ঢাকা     রোববার   ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ৭ ১৪৩১

‘সাগরিকার মত জাতীয় দলে খেলতে চায় সবাই’

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৩:০৯, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
‘সাগরিকার মত জাতীয় দলে খেলতে চায় সবাই’

ঠাকুরগাঁও সদর থেকে প্রায় ৪৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাণীশংকৈল উপজেলা। আর এই উপজেলায় নারীদের জন্য রয়েছে একটি ফুটবল একাডেমি। বিকেল হলেই মেয়েরা সাইকেলে চেপে বা কেউ পায়ে হেঁটে চলে আসে মাঠে। তাদের কারও কারও পরনে ট্র্যাক-স্যুট, জার্সি আর কাঁধে ব্যাগ। কেউ বুট পরছে, কারও আবার খালি পা। অনুশীলনের জন্য মাঠে চিহ্ন (মার্কার) বসানো হয়েছে। এসব চিহ্নের ফাঁকফোকর দিয়ে বল আদান-প্রদান চলছে। আবার কখনো চলছে ফুটবল হাতে মাঠের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত শারীরিক কসরত।

তবে শুরুতে বিষয়টা এত সহজ ছিল না। মেয়েরা ফুটবল খেলবে! গ্রামবাসীর কত কথা, কত কটূক্তি! সেই কটূক্তি পেছনে ফেলে মেয়েদের সাফল্যে এখন গ্রামের মানুষ গর্ব করেন। পাশাপাশি মেয়েদের খেলায় উৎসাহ জোগান। রাঙ্গাটুঙ্গীর মাঠে বিভিন্ন জেলা থেকে নারী দলের খেলোয়াড়েরা এসে প্রীতি ম্যাচ খেলেন। আর বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বজন ও প্রতিবেশীরা মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের মেয়েদের খেলা উপভোগ করেন।

আরো পড়ুন:

সোহাগী, স্বপ্না, সাগরিকা সবাই নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়। অজপাড়াগাঁয়ের একটি একাডেমি থেকে তাঁরা জাতীয় পর্যায়ে জায়গা করে নিয়েছেন। একাডেমির নাম রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি। 

রাণীশংকৈল আবু বক্কর নামে একজন বলেন, ‘এই রাঙ্গাটুঙ্গির মেয়েরা এখন আমাদের গর্ব। আগে গ্রামের লোকজন এটা পছন্দ করত না। এখন ৫ জন নারী ফুটবলার জাতীয় দলে খেলছে। সবাই মেয়েদের খেলতে মাঠে পাঠায় এবং উৎসাহ দিচ্ছে।’

আরেক খেলোয়ারের বাবা নবদি কিসকু বলেন, ‘শুরুতে আমরা কেউ রাজি ছিলাম না যে মেয়েরা কেন ফুটবল খেলবে। তবে এখন মেয়েরা আমাদের নাম উজ্জ্বল করেছে। আমরা এখন মেয়েদের নিয়ে গর্বিত’

নারী ফুটবলার নাজমা আক্তার বলেন, ‘যখন শুরুতে আমরা খেলতে আসি তখন অনেক বাধার মুখে পড়েছি। অনেকজন বলছে মেয়েরা কেন হাফপ্যান্ট পরে মাঠে খেলবে। বাবা-মায়েরা মাঠে আসতে দিত না। এটা ছেলেদের খেলা। এখন আমাদের অনেক মেয়ে জাতীয় দলে খেলছে। তখন থেকে সবাই আমাদের উৎসাহ দিচ্ছে। আমি সাগরিকা আপুর মত বড় খেলোয়াড় হতে চাই।’

সাগরিকার বাবা লিটন আলী বলেন, ‘আমার মেয়ে জাতীয় দলে খেলবে এটা আমি কখনও ভাবিনি। এখন তার নাম সারাদেশ জানে। বাবা হিসাবে আমি অনেক গর্বিত।’

সাগরিকার মা আঙ্জুমারা বেগম বলেন, ‘প্রথমে যখন আমার মেয়ে ফুটবল খেলতে যায় তখন নানান মানুষ নানান কথা বলছে। অনেকে বলছে মেয়ের বিয়ে হবে না। ফুটবল তো ছেলেদের খেলা। এখন আমার মেয়ে জাতীয় দলে খেলে। সবাই আমাদের বাসায় আসে মেয়ের অনেক প্রশংসা করে। অনেক ভাল লাগে।’

রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলত স্থানীয় কিশোর-তরুণেরা। তাদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক তাজুল ইসলাম। ২০১৪ সালের আগস্টে ওই মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করেন স্থানীয় লোকজন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কয়েকজন মেয়েকে ফুটবল নিয়ে ছোটাছুটি করতে দেখেন তাজুল ইসলাম। তখন তার ভাবনায় এল, মেয়েরাও তো ফুটবল খেলতে পারে। খেলা চলাকালে কিশোরীদের ডেকে পরিচিত হলেন। জানালেন তার ভাবনার কথা। প্রস্তাব পেয়ে মেয়েরাও রাজি হয়ে গেল।

পরের দিন শুরু হয় দল গঠনের কাজ। দল গঠনে সহযোগিতার হাত বাড়ান ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যুবক সুগা মুরমু, স্থানীয় জয়নুল আবেদিন ও সেতাউর রহমান। তবে খেলোয়াড় জোগাড় করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়লেন তারা। মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে অভিভাবকদের আপত্তি আছে। মেয়েরা ফুটবল খেলবে, এটা কেমন কথা! তবে এতে তাজুল-সুগারা দমে যাননি। অভিভাবকদের পেছনে লেগে রইলেন। শেষমেশ তাদের অনুরোধে এক এক করে কিশোরীরা মাঠে আসতে শুরু করল। কয়েক দিনের মাথায় ১৫ জনের একটা দল পেয়ে গেলেন তারা। গড়ে উঠল একটি ফুটবল দল। নাম দেওয়া হলো রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি। আর পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন তাজুল ইসলাম নিজেই।

মেয়েদের ফুটবল দল গড়ে উঠলেও খেলোয়াড়দের বুট, জার্সিসহ তেমন কোনো সরঞ্জাম ছিল না। প্রান্তিক পরিবারের মেয়েদের পক্ষে ফুটবলের জন্য বাড়তি টাকা জোগান দেওয়াও ছিল কঠিন। তবে তাজুল ইসলাম দমার পাত্র নন। সাধারণ পোশাক আর খালি পায়েই মেয়েদের অনুশীলন চালাতে লাগলেন। পাশাপাশি চলতে থাকে ক্রীড়া সামগ্রী সংগ্রহের চেষ্টা। খেলার পেছনে খরচ করতে করতে বেতনের টাকা কখন ফুরিয়ে যায়, টেরই পান না তাজুল। একসময় স্থানীয় লোকজনও এগিয়ে আসেন। এরপর থেকে তাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহাবুর রহমান জানান, ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়েরা ফুটবলে এগিয়েছে অনেক। আমি নিজে প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে সাগরিকাসহ অন্যদের খেলা দেখেছি। রাঙ্গাটুঙ্গী ফুটবল একাডেমীর সামনে যেন নতুন আরো খেলোয়াড় তৈরি করতে পারে সেজন্য প্রশাসনের সহযোগিতা সব সময় থাকবে।

ঠাকুরগাঁও/হিমেল/বিজয়

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়