ডাক্ট টেপ, রহস্যময় ট্যাবলেট এবং শ্যাম্পেন বোতল: জোসেফের রূপকথার ভেতরের গল্প
স্থান: ব্রিসবেনের ওয়েস্ট ইন্ডিজের টিম হোটেল
সময়: রোববার ভোর
শামার জোসেফ বেডরুমে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে গ্যাবায় অস্ট্রেলিয়ার পেসার মিচেল স্টার্কের পায়ের টো-এর ওপর করা ভয়ংকর ইয়র্কারে রিটায়ার্ড হার্ট হন জোসেফ। তার ডানপায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। সতীর্থ অভিষিক্ত কেভিন সিনক্লিয়ার ও দলের মেডিকেল বিভাগের একজনের কাঁধে চড়ে জোসেফ মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যান।
স্ক্যান করানোর পর জানা যায়, তার আঙুলে কোনো চিড় ধরা পড়েনি। তাই হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় তাকে। ভোর ৪টা পর্যন্ত ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন জোসেফ। বিছানার এদিক সেদিক ঘুরেও কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না। ২৫ বছর বয়সী শামার ম্যাচে আর নামতে পারবেন না তা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন।
ব্রেকফাস্ট টেবিলেও জোসেফ ছিলেন অনুপস্থিত। দিবারাত্রির টেস্টে দল মাঠ ছাড়বে দুপুরের ঠিক আগে। তখন হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফিজিওথেরাপিস্ট ডঃ ডেনিস বিয়াম সকাল ১১টা ৩০ মিনিটে ফোন দিয়ে বলেন, ‘ব্রো, তোমাকে আমি মাঠে দেখতে চাই।’ শামার জানিয়ে দেন, খেলার কোনো অবস্থাতেই নেই তিনি। তবে দলকে অনুপ্রাণিত করতে মাঠে যেতে পারেন।
স্থান: ব্রিসবেনের গ্যাবা স্টেডিয়াম
সময়: রোববার মধ্য দুপুর
গ্যাবায় জোসেফ পৌঁছান ট্রেনিং কিটে। সঙ্গে ছিল না তার ব্যাগ, কিট, কেডস কিছুই। মাঠে পৌঁছার পর ড্রেসিংরুমে দলের অধিনায়ক ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েস্ট জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি প্রস্তুত?’। অধিনায়কের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়েন জোসেফ। মাঠে নামার কোনো অবস্থাতেই নেই তিনি। মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছেন। সঙ্গে খেলার সব জিনিস রেখে এসেছেন হোটেল রুমে।
তখন দলের মিডিয়াম ম্যানেজার ডারিও ব্রাথলে জোসেফের জন্য ম্যাচ জার্সি খুঁজে বের করা শুরু করেন। ম্যাচ শেষে ড্রেসিংরুমের ঘটনাগুলো মনে করে শামার বলেন,‘ড্রেসিংরুমে কিসের থেকে কি হয়ে যাচ্ছিল আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি এটা নিয়ে কথা বলতে চাই না (হাসি)। আমার কাছে মাত্র এক জোড়া জুতা ছিল। আমার নিজের বক্সার আর মাথার টুপি। আর কিছু নয়। অথচ আমাকে বলা হচ্ছে তুমি একটু পর মাঠে নামতে যাচ্ছো। আমার পোশাক আনানোর ব্যবস্থা করছে তারা।’
ওদিকে দলের ফিজিওথেরাপিস্ট ডঃ ডেনিস বিয়াম ব্যস্ত জোসেফকে প্রস্তুত করতে। আগের রাতের ব্যান্ডেজ খুলে তা পরিস্কার করে নতুন করে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছিলেন। সঙ্গে দেন ট্যাবলেট। কি ট্যাবলেট তা জানা নেই, ‘ও আমাকে কি খাইয়েছিল তা আমিও জানি না। তবে এটা কাজ করেছিল।’
জোসেফের বদলি খেলোয়াড় জাচারি ম্যাককাস্কির ম্যাচ জার্সি নিয়ে চলে যান মাঠে। আউটফিল্ডে নেমে প্রস্তুত হতে থাকেন ম্যাচে নামতে। কিন্তু ওখানে বিপত্তি দেখা যায়, গায়ানার ক্রিকেটারকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ম্যাচ শুরু হলে তিনি নামতে পারবেন না কারণ ভুল নাম ও জার্সি নাম্বার থাকায়। শামার আবার ফিরে যান ড্রেসিংরুমে। সেখানে ম্যাককাঙ্কির নাম ও ৯৫ জার্সি নাম্বার সাদা ডাক্ট টেপ দিয়ে ঢেকে দেন। এরপরই তাকে মাঠে নামার অনুমতি দেওয়া হয়।
সতীর্থকে মাঠে নামতে দেখে এবার ব্র্যাথওয়েটের আবার জিজ্ঞাসা, এখন কেমন অনুভব করছো?
