তাওহীদের হৃদয় জেতা ‘১০৮’
ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম
দীর্ঘদেহী পেসার মোহাম্মদ ইরফানের লেন্থ বল উড়িয়ে মারলেন তাওহীদ হৃদয়। মিড উইকেটে বল পাঠিয়ে প্রান্ত বদল করতেই স্টেডিয়ামে বেজে উঠল, ‘কে আছো আমাদের সামনে দাঁড়াবার, জেগেছি আমরা এবার…আছে কে ব্যাটে-বলে আমাদের হারাবে, জিতবো আমরা এবার।’
দুর্দান্ত ঢাকার দেওয়া ১৭৬ রানের লক্ষ্য ১ বল আগে ছুঁয়ে ফেলল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। তাদের থিম সংয়ের মতোই বিজয় উল্লাস শুরু হয়ে যায় মিরপুরের গ্যালারিতে।
আসলে গানের লিরিক্সগুলো যদি এমন হতো মন্দ হতো কী? ‘কে আছো তাওহীদের সামনে দাঁড়াবার, জেগেছে তাওহীদ এবার…আছে কে তাকে বল করে আউট করবে, সেঞ্চুরি করবে তাওহীদ এবার’…নিশ্চয়ই মন্দ হতো না।
শুক্রবার ছুটির দিনে মিরপুর শের-ই-বাংলায় উপস্থিত হওয়া ১৫ হাজার দর্শকদের তাওহীদ যে বিনোদন দিয়েছেন তাতে লিরিক্স পাল্টালেও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স মন খারাপ করবে না। কেন না তাওহীদ হৃদয় জেতা এক সেঞ্চুরিতে তাদের উল্লাসে ভাসিয়েছেন। ৫৭ বলে অপরাজিত ১০৮ রান। ৮ চারের সঙ্গে ৭ ছক্কা।
ঢাকার বোলারদের একা শাসন করে তাওহীদ বুঝিয়ে দিয়েছেন কেন তাকে এবার কোটি টাকারও বেশি পারিশ্রমিকে কুমিল্লা সিলেট স্ট্রাইকার্স থেকে ‘ছিনিয়ে’ নিয়েছে।
বিপিএল শুরুর প্রায় চার মাস আগে কুমিল্লা তাওহীদকে পেতে আগ্রহ প্রকাশ করে। প্লেয়ার্স ড্রাফটের বাইরে সরাসরি চুক্তিতে খেলোয়াড় নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কুমিল্লা যখন তাওহীদকে প্রস্তাব দেয় তখন সিলেট স্ট্রাইকার্স তাকে ধরে রাখার চেষ্টাও করে।
বিপিএলের গত আসরে সিলেটের হয়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করে জাতীয় দলে সুযোগ পান তাওহীদ। তাই সিলেটের প্রতি আলাদা টান ছিল তার। কিন্তু কুমিল্লার প্রস্তাব এতোটাই বড় ছিল যে, তাওহীদের না করার কারণ ছিল না। কুমিল্লা পেয়ে যায় ‘কোটি টাকার’ তাওহীদকে।
বিপিএলের শুরু থেকে তাওহীদের ব্যাটে তেমন রান ছিল না। ৪৭, ০, ৯। নামের পাশে বড্ড বেমানান। চতুর্থ ম্যাচে রংপুরের বিপক্ষে ২৮ বলে ৩৯ রান করেও দলকে জেতাতে পারেননি। পরের ম্যাচে ১৩ বলে ৩১ রানের ঝড়ে চেনা রূপে ফেরার আভাস দেন। কিন্তু ঢাকায় বিপিএল ফিরলে তার ব্যাট আবার বিবর্ণ। খুলনার বিপক্ষে ১৬ রানে শেষ তার ইনিংস। সব সমীকরণ পাল্টে গেল শুক্রবার ঢাকার বিপক্ষে ম্যাচে। এদিন ২২ গজে লিখা হলো তাওহীদের মহাকাব্য।
সেঞ্চুরি কেবলই এক সংখ্যা। যে সংখ্যা সব ব্যাটসম্যানরাই ছুঁতে যান। তাওহীদও তাদেরই একজন। স্বীকৃত টি-টোয়েন্টিতে প্রথমবার সেঞ্চুরি ছোঁয়ার আনন্দ তার চোখে মুখে পাওয়া গেল। তাসকিনের বল মিড উইকেটে পাঠিয়ে ২ রান নিয়ে ৯৮ থেকে সেঞ্চুরিতে পৌঁছান। ব্যাট নিয়েই তার উদযাপন। এরপর হেলমেট খুলে গগনবিদারী চিৎকার। এরপর সিজদাহ করে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন।
বিপিএলের প্রথম ম্যাচে উপরের দিকে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর কম্বিনেশনের কারণে নিচে নামতে হয়েছে তার। আজ তিনে নেমে দেখলেন বড় কিছু করার সুযোগ আছে। সেই সুযোগ লুফে নিয়ে নিজেকে প্রমাণ করে বেশ আনন্দিত এই সেঞ্চুরিয়ান, ‘প্রতিটি ব্যাটসম্যানের ইচ্ছা থাকে সেঞ্চুরি করার। এর আগে প্রথম ম্যাচে উপরে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছিলাম। আজ আবার হঠাৎ করেই উপরে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছি। শেষ বছর আমি উপরেই ব্যাটিং করেছি। মাঝখানে খেলাটা এরকম। উপরে আরেক রকম। আমি চেষ্টা করেছি সুযোগটা কাজে লাগাতে এবং প্রমাণ করার সুযোগ ছিল।’
