গ্যাস শ্রমিক থেকে জাতীয় দলে, রূপকথাকে হার মানালেন উসমান
ক্রিকেট খেলার ইতিহাস আভিজাত্যে মোড়ানো। সেই তুলনায় ক্রিকেটারদের উঠে আসার ইতিহাস চাকচিক্যে মোড়ানো নয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের একটা বড় অংশই এসেছে জীবন ও জীবিকার সঙ্গে লড়াই করে। লক্ষ্যের পানে ছুটতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েও সফলতার পেছনে দৌড়ে ছুঁতে পেরেছে শিখর। তেমনই একজন পাকিস্তান জাতীয় দলের উসমান খান।
উসমান খান নামটা সামনে আসলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিভিন্ন ঘরোয়া ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে ব্যাট হাতে রানের ফোয়ারার দৃশ্য। সেই উসমান এবার রান ফোয়ারা ছুটাবেন জাতীয় দলের হয়ে। প্রথমবারের মতো পাকিস্তান দলে ডাক পাওয়া উসমানের এ পর্যন্ত আসার পথটা হার মানাবে রূপকথাও। নিউ জিল্যান্ড সিরিজের দলে ডাক পাওয়া সংগ্রামী উসমানের গল্প ফুটিয়ে তুলেছে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)।
জন্ম পাকিস্তানের করাচিতে। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল দেশের হয়ে খেলার। কিন্তু প্রচণ্ড আর্থিক কষ্ট নিয়ে স্বপ্নের পেছনে ছুটতে চাওয়া স্রেফ বিলাসিতা। তাও পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে সুযোগ খুঁজছিলেন, পেয়েছেন অবহেলা। আর্থিক দুর্দশা আর মনঃকষ্ট নিয়ে উসমান পাড়ি জমালেন মধ্যপ্রাচ্যে। আরব আমিরাতে একটি গ্যাস বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিলেন শ্রমিকের।
প্রবাস জীবনে এসেও স্বপ্নের পেছনে ছুটতে লাগলেন উসমান। সারাদিন কাজ শেষেও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন অপেশাদার টুর্নামেন্টে খেলতে থাকলেন। আর এক্ষেত্রে ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হলেন তার প্রতিষ্ঠানের মালিক। তার সমর্থনে উসমান ধীরে ধীরে সুনাম কুড়াতে থাকেন, একপর্যায়ে সুযোগ পেয়ে যান আবুধাবি টি-টেন লিগে। সেখানে অংশ নেন স্থানীয় ক্রিকেটার হিসেবে।
পিসিবির ভিডিওতে উসমান বলেন, ‘করাচি পোর্ট ট্রাস্টের হয়ে আমার ভাই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন। আমি তাকে অনুসরণ করতাম, তার সাথে প্র্যাকটিসে যেতাম। তখন স্বপ্ন দেখতাম, আমিও ক্রিকেট খেলবো, বড় খেলোয়াড় হবো। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে একটা কমপ্লেক্সে থাকতাম এবং তখন আমার ধ্যানজ্ঞান ছিল ক্রিকেট।’
তবে ভাগ্য এত সহায় ছিল না। পরিবার চালাতে হিমশিম খেয়ে চলে যান আরব আমিরাতে, সেখানে শ্রমিক থাকাকালেই সুনাম কুড়ান ক্রিকেটে। উসমান বলতে থাকেন, ‘আজমান গ্যাসে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে করে ক্রিকেট চালিয়ে গেছি। আমাদের প্রতিষ্ঠানের মালিক এটা সমর্থন করতেন, তাতে আমরা কয়েকটা স্থানীয় টুর্নামেন্টে ট্রফি জিততে সক্ষম হই।’
এরপরই উসমানের জীবনের বাঁকবদলের শুরু। আর সেটা জিম্বাবুয়ের কিংবদন্তি ক্রিকেটার অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের জহুরি চোখের কল্যাণে। স্মৃতিরে ভাসতে থাকেন উসমান, ‘২০২২ সালে টি-টেন খেলার সময় অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার আমাকে দেখেন। সেখানকার পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ২০২৩ পিএসএলে স্থানীয় ক্রিকেটার হিসেবে সুযোগ পাই। এরপর বিপিএলে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে বুঝতে পারি, আমি ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠছি।’
এতোকিছুর পরও আলোর দেখা পাচ্ছিলেন না পরভূমে পড়ে থাকা উসমান। বিপিএল, পিএসএল, টি-টেন লিগে ভালো করেও পাকিস্তান জাতীয় দলের সুনজরে না আসায় নিজেকে আরব আমিরাতের ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। অতঃপর সেই পাকিস্তানের লিগেই চোখ ধাঁধানো পারফর্ম্যান্স করে নির্বাচকদের নজরে পড়েন, সুযোগ পেয়ে যান পাকিস্তান দলে, স্বপ্ন পূরণ হয় উসমানের। বিনিময়ে আশ্রয়দাতা আরব আমিরাতের সাথে ছিন্ন হয় সম্পর্ক!
তবুও উসমানের কোনো আক্ষেপ নেই। করাচির ছোট্ট এক শহর থেকে যে স্বপ্ন বুনেছিলেন, সেই স্বপ্ন দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ধরা দিয়েছে স্বয়ং করাচিতেই। গায়ে জড়িয়েছেন সবুজাভ জার্সি। এখন অপেক্ষা কেবল ব্যাট হাতে রান ফোয়ারার, যে স্বপ্নটা উসমান দেখেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের ঝাঁঝালো রোদের তীব্র ঝলকানিতে।
ঢাকা/বিজয়