জোসেফ বলেন, ‘এখন ভালো আছি।’
ব্র্যাথওয়েট আবার জিজ্ঞেস করেন, তুমি নিশ্চিত তো?
অধিনায়কের চোখের দিকে তাকিয়ে জোসেফ বলেন, ‘আমি আজ ফিরে আসছি না। যা কিছুই মাঠে হয়ে যাক। আমি আজ ফিরছি না।’
গ্যাবায় চতুর্থ দিনের খেলা শুরু হলো। বাউন্ডারিতে ফিল্ডিং করতে থাকা জোসেফের শুশ্রূষা তখনও চলছে। বিয়াম তাকে আরো দুটি ট্যাবলেট দেন। তখনও তার ব্যথা তাকে ভোগাচ্ছিলেন। ওই সময়কার পরিস্থিতি নিয়ে জোসেফ বলেন, ‘খুব কষ্ট হচ্ছিল। এক পর্যায়ে রক্তও ঝরছিল।’
স্থান: ব্রিসবেনের গ্যাবা স্টেডিয়াম
সময়: রোববার দুপুর পেরিয়ে বিকেল
অবশেষে জার্সি এলো জোসেফের। পেছনে তার নাম। জার্সি নাম্বার ৭০ লেখা। এবার বল হাতে পেলেন। ২৯তম ওভারে তার হাতে বল তুলে দেন অধিনায়ক ব্র্যাথওয়েট। কিন্তু প্রথম দশ বলে তিন বাউন্ডারি হজম করেন। ২১৬ রানের টার্গেটে ব্যাটিং করে অস্ট্রেলিয়ার রান তখন ২ উইকেটে ১১৫।
অধিনায়কের পূর্ণ ভরসা ছিল জোসেফের বোলিংয়ে। তাইতো মিড অফ থেকে চেঁচিয়ে তাকে অনুপ্রাণিত করেন এভাবে, ‘বন্ধু বল করে যাও। বল করে যাও।’
এগারতম বল থেকেই রূপকথার গল্পের শুরু। জোসেফ উইকেট থেকে বাড়তি বাউন্স আদায় করে নেন। বল ক্যামেরন গ্রিনের কনুইয়ে লেগে স্টাম্পে আঘাত করে। ডানহাতি পেসারের প্রথম উইকেট। পরের বলটা হয়তো এ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ডেলিভারী। রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে দুর্দান্ত এক ইয়র্কার। বল একেবারে টো এন্ডে পড়ে আঘাত করে স্টাম্পে। পরপর দুই বলে উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়া শিবিরে কাঁপন ধরান। তবে হ্যাটট্রিকটা পাওয়া হয়নি তার। স্মিথ তার বল রুখে দেন।
এরপর আর থামানো যায়নি জোসেফকে। একে এক তুলে নেন আরো পাঁচ উইকেট। ব্যাস, তাতে পেয়ে গেলেন অমরত্বের স্বীকৃতি। গ্যাবায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৭ বছর পর হারায় অস্ট্রেলিয়াকে। ম্যাচের নায়ক জোসেফ বল হাতে নেন ৭ উইকেট।
গোধূলী লগ্নে ওয়েস্ট ইন্ডিজ উড়ায় বিজয়ের পতাকা। জোসেফের দ্রুত গতির বলে উইকেট হারান জস হ্যাজেলউড। স্টাম্পে বল আঘাতের পরপরই আনন্দের দৌড়। গ্যাবার সুবজ ঘাসে ছুটছেন জোসেফ। পেছনে দলের সবাই। ধ্রুপদী এক মুহুর্ত। যে মুহূর্তে আনন্দে ভাসায়, গর্ব করতে বাধ্য করে। ম্যাচ শেষে নিজের হাল না ছাড়ার গল্প শোনাতে গিয়ে জোসেফ যোগ করেন, ‘শেষ উইকেটের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমি বল ছাড়ছি না এমন পণ করেছিলাম।’ আর ম্যাচ জয়ের মুহূর্তের কথা শোনাতে গিয়ে বলেন, ‘আমার কিছু মনে নেই। আমি যতটা জোরে ছুটতে পারি সেই কাজটাই করছিলাম। আনন্দের দৌড়।’