তাওহীদ যখন ক্রিজে গিয়েছিলেন তখন পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না। ৯ রানে লিটন ফেরেন ড্রেসিংরুমে। পরের দুই ওভারে উইল জ্যাক ও ইমরুলও আউট। ১৭৬ রানের লক্ষ্য তাড়ায় কুমিল্লার রান তখন ৩ উইকেটে ২৩। সেখান থেকে তাওহীদ দলকে টেনে তোলেন। প্রতি আক্রমণে গিয়ে জবাব দেন। এরপর বোলিং আক্রমণ ভেঙে চূরে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন। সব যেন হয়েছেন চোখের নিমিষেই, তাওহীদের পরিকল্পনাতেই।
‘প্রতিটি ব্যাটসম্যানের স্বপ্ন যে একটা সেঞ্চুরি করবে। শেষ বছর সুযোগ ছিল করতে পারিনি। প্রতিটি ব্যাটসম্যানের জন্য এরকম একটা সেঞ্চুরি গুরুত্বপূর্ণ। শুরুতে আমরা ৩টি উইকেট হারিয়েছি। কিন্তু লক্ষ্য ছিল ১৭০ এর বেশি (১৭৬) । আমার পরিকল্পনা ছিল শুরু থেকে আক্রমণাত্মক খেলার। ওখানে গিয়ে ২-৩ ওভার ব্যাকফুটে যাওয়া…উইকেট যেটা চলে গেছে সেটা আমার হাতে নেই। আমি আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছি।’
ইনিংস বড় করতে ও লক্ষ্য ছুঁতে তার যে পরিকল্পনা ছিল তা স্পষ্ট বোঝা গেছে বোলিং। কোন বোলারকে টার্গেট করবেন, বাউন্ডারি ওভার বাউন্ডারি না পেলে ডাবলসে রানের চাকা সচল রাখা এবং ডট কম কম দেওয়া ছিল তার পরিকল্পনার অংশ। ১৪তম ওভার শেষে কুমিল্লার লক্ষ্য যখন ৩৬ বলে ৬৮ তখন ঢাকা বোলিংয়ে আনে সাইফ হাসানকে। অফ স্পিনারকে দেখেই তাওহীদের মুখে হাসি ফুটে যায়।
প্রথম বলে রেইফার সিঙ্গেল নিয়ে তাকে ব্যাটিং দিলে ওভারে তিনটি ছক্কা হাঁকান। ২০ রান তুলে লক্ষ্য ৪৮ এ নামিয়ে আনেন। আক্রমণের সেই ধারা পরিবর্তে ধরে রেখে নিজে সেঞ্চুরি তুলে নেন। এরপর দলকে জেতান। ‘আমি বল খুঁজছিলাম আমার জোনে। আমি চেষ্টা করছিলাম একটা বড় ওভারের। আমি সেট ব্যাটসম্যান ছিলাম। আমার সুযোগ নিতেই হতো। তাহলে আমার দল এগিয়ে যাবে। ম্যাচ নিজেদের কাছে আনার সুযোগ থাকবে। আমি ওই পরিকল্পনা করেই এগিয়ে ছিলাম।’
‘সত্যি কথা বলতে সেঞ্চুরির জন্য একটুও খেলিনি। নব্বইয়ের পরও সেঞ্চুরি করবো ওরকম চিন্তা মাথায় ছিল না। চেষ্টা করেছি খেলাটা শেষ করবো। রান যেখানে যতই থাকুক না কেন সুযোগ আসলে চেষ্টা করবো বাউন্ডারি বের করার জন্য।’- বলেছেন তাওহীদ।
চার মেরে রানের খাতা খোলা এই সেঞ্চুরিয়ান প্রথম ছক্কা মেরেছেন স্লগ সুইপে। সাইফকে তিনটি ছক্কা মেরেছেন হাঁটু মুড়ে স্লগ করে। তাসকিনকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে লং দিয়ে উড়ানোর পর ফ্লিক করে মিড উইকেট দিয়ে পাঠান গ্যালারিতে। সঙ্গে মাটি কামড়ে ধ্রুপদী বাউন্ডারি তো ছিলই। চোখে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। হৃদয়ে দিয়েছে দোলা। এমন এক ইনিংস খেলে তাওহীদ হয়েছেন কুমিল্লার নায়ক। আর বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের এমন ইনিংস মেরামত করা, ম্যাচ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এগিয়ে যাওয়া ও ম্যাচ শেষ করে আসার যে তীব্র চেষ্টা ছিল তাওহীদের তা রীতিমত বিস্ময়ের। তাওহীদ সেই বিস্ময় ছড়িয়ে হৃদয়ে এঁকে দিয়েছেন ‘১০৮’।
কেআই