শামীমের ঝড় ম্লান করে বরিশাল ফাইনালে
ক্রীড়া প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম
সাকিব আল হাসান নিজের দ্বিতীয় ওভার করতে এলেন ১৯তম ওভারে। রংপুর রাইডার্সের ইনিংসে ওই ১৯তম ওভারে ম্যাচের রং পাল্টে দিয়েছিল। আর ফরচুন বরিশাল ম্যাচটা নিশ্চিত করে ওই ১৯তম ওভারে। রংপুরের দেওয়া ১৫০ রানের লক্ষ্য ছুঁতে বরিশালের ১২ বলে দরকার ছিল কেবল ৬ রান। প্রথম দুই বলে মিলার ও মুশফিকের ২ রান। তৃতীয় বল মিড উইকেট দিয়ে মিলারের ছক্কা উড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিত হয়ে যায় বরিশালের ফাইনাল।
রংপুরের ইনিংসের চিত্র তিন ভাগে ভাগ করলে দেখা মিলবে তিন রকমের। ১-৬ ওভারে ২৬ রানে ৩ উইকেট। ৭-১৫ ওভারে ৫৭ রানে ৪ উইকেট এবং ১৬-২০ ওভারে ৬৬ রানে শূন্য উইকেট। শুরু ও মধ্যভাগে নুন্যতম লড়াই করতে না পারলেও লেজের ব্যাটিংয়ে বলার মতো পুঁজি পায় তারা। যার কৃত্বিত্ব শামীম হোসেন পাটোয়ারীর। তার ২২ বলে ৫৮ রানের বিধ্বংসী ইনিংসে রংপুর ৭ উইকেটে ১৪৯ রান করে।
ফরচুন বরিশাল শুরুতে হোঁচট খেয়েছিল। কিন্তু বিপর্যয় সামলে মুশফিকের দায়িত্বশীল ৪৭, মায়ার্সের ঝড়ো ২৮ ও মিলারের ২২ রানের ফিনিশিংয়ে ৯ বল আগে ৬ উইকেটের জয় নিশ্চিত করে তারা।
তামিম ও সাকিবের দলের ম্যাচকে ঘিরে আলাদা উন্মাদনা ছিল। সেই উন্মাদনা কতটা তা গ্যালারি দেখলেও বোঝা যাচ্ছিল। খেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই ২৫ হাজার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন স্টেডিয়ামে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। ডিজে গানের তালে তালে সাকিব-তামিমদের ব্যাটিং-বোলিংয়ের সময় গ্যালারি ছিল উন্মাতাল। সঙ্গে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ম্যাচ হওয়ায় দর্শকদের টিকিটের পয়সাও উসুল হয়েছে। খেলা চলাকালীন শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ডে দুই দলের সমর্থকদের মারামারির ঘটনাও ঘটেছিল।
টি-টোয়েন্টিতে খেলার রং পাল্টে যায় এক ওভারে। ম্যাচের মোড় ঘুরে যায়। রংপুরের হয়ে ওই ওভারটা এসেছিল বড্ড দেরিতে। যেখান থেকে তাদের আর ছন্দ ফেরার সুযোগ ছিল না বাঁহাতি পেসার ওবেদ ম্যাকয়ের করা ১৯তম ওভারে শামীম তোলেন ২৬ রান। ওভারের চিত্রটা ছিল এরকম, ৬-০-৪-৬-৬-৪। আর্শীবাদ হয়ে আসা ওই ওভারে স্কোরবোর্ডের চিত্র পাল্টে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু রানটা নাগালেই ছিল। ২০ বলে পঞ্চাশ তুলে নেন শামীম। যা সাকিবের সঙ্গে বিপিএলে যৌথভাবে দ্রুততম। পঞ্চম টি-টোয়েন্টি ফিফটির ইনিংস খেলে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন। ২৪৫.৮৩ স্ট্রাইক রেটে সাজানো ইনিংসে ছিল ৫টি করে চার ও ছক্কা।
লক্ষ্য নাগালে থাকলেও বরিশালের শুরুটা ভালো ছিল না। পেসার আবু হায়দার রনির এক ওভারে তামিম ও মিরাজ ড্রেসিংরুমে ফেরেন। তামিম ১০ ও মিরাজ ৮ রান করেন। দুই দলের শেষ মুখোমুখিতে রনি ১৩ রানে ৫ উইকেট নিয়ে বরিশালকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাঁহাতি পেসারের শুরুর বোলিং দেখে মনে হচ্ছিল তেমন কিছুই হবে। কিন্তু সৌম্য তার এক ওভারে ১৬ রান তুললে রনিও ছন্দ হারিয়ে ফেলেন। বরাবরের মতো সৌম্য ভালো শুরুর পর নিজের উইকেট বিলিয়ে এসেছেন। মোহাম্মদ নবীর বল এগিয়ে এসে উড়াতে গিয়ে স্টাম্পড হন ২২ রানে।