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের অত্যন্ত ছোট গ্রাম বারাকারা। নিউ আমস্ট্রারডাম থেকে যেখানে যেতে হয় কেবল নৌকায়। সময় লাগে ২ দিন। যে গ্রামে জনসংখ্যা কেবল ৩৫০ জনের মতো। আর ইন্টারনেট সেখানে পৌঁছায় ২০১৮ সালে। ওখানে বড় হয়ে শহরে এসে চাকরি খুঁজে দিনযাপন চলতো জোসেফের। সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করতেন ১২ ঘণ্টা। ছোট বেলায় ক্রিকেট বল পাননি। খেলতেন কেবল কমলালেবু আর লেবু দিয়ে। বড় হয়ে যখন ক্রিকেট বল পান তখন সময় পেরিয়ে যায় অনেক। কিন্তু হাল না ছেড়ে ক্রিকেট বলেই নিজের ভবিষ্যৎ খুঁজে পান।
কষ্টার্জিত জীবনে নানা অলিগলি পেরিয়ে গ্যাবায় জোসেফ যে রূপকথার গল্প রচনা করেছেন তা সমকাল পেরিয়ে মহাকালে অক্ষয় কালিতে লেখা থাকবে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে যে সম্মান পেয়েছেন তা ইতিহাসের পাতায় লেখা রইবে অনন্তকাল।
৬৮ রানে ৭ উইকেট। গ্যাবায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলোয়াড়দের মধ্যে সেরা পারফরম্যান্স। তার এমন মহাকাব্যিক পারফরম্যান্সে চোখে জল এনেছে ব্রায়ান লারা, কার্ল হুপারের। তারা দুজনই ছিলেন ধারাভাষ্য কক্ষে। সারা বিশ্ব থেকে জোসেফ পাচ্ছেন অভিনন্দন বার্তা।
সপ্তাহখানেক আগে টেস্ট অভিষেকে প্রথম বলে উইকেট নিয়েছিলেন জোসেফ। আউট করেছিলেন স্টিভেন স্মিথকে। সেই স্মিথকে উইকেটের আরেকপাশে রেখে ৮ রানে জয় এনে দেন তিনি। ম্যাচ থেকে কতকিছুই তো হয়েছে। সবচেয়ে বড় পুরস্কারটা সংবাদ সম্মেলনে হয়তো পেয়েছেন জোসেফ।
ব্রিসবেনের সাংবাদিকরা পেশাদারিত্ব ভুলে জোসেফ ও ব্রাথওয়েটকে করতালিকে স্বাগত জানান। লারা সেই এক রুমের পেছনে দাঁড়িয়ে কথা শুনেছেন। নিজের মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করেছেন।
খেলার মাঠে মন জয় করার পাশাপাশি জোসেফ হৃদয় জিতেছেন সংবাদ সম্মেলনে। ক্যারিবীয়ান ক্রিকেট তারকা মানেই এখন ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে ছোটাছুটি। দেশের খেলা বাদ দিয়ে চলে যান টি-টোয়েন্টি খেলতে। এই দলে থাকতে পারতেন কাইল মায়ার্স ও জেসন হোল্ডার। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকায় টি-টোয়েন্টি খেলে বেড়াচ্ছেন।
জোসেফও সুযোগ পাবেন এমন মঞ্চে। তখন কি করবেন? উত্তরটা শোনা যাক তার কণ্ঠে, ‘এটা আমার স্বপ্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টেস্ট খেলতে পারা। আমি বলতে ভীত নই যে, আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সারা বছর টেস্ট খেলার জন্য প্রস্তুত থাকব, আমার দিকে যত টাকাই আসুক না কেন। আমি এখানে টেস্ট খেলার জন্যই এসেছি।’
এমন কথা শোনার পর লারা মুখে হাসি দিয়ে পেছন থেকে তালি দেন। সংবাদ সম্মেলনের পর জোসেফের সঙ্গে ছবি তোলার হিড়িক পড়ে যায়। যেখানে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন লারাও।
কয়েক মিনিট পর, জোসেফ, ব্র্যাথওয়েট এবং লারা দুই বোতল ‘মোয়েট অ্যান্ড চন্দন’ শ্যাম্পেন হাতে নিয়ে ড্রেসিংরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। বাকি উদযাপনটা সেখানেই।
ঢাকা/ইয়াসিন/বিজয়