ঢাকা     সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৮ ১৪৩১

বরিশালের শিরোপা জয়ের নেপথ্যে

ক্রীড়া প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১০, ২ মার্চ ২০২৪   আপডেট: ১৬:১৫, ২ মার্চ ২০২৪
বরিশালের শিরোপা জয়ের নেপথ্যে

ভিক্টোরি ল্যাপ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তামিম ইকবাল। কোলে মেয়ে আলিশবা খান। ছেলে আরহাম খান তখন জার্সি গায়ে মিরপুরের সবুজ ঘাসে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহরা পরিবারের কাউকে আনেননি। মিরাজের কাঁধে ছেলে মুদ্দাসসির। সৌম্য সরকার প্যাডও খোলেননি। মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহকে পেছন থেকে সামনে এনে দৌড়াতে বললেন তামিম। শুরু হয়ে যায় বিপিএলের দশম আসরের চ্যাম্পিয়ন ফরচুন বরিশালের ভিক্টোরি ল্যাপ। 

গ্রান্ড স্ট্যান্ডে থেকে শুরু করে শহীদ মুশতাক স্ট্যান্ড, ইষ্টার্ন গ্যালারি, ক্লাব হাউজ, শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ড হয়ে বরিশালের ড্রেসিংরুমের কাছে গিয়ে শেষ হয় ল্যাপ। দর্শকরা হাত নেড়ে ‘বরিশাল বরিশাল’ চিৎকার করে ক্রিকেটারদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। ক্রিকেটাররাও তাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন উড়ন্ত চুমু, হাত নাড়িয়ে ফিরিয়েছেন ভালোবাসা। বিপিএলের শুরু থেকে ফাইনাল পর্যন্ত বরিশালের সমর্থকদের উল্লাস, উন্মাদনা, উত্তেজনা ছিল বাধভাঙ্গা। 

যাদের জন্য এই শিরোপা জিতেছেন তামিমরা টুর্নামেন্ট শেষে তাদেরকেই ধন্যবাদ দিয়েছেন অধিনায়ক, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এটা ঠিক… আমি মুগ্ধ, বরিশালের সে পরিমাণ সমর্থক আছে! এটা অবিশ্বাস্য। আমি এরকম (আর দেখিনি)…। সবসময়ই ভেবেছি, কুমিল্লার সমর্থন সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমার মনে হয়, এ বছর বরিশাল তা ছাড়িয়ে গেছে বিশাল ব্যবধানে।’

আরো পড়ুন:

বরিশালকে প্রথম শিরোপা দিতে পেরে তামিম খুশি। তবে শিরোপার পেছনে যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল তাদেরকেও সামনে এনেছেন তিনি। সৌম্য সরকার, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাইজুল ইসলাম প্রত্যেককে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে ট্রফি উৎসর্গ করেছেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই বরিশালের ঘরে গেছে শিরোপা। তবে এই শিরোপার নেপথ্যে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে তা নিয়েও খোলামেলা কথা বলেছেন তামিম। তামিমের মতে, দলের ভেতরের পরিবেশ সুস্থ, সঠিক ছিল বলে বরিশাল পিছিয়ে পড়েও লড়াই করতে পেরেছে। আত্মবিশ্বাস নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছে। ব্যর্থতা ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে পেরেছে। 

তামিম বলেছেন, ‘আমি যখন এই দলটির সঙ্গে যুক্ত হই, আমার শুরুতেই লক্ষ্য ছিল একটা ভালো পরিবেশ তৈরি করা। আমি অনেক দলে খেলেছি। আপনারা যদি আমাদের দলের তরুণ কিংবা সিনিয়র ক্রিকেটারকে জিজ্ঞেস করেন, এই দলের পরিবেশ ছিল অবিশ্বাস্য। এটার জন্য সবার অবদান ছিল দারুণ। বিদেশি ক্রিকেটাররাও মিশে গিয়েছিল দারুণভাবে। আমরা সত্যি বলতে ভাগ্যবান যে এমন বিদেশি খেলোয়াড় পেয়েছি। তারা শুধু ভালো খেলোয়াড়রই নন, তারা ভালো মানুষও। ভালো খেলার জন্য এই পরিবেশটা তৈরি করা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’

প্লে অফে চতুর্থ দল হিসেবে নাম লেখায় বরিশাল। সেখান থেকে প্রথমে এলিমিনেটরে চট্টগ্রামকে বিদায় করে। এরপর দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে রংপুরকে উড়িয়ে দেয়। সবশেষ কুমিল্লাকে দাঁড়াতে দেয়নি তামিমের দল। অথচ একটা সময়ে তাদের শেষ চারে উঠা ছিল অনিশ্চিত। 

ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পও শোনালের বরিশালের অধিনায়ক , ‘একটা সময় কিন্তু প্রায় প্রত্যেকে এবং আমরাও সন্দেহে ছিলাম সেমি-ফাইনাল (প্লে অফ) কোয়ালিফাই করবো কী করবো না। শুধুমাত্র দলের ক্রিকেটারদের বিশ্বাস ও পরিবেশের কারণে আমরা এটা করতে পেরেছি। আর দলের মালিক যিনি আছেন তার ক্রিকেট নিয়ে জিরো ইনভলমেন্ট ছিল। উনি শুধু টাকা দেওয়ার কাজটাই করেছেন। আমরা তাকে ওইটা ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।’

শিরোপা জয়ের রাতে সাইফ উদ্দিনকে নিয়ে আলাদা করে কথা বলেছেন তামিম। যাকে প্লেয়ার্স ড্রাফট থেকে যখন নেওয়া হয়েছিল তখন ইনজুরিতে ছিল। বিপিএলের সময় তাকে পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে ছিল ধোঁয়াশা। কিন্তু বিপিএলের মাঝপথে দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে সব হিসেব পাল্টে দেন পেস অলরাউন্ডার।

সাইফউদ্দিনকে নিয়ে তামিম বলেন,‘সাইফউদ্দিনের অন্তভূক্তি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা শিরোপা জিতেছি। কিন্তু বোলিংয়ে ওর ওভারটা যদি দেখেন, অবিশ্বাস্য। ওখানে যদি ১৫ রান হয়ে যেত তাহলে ১৭০ রান করা লাগত। তাহলে কিন্তু সিনারিও পাল্টে যেত। তার অন্তভূক্তি দারুণ ছিল। আমরা তাকে নিয়ে বাজি ধরেছিলাম। ও খেলতে পারবে কি পারবে না সেটা অনিশ্চিত ছিল। আমরা সেই সুযোগ নিয়েছি এবং ও আস্থার প্রতিদান দিয়েছে। ওর বোলিং গেম চেঞ্জার ছিল আমাদের জন্য। আমাদের বোলিং একটু নড়বড়ে ছিল। ও আসায় পরিবেশ পাল্টে গিয়েছিল।’

সাইফউদ্দিনের মতো অলরাউন্ড নৈপুণ্যে শিরোপা জয়ে বড় অবদান রেখেছেন কাইল মায়ার্সও। শিরোপা জয়ের পর ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডারের কথাও আলাদা করে বললেন বরিশাল অধিনায়ক। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে মোহাম্মদ আমির, ফখর জামানদের নিয়ে দল সাজিয়েছিল বরিশাল। কিন্তু পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের অনাপত্তিপত্র না পাওয়ায় তাদের আসা হয়নি। পরিকল্পনা পাল্টে মায়ার্সকে দলে নেয় বরিশাল। শেষ দিকে ছয় ম্যাচ খেলে তিনটিতেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ১৫৭.৭৯ স্ট্রাইক রেটে করেন ২৪৩ রান ও বোলিংয়ে ৯ উইকেট নেন। ফাইনালে হন ম্যাচ সেরা। 

তাকে নিয়ে তামিমের উচ্ছ্বাস টের পাওয়া যায়, ‘আমরা যখন কাইল মায়ার্সকে দলে নেওয়ার সুযোগ পেলাম... সে নতুন বলে বোলিং করে এবং যেভাবে ব্যাটিং করে, আমার মতে তার অন্তর্ভুক্তি অসাধারণ ছিল। আসার পর থেকে ব্যাটিং বা বোলিং, কোনো না কোনো কিছুতে ওর প্রভাব ছিল। প্রতিটি ম্যাচে সে দুটিই করেছে। তার পারফরম্যান্সটা আমাদের জন্য অনেক বড় বিষয় ছিল।’

টুর্নামেন্টের সেরা ব্যাটসম্যান, সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন তামিম। ব্যক্তিগত অর্জনের থেকে অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ট্রফি জয়ের আনন্দই বেশি ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে, ‘ব্যক্তিগত কোনো ইমোশন ছিল না। আমি ভালো করতে চেয়েছিলাম। আমার ফিটনেসের দিক থেকে হয়তো সেরা অবস্থানে ছিলাম না। কিন্তু অবদান রাখতে পেরেছিলাম যা খুবই তৃপ্তি দিচ্ছে।’

বরিশাল নামে এর আগে তিনটি ফাইনাল খেলেছিল তিন দল। চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপায় চুমু খেতে পারেনি কেউ। তামিমের ফরচুন বরিশাল পারল। এই শিরোপার নেপথ্যে অজস্র ঘামবিন্দু ঝরিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। শিরোপা জিতে তাদের সব কষ্ট সার্থক।

ঢাকা/ইয়াসিন/বিজয়


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়