১০ ওভারে ৬৯ রান তুলতে ৩ উইকেট হারায় বরিশাল। শেষ ১০ ওভারে তাদের লক্ষ্য ছিল ৮১। হাতে ৭ উইকেট থাকায় নির্ভার ছিল তারা। ব্যাটিংয়ে সেই প্রভাব দেখা গেল। মায়ার্স নিজের খেলা দ্বিতীয় বল মিড উইকেট দিয়ে পাঠান গ্যালারিতে। চোখের পলকে কব্জির মোচড়ে দুর্দান্ত এক শট। এক ওভার মাহেদীর বল উড়ান লং অন দিয়ে। পরে একটি চারও পান। ১৫তম ওভারে ফজল হক ফারুকিকে কাভারের ওপর দিয়ে যে ছক্কাটি মারেন, সেটা ছিল টুর্নামেন্টের অন্যকম সেরা শট। মায়ার্সের ছোট্ট ক্যামিও তখন রংপুরের হাসি মলিন করে দিচ্ছিল। ঠিক পরের বলে আবার উড়াতে গিয়ে মায়ার্স সীমানায় আটকা পড়েন। তার ১৫ বলে ২৮ রানের ইনিংস দর্শকদের আনন্দে ভাসায়।
ওই সময়ে বরিশালের দরকার ছিল ৩৩ বলে ৩১ রান। মুশফিক ও মিলার জয়ের বাকি কাজ সারেন চোখের পলকে। ৩৮ বলে ৬ চার ও ১ ছক্কায় ৪৭ রানে অপরাজিত থাকেন মুশফিক। ফিনিশার মিলার ১৮ বলে ২২ করেন ২ চার ও ১ ছক্কায়।
এর আগে রংপুরে ইনিংসে যা লড়াই হয়েছে শেষ দিকেই। পাওয়ার প্লে’তে ২৬ রান তুলতে ৩ উইকেট হারায় তারা। ওপেনিং মাহেদীকে পাঠিয়ে বাজি ধরেছিল তারা। কিন্তু সাইফ উদ্দিনকে এগিয়ে এসে উড়াতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। ওই ওভারে সাইফ উদ্দিন সাকিবের উইকেট নিয়ে বরিশালকে উল্লাসে ভাসায়। প্রথমে ইয়র্কারে সাকিবকে বিভ্রান্ত করেন। পরের বল দিয়েছিলেন শর্ট। সাকিব পুল করতে গিয়ে উইকেটে পেছনে ক্যাচ দেন ১ রানে।
রনি তালুকদার পুরো বিপিএলে ছিলেন নিষ্প্রভ। শেষটাও পারেননি রাঙাতে। কাইল মায়ার্সকে পুল করে মিলারের হাতে ক্যাচ দেন ৮ রানে। টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যান পারেননি দুই অঙ্ক ছুঁতে। প্রবল চাপে তখন রংপুর। তাদের আরো চেপে ধরে বরিশাল। দুই বাঁহাতি নিকোলাস পুরান ও জিমি নিশাম ক্রিজে আসায় তামিম অফস্পিনার মিরাজকে বোলিংয়ে আনতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেননি। নিজের প্রথম ওভারেই পেয়ে যান সফলতা। টি-টোয়েন্টির বিগ ফিশ পুরান স্পিনের বিরুদ্ধে বড় শট খেলতে গিয়ে ক্যাচ দেন। লং অন থেকে দৌড়ে এসে মিড অনে ঝাঁপিয়ে দারুণ ক্যাচ নেন সৌম্য। ১২ বলে ৩ রানে থেমে যায় তার ইনিংস।
পরের ওভারের প্রথম বলে ফুলারের বাউন্সারে কুপোকাত নিশাম। আগের ম্যাচে ৯৭ রান করা নিশাম এই ম্যাচেও ভালো শুরু করেছিলেন। ২২ বলে ৪ বাউন্ডারিতে ২৮ রান করে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন। স্কোরবোর্ডে ৪৮ রান তুলতেই রংপুরের ৫ ব্যাটসম্যান নেই। সেখান থেকে তাদের দলীয় রান একশতে পৌঁছানো ছিল দূর আকাশের তারা। কিন্তু লম্বা ব্যাটিং লাইন আপ থাকায় কিছুটা আশা টিকে ছিল। নবী (১২) ও সোহান (১৪) দায়িত্ব না নিলেও আটে নামা শামীম বড় মঞ্চে নিজেকে মেলে ধরেন।
নিয়মিত খেললেও নিজেকে প্রমাণ করতে পারছিলেন না। কিন্তু ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে দায়িত্বশীল ইনিংস উপহার দেন। তাকে সঙ্গ দেওয়া আবু হায়দার রনিও ছিলেন দারুণ। ৩১ বলে তাদের জুটিতে আসে ৭২ রান। দুজনের শেষের লড়াই রংপুরকে আশার আলো দেখিয়েছিল। কিন্তু বরিশালের সামনে ওই পুঁজি যথেষ্ট ছিল না। তাতে প্রত্যাশিত ফলাফলই হয়েছে দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে।
রংপুরের বোলিং এলোমেলো না হলেও বোলারদের জন্য এই পুঁজি যথেষ্ট ছিল না। তবে বিপিএলের ইতিহাসের সেরা বোলার সাকিব নিজের কোটার ওভার শেষ না করায় অবাক হয়েছে অনেকেই। ১১তম ওভারে বোলিং এসে বাঁহাতি স্পিনার ৯ রান দেন। এরপর ম্যাচ যখন হাত থেকে ফসকে গেছে, ১৯তম ওভারে দ্বিতীয় ওভারে আসেন।
ফাইনালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের সঙ্গী হলো ফরচুন বরিশাল। কুমিল্লা নিজেদের পঞ্চম ও হ্যাটট্রিক শিরোপার খোঁজে। বরিশাল প্রথম শিরোপা পাওয়ার অপেক্ষায়। দুই দল এর আগে ২০২২ বিপিএলের ফাইনালে খেলেছিল। যে ম্যাচে কুমিল্লা জিতেছিল মাত্র ১ রানে। এবার পহেলা মার্চের ফাইনালে কি হয় সেটাই দেখার অপেক্ষা।
ইয়াসিন/আমিনুল