১৮০ রানে ফিলিপস আউটের পর নিউ জিল্যান্ডের রান আর বাড়েনি। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে টিম সাউদি তাইজুলের বলে মিরাজের হাতে ক্যাচ দিলে ওই রানে থামে নিউ জিল্যান্ডের রান। তাতে ৮ রানের লিড পায় সফরকারীরা।
ফিলিপস এই সাফল্যের রূপকার। মিরাজকে স্কয়ার লেগ দিয়ে ছক্কা উড়িয়ে হাত খোলা শুরু করেন তিনি। অফস্পিনারের হাওয়ায় ভাসানো বল টাইমিং মিলিয়ে শট খেলতে কোনো ঝামেলাই হয়নি তার। এরপর নাঈম হাসানকে স্লগ সুইপে একই জায়গা দিয়ে উড়ান ছক্কা। মাঝে সঙ্গী ড্যারিল মিচেলকে হারান ফিলিপস। কিন্তু তাকে দমিয়ে রাখতে পারেননি বাংলাদেশের কোনো বোলার। ৩৮ বলে তুলে নেন ফিফটি। এরপর চার-ছক্কার সমারোহে ছুটতে থাকেন তিন অঙ্কের ঘরের দিকে। মুমিনুল হককে ইনসাইড আউট শটে কভারের ওপর দিয়ে যে ছক্কাটি হাঁকিয়েছিলেন তা চোখে লেগেছে সবার। দলকে লিড দিয়ে, দর্শকদের আনন্দময় ইনিংস দিয়ে ফিলিপস ড্রেসিংরুমে ফেরেন এক আকাশ আক্ষেপ নিয়ে। প্রথম টেস্ট শতকের খুব কাছে গিয়েও ১৩ রানের আক্ষেপে পুড়তে হয়।
নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের বিস্ময়বালক হয়ে ফিলিপসের আগমণ হয়েছিল। ২০১৭ সালে তার ঘরোয়া ক্রিকেট শুরু হয় বিস্ময় ছড়িয়ে। প্রথম কিউই ব্যাটসম্যান হিসেবে এক মৌসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, লিস্ট-এ ক্রিকেট (ফোর্ড ট্রফি) ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করেছিলেন। তাই জাতীয় দলে তার ঢুকতে সময় লাগেনি। নিজের সামর্থ্যের দারুণ প্রমাণ দিয়ে থিতু হয়েছেন তিন ফরম্যাটেই। এখন কেবল তার সামনে এগিয়ে যাওয়া। মনে হচ্ছিল আজই প্রথম তিন অঙ্ক ছুঁয়ে ফেলবেন। কিন্তু আউট হওয়া বলে মনোযোগ সরে যাওয়ায় বিপত্তি ঘটে। মনোযোগ সরে যাওয়ার কারণ নিজের নয়। শরিফুল যখন বোলিং করছিলেন তখন সাইট স্ক্রিনের সামনে দিয়ে প্রোডাকশনের একজন হেঁটে যাচ্ছিলেন। তাতে রিফ্লেক্ট হয়। এমন মুহূর্তে ওই ঘটনা ঘটে ফিলিপস শট না খেলে সরে যেতে পারেননি। অনাকাঙ্খিত ঘটনায় অবশ্য কোনো অভিযোগ নেই তার।
দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘শরিফুল যখন বোলিংয়ের শেষ প্রান্তে ছিল, একেবারেই শেষ সেকেন্ডে সাইট স্ক্রিনের সামনে কেউ হেঁটে গিয়েছে। আমার সরে আসা উচিৎ ছিল। মাথায় কাজও করছিল। কিন্তু মনে হয়েছে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। বলটা আমি দেখতে পাইনি এবং সরে যেতে পারিনি।’
১১৭ মিনিটের দৃষ্টিনন্দন ইনিংসের পেছনের গল্প জানাতে গিয়ে ফিলিপস বলেছেন, ‘আমার চেষ্টা ছিল যতটা সম্ভব ব্যাটিং করা এবং আমার শটগুলো ঠিকঠাক টাইমিং করা। ওরা খুবই ভালো বল করেছে। সঙ্গে চেষ্টা ছিল ওদের ভালো বলগুলোকেও যেন শাসন করতে পারি। তাতে যেটা হয়, কিছুটা হলেও বোলাররা ব্যাকফুটে চলে যায়। নিজের এই পরিকল্পনায় আমি স্থির থাকার চেষ্টা করেছি। নিজেকে শান্ত ও স্থির রেখে শট খেলার চেষ্টা করেছি। খুব বেশি বল ছাড়তে চাইনি। কিছু বল ডিফেন্ড করেছি। কিছু শট খেলেছি। আমি যেসব জায়গায় বেশ শক্তিশালী, যেসব জায়গাতে বল পেলে শট খেলেছি। লেন্থ বলের অপেক্ষো করেছি। যা আমার স্কোরকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।’
মিরপুরের মন্থর উইকেটে বোলারদের ওপর চড়াও হওয়া কঠিন। ফিলিপস স্রোতের বিপরীতে গিয়ে নিজের খোলসে থেকে শক্তির জায়গায় স্থির থেকে আক্রমণে গিয়েছেন। তাতে ফল পেয়েছেন। সঙ্গে বুঝিয়ে দিয়েছেন, চাইলে টেস্ট এভাবেও খেলা যায়।
ঢাকা/আমিনুল